‘এই কাগোজ...আছে ভাংগারি বিকরি কাগোজ...। আছে পুরাতন বইখাতা, কাগোজ...’ এত সুর করে বলছিলেন লোকটা, খানিক বিরতি দিয়ে দিয়ে, শোনার আকাঙ্ক্ষা জিইয়ে থাকে!
৮ আগস্ট, বেলা ১১টা। শ্রাবণ মাস গত হতে চলল, তার লেশমাত্র ছোঁয়া নেই প্রকৃতিতে। রোদের তীব্রতায় ভ্রম হয়, মরুদেশের সূর্য বুঝি ঢাকার আকাশে এমনকি গোটা বাংলাদেশের মাথার ওপর! ‘এই শ্রাবণের বুকের মাঝে আগুন আছে’—রবীন্দ্রনাথ থেকে কেউ উদ্ধৃত করলে কথাটির আড়ালের অর্থ মনে আসার কারণ নেই, এমন তাপময় এবারের শ্রাবণ! শুধু শ্রাবণ কেন, আষাঢ়ও পাল্লা দিয়ে নিরম্বু থাকল।
এমন তাপিত দিনে সুরে সুরে ভেসে আসা ‘এই কাগোজ...আছে ভাংগারি বিকরি কাগোজ...’ কথাগুলো যেন একপশলা বৃষ্টির আমেজ তৈরি করল! আহা! কী মধুর!
লোকটির নাম সামছুল আলম। বয়স ত্রিশের কোঠায়। হালকা-পাতলা গড়ন। মাঝারি উচ্চতা। পরনে লুঙ্গি ও শার্ট। গলায় একখানা গামছা জড়ানো। বলা নিষ্প্রয়োজন যে শুধু পোশাক নয়, তাঁর চেহারাতেও মলিনতা, গরিবির ছাপ। ইয়া বড় একটি ঝাঁকা মাথায়। তবে সেটি তখনো ফাঁকা; কোনো মালপত্র নেই।
আলাপ শুরু করতেই বোঝা গেল, তাঁর কথা কিছুটা বেঁধে বেঁধে যায়। আর কথাবার্তা আরেকটু গড়াতেই পরিষ্কার হয়ে গেল, তাঁর জীবনটা চলছে ঘষটাতে ঘষটাতে; চলে তো চলে না। সুরের আড়ালে বেসুরো বাস্তবতা।
ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন। মা–ও গত হয়েছেন বছর দেড়েক। মা-বাবার একমাত্র সন্তান। গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার লাখাই উপজেলার সুনেশ্বরে। বাড়িতে স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান। তাদের মধ্যে বড়টি মেয়ে, বয়স সাড়ে তিন; ছোটটি ছেলে, দুগ্ধপোষ্য। তবে শিশুটির ঠিকঠাক দুধ জোটে কি?
তাই শ্রমজীবী মানুষটির ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী জেঁকে বসা মূল্যস্ফীতি, অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থা, লোডশেডিং, রাজনীতির বাহাস, নির্বাচনের কাটাছেঁড়া।
সামছুল তাঁর বয়স থেকে শুরু করে, ঢাকায় বসবাসের মেয়াদ, আয়-রোজগার কোনোটিই সুনির্দিষ্ট করে বলছিলেন না। যেমন বয়স ত্রিশ-বত্রিশ, ঢাকায় থাকেন আট-দশ বছর। আর তাঁর দৈনিক বা মাসিক আয়ের ক্ষেত্রে যা বললেন, আসলেই তারও কোনো ঠিকঠিকানা নেই। তাঁর কথায়, একটা বাসায় যদি দৈনিক পত্রিকা রাখা হয়, দুই-তিন মাসের আগে তা বিক্রি করে না। পুরোনো বইপত্রও মানুষ বছরে এক-আধবার বেচে। আর ধীরে ধীরে প্রয়োজন হারিয়েছে এমন জিনিস, মানে হাঁড়িকুড়ি, প্লাস্টিকের ডিব্বাডুব্বা ইত্যাদি সাধারণত মানুষ বাস বদলের সময় কমিয়ে ফেলে। অনেক সময় নতুন কিছু, যেমন মিটসেফ ইত্যাদি আনলে পুরোনোটি ছেড়ে দেয়। সামছুল তাই বলছিলেন, কোনো দিন এক শ-দুই শ হয়, কোনো দিন বা চার শ-পাঁচ শ পকেটে ওঠে, কোনো দিন ফিরতে হয় শূন্য হাতে।
ঢাকার জিগাতলার এক গলির ভেতর কয়েকটি টিনের ঘর রয়েছে। সেখানে এক কক্ষে তাঁরা পাঁচজন থাকেন। সামছুলের মতো তাঁদের সবার পরিবার গ্রামের বাড়িতে। প্রত্যেকের ভাড়া এক হাজার করে, অর্থাৎ টিনের ঘরের এক কক্ষের জন্য মালিক পাচ্ছেন মাসে পাঁচ হাজার টাকা। বাথরুম, রান্নাঘর সবকিছুর শরিকি ব্যবহার। এত দিন খেতে তাঁদের মাথাপিছু দৈনিক লাগত দেড় শ টাকা। ‘অ্যাহন যে কত লাগব, আল্লাহ জানেন!’ , বলেই হাসেন সামছুল। কী কারণ? বললেন, ‘ত্যালের দাম’।
তাঁর গাড়িঘোড়ায় যাতায়াত নেই বললেই চলে, হেঁটে হেঁটে ঘোরেন। বেশি মালসামান হলে ভ্যানে করে নিয়ে যান বিক্রির জন্য। কিন্তু, ত্যালের দামের প্রভাব যে পড়েছে সব জিনিসের ওপর। সামছুল বললেন, ‘ক্যামনে যে দিন চলব, আল্লাহ জানেন!’ এবারও কথা শেষে স্মিত হাসলেন। জানালেন, আগে সড়কপথে বাড়িতে যেতে পাঁচ শ টাকার মতো লাগত। এখন নাকি তিন-সাড়ে তিন শ টাকার বাসভাড়া সাড়ে চার শ-পাঁচ শ হয়ে গেছে। দুই-তিন মাসে একবার বাড়ি যান তিনি।
বাড়িটা ছাড়া এক ছটাক জমিও নেই সামছুলের। মা বেঁচে থাকতে তিনি বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ করতেন। এতে কিছু আয় হতো। সেটি এখন বন্ধ। দুই বাচ্চার দেখভাল, ঘরসংসার সামলে স্ত্রী আর কিছু করার সময় পান না।
কথার ফাঁকে ফাঁকে গামছা দিয়ে মুখ মুছে নিচ্ছিলেন সামছুল; তিনি কি ক্লান্তি, দুশ্চিন্তাও মুছে নিচ্ছিলেন? যেভাবে প্রতিবার দুঃখ-দুর্দশার কথা বলার পর হাসছিলেন; শব্দহীন স্মিত সেই হাসির আড়ালে পড়ে থাকছিল যেন জীবনের সব ক্ষত, কালশিটে দাগ, ময়লা ঝুলি। প্রতিদিনই যুদ্ধ, প্রতিটা আগামী দিন অনিশ্চয়তায় ভরা, তবু কী নিদাগ হাসি হাসতে পারেন সামছুল! বললেন, দিন শেষে বিছানায় গিয়ে পড়েন তো এক ঘুমে রাত পার।
সামছুল ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেন কি না, শোনা হয়নি। দেখলে কী দেখেন? নিশ্চিত তাঁর বাড়ির আঙিনায় মেয়েটির কিতকিল খেলা, ছেলেটির টলটলে পায়ে হাঁটতে গিয়ে আছাড় খাওয়ার পর ফোকলা দাঁতের হাসি—এসবই দেখেন! তাই শ্রমজীবী মানুষটির ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী জেঁকে বসা মূল্যস্ফীতি, অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থা, লোডশেডিং, রাজনীতির বাহাস, নির্বাচনের কাটাছেঁড়া। কারণ, সামছুল বলছিলেন, ‘ভাগ্য’ ভালো হলে কোনো কোনো দিন আয় হয় হাজার টাকাও। অর্থাৎ, তাঁর জীবন তিনি সঁপে দিয়েছেন ভাগ্যের হাতে; কিন্তু জানেন না যে তাঁর এই ‘আধেক মানুষের’ জীবনের জন্য ভাগ্যের কোনো দায় নেই।
হাসান ইমাম সাংবাদিক
[email protected]