সরাসরি নিষিদ্ধ করাই সেন্সরশিপের একমাত্র উপায় নয়। মার্গারেট ই রবার্টস তাঁর ‘সেন্সরড: ডিসট্রাকশন অ্যান্ড ডাইভারশন ইনসাইড চায়নাস গ্রেট ফায়ারওয়াল’ শীর্ষক পুস্তকে সেন্সর–ব্যবস্থার নানান ধরন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ‘ফ্রিকশন’ বা নানা রকম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে কীভাবে কোনো লেখা, তথ্য বা প্রকাশনার বিতরণ ও সংগ্রহকে কঠিন করে তোলা হয়, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ফ্রিকশনের মাধ্যমে সেন্সরশিপের বেলায় ফ্রিকশনের আওতায় থাকা কোনো তথ্য সংগ্রহের দোষে কাউকে শাস্তি দেওয়া হয় না; বরং তথ্যের ওপর কর আরোপের মতো করে এই পদ্ধতিতে তথ্য পাওয়ার পথে এমনভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয় যেন ওই তথ্য খুঁজে পেতে মানুষকে বেশি সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করতে হয়। এসব ক্ষেত্রে নাগরিকেরা স্রেফ তথ্য সংগ্রহ ও বিতরণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়েন কিন্তু তাঁরা অনেক সময় তা জানতে বা বুঝতে পারেন না বা বুঝলেও নিশ্চিত প্রমাণ করতে পারেন না যে এই প্রতিবন্ধকতাগুলো সরকারেরই তৈরি।
সরাসরি নিষিদ্ধ না করে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে সেন্সরশিপের এই ‘স্মার্ট’ পদ্ধতির কথা মাথায় এল সম্প্রতি অমর একুশে বইমেলায় বাংলা একাডেমি কর্তৃক আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ না দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। বইমেলায় প্রকাশনা সংস্থা আদর্শকে স্টল বরাদ্দ না দেওয়ার ব্যাখ্যা হিসেবে বাংলা একাডেমি ২২ জানুয়ারি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, বইমেলার নীতিমালা অনুসরণ না করে বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে নামের একটি বই প্রদর্শন ও বিক্রির জন্য বইমেলার স্টলে রাখতে চাওয়ায় আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হবে না। (বইমেলায় ‘আদর্শ’কে স্টল না দেওয়ার যে ব্যাখ্যা দিল বাংলা একাডেমি, ২২ জানুয়ারি ২০২৩, প্রথম আলো)
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো ফাহাম আব্দুস সালামের লেখা বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে বইটি সরকার সরাসরি নিষিদ্ধ করেনি। কিন্তু সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি ‘স্বায়ত্তশাসিত’ সংস্থা বাংলা একাডেমি তার নীতিমালাকে ব্যবহার করে এমন একটি পদক্ষেপ নিল যেন বইটি বাংলাদেশের বই কেনাবেচার সবচেয়ে বড় উৎসবে স্থান না পায়। এ বিষয়ে বাংলা একাডেমি কর্তৃক উল্লেখিত অমর একুশে বইমেলা–২০২১ নীতিমালা ও নিয়মাবলির (সংশোধিত) ধারা ১৪.১৪ অনুসারে, ‘অশ্লীল, রুচিগর্হিত, জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি কটাক্ষমূলক, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয় এমন বা জননিরাপত্তার জন্য বা অন্য যেকোনো কারণে বইমেলার পক্ষে ক্ষতিকর কোনো বই বা কোনো পত্রিকা বা অন্য কোনো দ্রব্য অমর একুশে বইমেলায় বিক্রি, প্রচার ও প্রদর্শন করা যাবে না।’
বাংলা একাডেমির এই নীতিমালার সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অন্তত চারটি ধারার মিল লক্ষ করা যায়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮–এর ২৫ ধারায় ব্যক্তির ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি, ২৮ ধারায় ধর্মীয় অনুভূতি, ২৯ ধারায় মানহানি এবং ৩১ ধারায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অজুহাতে শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এই ধারাগুলোর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, তা বাংলা একাডেমির বইমেলা নীতিমালার ধারার ক্ষেত্রেও করা যায়।
যে বাংলা একডেমির ঘোষিত লক্ষ ও উদ্দেশ্য হলো ‘সমকালীন শিল্প ও সাহিত্য সংরক্ষণ এবং গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে জাতির মানসিক বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধন’ সেই বাংলা একাডেমির বইমেলার নীতিমালার ভাষা ও শর্ত যখন কুখ্যাত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনুরূপ হয়, তখন তা আশঙ্কাই তৈরি করে। শ্লীল-অশ্লীল, রুচি-অরুচি, মানহানি, অনুভূতি—এই বিষয়গুলোর কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা বা মানদণ্ড নেই। এগুলো একেক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে একেক সময় একেক রকম হতে পারে।
কোনো বই নিষিদ্ধ না করে ওই বইয়ের প্রকাশককে দেশি–বিদেশি বইমেলায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা করলে ওই বইয়ের বিক্রি বাড়লেও প্রকাশক অন্য সব বই নিয়ে বিপদে পড়েন। আদর্শ প্রকাশনীর সঙ্গে ঠিক এ কাজই করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অন্য সব প্রকাশককেও বার্তা দেওয়া হলো যে ভিন্নমতের বই প্রকাশ করলে কী ঘটতে পারে।
লেখালেখি ও মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে সর্বজনীন নীতিমালা হলো লেখা বা বক্তব্যের মাধ্যমে অন্য কোনো লেখা বা বক্তব্যকে মোকাবিলা করা। যেসব দেশে ন্যূনতম গণতন্ত্র ও মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার আছে, সেসব দেশে কোনো বইয়ে প্রকাশিত লেখা শ্লীল না অশ্লীল, রুচিকর না অরুচিকর—এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার পাঠকের ওপরই ন্যস্ত করা হয়, কোনো সংস্থা বা কর্তৃপক্ষের হাতে নয়।
রুচি-অরুচি, শ্লীলতা-অশ্লীলতা কিংবা মানহানির মতো সাবজেক্টিভ বিষয়কে বইমেলায় অংশগ্রহণের শর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো রাজনৈতিক স্বার্থে বইপত্র সেন্সরের সুযোগ তৈরি করা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে যেভাবে কখনো ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার নামে মানুষকে জেলে ঢোকানো হয়, সেভাবেই বাংলা একাডেমি রুচি, অশ্লীলতা আর মানহানির নামে বইপত্র সেন্সর করছে এই স্বৈরতান্ত্রিক নীতিমালা ব্যবহার করে। আদর্শ প্রকাশনীকে এবারের বইমেলায় স্টল না দেওয়ার সিদ্ধান্ত তারই একটি দৃষ্টান্ত।
আদর্শ প্রকাশনী প্রথমে বাংলা একাডেমি উল্লেখিত বইটি মেলা থেকে প্রত্যাহারে আপত্তি জানালেও পরে ‘বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায়’ বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে বইটি প্রদর্শন ও বিক্রি না করার শর্তেই বইমেলায় প্যাভিলিয়ন বরাদ্দের আবেদন করে। (ওই বই বিক্রি করবে না আদর্শ, বিনিময়ে স্টল বরাদ্দ চায় প্রকাশনা সংস্থাটি, ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, প্রথম আলো) বুঝতে অসুবিধা হয় না যে প্রকাশনা সংস্থাটির ইতিমধ্যে প্রকাশিত প্রায় ৩০০ লেখকের ৬০০ বইয়ের বিনিয়োগকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তা থেকেই হয়তো আদর্শকে এই শর্ত মেনে নিতে হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা ছিল, বাংলা একাডেমি যে বইয়ের ব্যাপারে নীতিমালা ভঙ্গের অভিযোগ তুলে বরাদ্দ স্থগিত করেছিল, আদর্শ সেই বই মেলায় প্রদর্শন না করার অঙ্গীকার করার ফলে সেই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।
কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আদর্শ প্রকাশনী বাংলা একাডেমির দেওয়া শর্ত মেনে নেওয়ার পরও বাংলা একাডেমি আদর্শকে স্টল বরাদ্দ না দেওয়ার ব্যাপারে অটল থাকার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।
আরও অদ্ভুত ব্যাপার হলো এবার আদর্শ প্রকাশনীকে পাঠানো চিঠিতে স্টল বরাদ্দ না দেওয়ার কোনো কারণ দর্শানোরও প্রয়োজন মনে করেনি বাংলা একাডেমি, স্রেফ জানিয়ে দিয়েছে, ‘সব দিক বিবেচনা করে অমর একুশে বইমেলা-২০২৩ পরিচালনা কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে আপনাদের প্রকাশনা সংস্থা “আদর্শ”-এর অনুকূলে স্টল বরাদ্দ প্রদান না করার পূর্বের সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছে।’ (বইমেলায় ‘আদর্শ’কে স্টল না দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল বাংলা একাডেমি, ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, বাংলা ট্রিবিউন)
শুধু তা–ই নয়, বইটি বাংলাদেশের অনলাইনে বই বিক্রির বৃহত্তম প্ল্যাটফর্ম রকমারি ডটকম থেকেও কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির মাধ্যমে বইটিকে ৪৬তম কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলারও বাইরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৩০ জানুয়ারি সমিতির পক্ষ থেকে আদর্শ প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী মাহবুবুর রহমান বরাবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ‘আদিষ্ট হয়ে আপনার সদয় অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জানানো যাচ্ছে যে আপনার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান “আদর্শ” থেকে প্রকাশিত ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’র লেখক ফাহাম আব্দুস সালামের বইটি ৪৬তম কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা-২০২৩–এ প্রদর্শন ও বিক্রয় করা থেকে বিরত থাকার জন্য বলা হলো।’
প্রশ্ন হলো, বইমেলাসংক্রান্ত নীতিমালা ভঙ্গের অভিযোগে বাংলা একাডেমি বইটিকে একুশে বইমেলা থেকে দূরে রেখেছে, কিন্তু পুস্তক প্রকাশক সমিতি কোন নীতিমালা বা এখতিয়ারবলে কলকাতা বইমেলায় বইটি বিক্রি ও প্রদর্শনী না করার নির্দেশনা দিল! পুস্তক প্রকাশক সমিতি অবশ্য লিখেছে, তারা ‘আদিষ্ট’ হয়ে এই নির্দেশনা দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, পুস্তক প্রকাশক সমিতিকেই–বা এই আদেশ কে দিল এবং কোন আইন বা নীতিমালাবলে দিল!
এভাবে কোনো বইকে সরাসরি নিষিদ্ধ না করে দেশের ও দেশের বাইরের বইমেলা ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে সরিয়ে দেওয়া ও বইয়ের প্রকাশককে ‘শিক্ষা দেওয়া’র এই ব্যবস্থাকে আমি এখানে স্মার্ট সেন্সরশিপ বলছি। কোনো বই নিষিদ্ধ করলে বইটির বিক্রি উল্টো বাড়ে। কিন্তু কোনো বই নিষিদ্ধ না করে ওই বইয়ের প্রকাশককে দেশি–বিদেশি বইমেলায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা করলে ওই বইয়ের বিক্রি বাড়লেও প্রকাশক অন্য সব বই নিয়ে বিপদে পড়েন। আদর্শ প্রকাশনীর সঙ্গে ঠিক এ কাজই করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অন্য সব প্রকাশককেও বার্তা দেওয়া হলো যে ভিন্নমতের বই প্রকাশ করলে কী ঘটতে পারে।
বাংলাদেশের বইয়ের বেচাবিক্রি যেহেতু অনেকাংশেই বইমেলাকেন্দ্রিক, কাজেই কোনো প্রকাশককে বইমেলায় স্টল না দিলে সেটা তাঁর জন্য অনেক বড় বিপদ। এই ঘটনার পর ভিন্নমতের বই প্রকাশ করতে যেকোনো প্রকাশক দ্বিতীয়বার চিন্তা করবেন। এটাকে ‘উৎসে সেন্সরশিপ’ও বলা যেতে পারে, অনেকটা উৎসে কর কর্তনের মতো কার্যকর। সংবাদপত্রের কলাম লেখক কিংবা টেলিভিশনের টক শোর আলোচকদের জনে জনে ভয় দেখানোর চেয়ে সংবাদপত্র বা টেলিভিশনের কয়েকজন সম্পাদককে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সীমা’ বুঝিয়ে দেওয়াটা সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। একইভাবে আলাদা আলাদা বই নিষিদ্ধ করার চেয়ে প্রকাশকদের সাবধান করে দেওয়াই হতে পারে ভিন্নমতের বই প্রকাশ বন্ধ করার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। আদর্শকে মেলায় স্টল না দেওয়ার সিদ্ধান্তটি প্রতিহত করতে না পারলে এই ধরনের স্মার্ট সেন্সরশিপের দৃষ্টান্ত হয়তো আমাদের আরও দেখতে হবে।
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক, প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘বাংলাদেশে উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি’, ‘ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ, নজরদারি পুঁজিবাদ ও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ভবিষ্যৎ’। ই-মেইল: [email protected]