জাতীয় সংসদে কেন নারী কোটা থাকবে?

১৯৮৬ সালে শফিক রেহমান সম্পাদিত সাপ্তাহিক যায়যায়দিন পত্রিকার একটি সংখ্যায় ‘সংসদের শোভা তিরিশ সেট অলংকার’ শিরোনামে একটি প্রচ্ছদ–কাহিনি ছাপা হয়েছিল। এটি ওই সময় পাঠকদের মধ্যে হইচই ফেলে দিয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত ৩০টি নারী আসনে মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে অনেক কথা লেখা হয়েছিল। তাতে তথ্য যেমন ছিল, রঙ্গরস আর বিদ্রূপও ছিল।

১৯৮৬ সালের নির্বাচনে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন ছিনিয়ে নিয়েছিল। তখন সংসদে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন ছিল ৩০টি। তো জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পেতে অনেক নারী হামলে পড়েছিলেন। ভাগ্যবানদের কপালে শিরোপা জুটলেও দলের সুনজর না পেয়ে অনেকেই আক্ষেপ করেছিলেন। কেউ কেউ এমনও বলেছিলেন, দলের মনোনয়ন পেতে তাঁরা অনেক দৌড়ঝাঁপ, টাকার শ্রাদ্ধ, এমনকি জীবন-যৌবন দিয়ে ফেলেছেন। এখন তাঁদের কী হবে?

আমরা জানি, সংসদে সরাসরি ভোটে যে ৩০০ জন সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসেন, তাঁরা সংরক্ষিত আসনে নারীদের মনোনয়ন দেন। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী এটাই দস্তুর। তাঁরা তাঁদের দলীয় নেতার আজ্ঞা অনুযায়ী এ কাজ করেন। এখানে বিবেচনায় থাকে দলের প্রধান নেতা ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা দলের নেতা বা নেতাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-বন্ধু। প্রতিবেদনটি পড়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যারপরনাই গোস্‌সা হয়েছিলেন। যায়যায়দিন–এর অফিসে জাতীয় পার্টির গুন্ডারা হামলা চালিয়ে তছনছ করেছিল। পত্রিকাটি তখন নিষিদ্ধ হয়।

২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংসদের শোভা আরও বাড়ে। অলংকারের সংখ্যা ৩০ থেকে বেড়ে হয় ৪৫ সেট। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর এই সংখ্যা বাড়িয়ে ৫০ করা হয়। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের চেষ্টা ও উদ্যোগ অনেক ক্ষেত্রেই প্রশংসনীয়। কিন্তু সংরক্ষিত আসনে এমপি বানিয়ে তাঁদের কতটা ক্ষমতায়ন হয়, আমি তা বুঝতে অক্ষম। আমাদের একটি লিখিত সংবিধান আছে। সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে অঙ্গীকার করা হয়েছে, রাষ্ট্র নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না। বলা হয়েছে, রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার থাকবে।

জাতীয় সংসদে নারীর জন্য আসন সংরক্ষিত থাকুক, তাতে আপত্তির কোনো কারণ দেখি না। কিন্তু সংরক্ষিত আসনে নির্দিষ্ট এলাকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসতে বাধা কোথায়? নির্বাচনের দিন ভোটাররা দুটি ব্যালট ব্যবহার করবেন। একটি সাধারণ আসনের এবং অন্যটি সংরক্ষিত আসনের প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য। তখন সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারবেন, তাঁরাও নির্বাচিত প্রতিনিধি। না হলে তাঁরা ৫০ সেট অলংকার হয়েই থাকবেন। প্রশ্ন হলো, সংসদ অধিবেশন অলংকৃত করার জন্য জনগণ কেন তাঁদের বেতন-ভাতা দেবেন?

সংসদ নির্বাচনে সব আসনে নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাই অংশ নিতে পারেন। তারপরও নারীর জন্য আলাদা ‘কোটা’ কেন? রাষ্ট্র সমাজের পশ্চাৎপদ অংশকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে, যাতে তারা মূলস্রোতে যুক্ত হতে পারে। এটা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে ‘নারী’ একটি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। সমাজটা পুরুষতান্ত্রিক। স্বাভাবিক নিয়মে নারীর পক্ষে পুরুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হওয়ার পথে অনেক বাধা। পুরুষের সঙ্গে এক কাতারে উঠে আসতে হলে তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।

১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত অখণ্ড পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে ১৩টি ও প্রাদেশিক পরিষদে ১৫টি আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত ছিল। বাহাত্তরের সংবিধানে নারীর জন্য ১৫টি আসন পরবর্তী ১০ বছরের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছিল। ওই সময়ের বাস্তবতায় এটি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল। পরে ধাপে ধাপে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ও মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।

আরও পড়ুন

নারীর জন্য আলাদা কোটা কেন—এ প্রশ্ন বারবারই উঠেছে। মুশকিল হলো, এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো পুরুষময়। দলের প্রধান নেতা নারী হলেও দেখা যায়, তিনি যতটা না এসেছেন নিজ গুণে, তার চেয়ে বেশি এসেছেন পারিবারিক কোটায়। দলগুলোর মধ্যে যে পরিবেশ ও সংস্কৃতি, তাতে নারীরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। আমরা অনেক পেশায় নারীর অগ্রগামী ভূমিকা দেখি। তাঁরা অনেকেই দক্ষ শিক্ষক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী, আমলা, বৈমানিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং আরও কত কিছু। অথচ রাজনীতিতে তাঁরা ব্রাত্য কিংবা পেছনের সারিতে। তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের চেয়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বা এনজিওর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার ঝোঁক বেশি।

দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পুরুষদের আখড়া হবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ থাকবে না, একটা রাষ্ট্রের জন্য এটা মোটেও সম্মানজনক নয়। আধুনিক সমাজের সঙ্গে এটি সংগতিপূর্ণও নয়। সে জন্য সংবিধানবিশারদেরা ভেবেছিলেন, একটু বাড়তি সুযোগ দিয়ে হলেও নারীকে বেশি বেশি দৃশ্যমান করতে হবে। আইনসভার সর্বোচ্চ ফোরামে তাঁদের নিয়ে আসতে হবে। সংসদের সাধারণ আসনে তাঁরা কেউ যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন, তাহলে তো সোনায় সোহাগা।

কিন্তু সেটি হয় না বললেই চলে। খুব অল্পসংখ্যক নারীই সাধারণ নির্বাচনে পুরুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতে আসতে পেরেছেন। আসন সংরক্ষণের মেয়াদ একাধিকবার বাড়িয়েও পরিস্থিতি বদলানো যায়নি। তাঁদের পক্ষে দলের মনোনয়ন পাওয়াই কঠিন। দলের নীতিনির্ধারকেরা তাই তাঁদের জন্য চালু করেছেন ‘কোটা’ প্রথা। বারবার কোটায় নির্বাচিত হয়ে অনেকেই সংসদ সদস্য হয়েছেন। এটাকে আমরা বলি ‘পজিটিভ ডিসক্রিমিনেশন’ বা ইতিবাচক পক্ষপাত। সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য এটা করা হয়ে থাকে। এর উদ্দেশ্য হলো নারী নেতৃত্ব বিকাশের অনুকূল বাতাবরণ তৈরি করে দেওয়া।

এটা একটা সাময়িক ব্যবস্থা। কিন্তু এটা যেভাবে চলে আসছে, তাতে আসল উদ্দেশ্যই মাঠে মারা যাচ্ছে। নারী কোটায় যাঁরা সংসদ সদস্য হচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগই নারী সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন না। তাঁরা সংসদে যান পুরুষ সংসদ সদস্যদের বদান্যতায়, দলীয় নেতার অনুকম্পায়। এতে গৌরবের কিছু নেই। আমাদের দেশে স্থানীয় সরকারে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন আছে। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোয় প্রায় আড়াই দশক ধরে তাঁরা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হচ্ছেন। কিন্তু জাতীয় সংসদে এটি চালু হয়নি। চালু না হওয়ার কারণ হচ্ছে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত বীরপুরুষেরা সত্যিকার অর্থে নারীর ক্ষমতায়ন চান না।

তাঁরা চান যেনতেনভাবে নিজেদের পছন্দের নারীকে সংসদে নিয়ে আসতে। এই চক্রে জুটেছেন এমন কিছু নারী, যাঁরা নির্বাচনী প্রতিযোগিতা এড়িয়ে সংসদ ক্লাবের সদস্য হতে মরিয়া। তাঁদের জন্য এটা একটা ভালো চাকরি। অর্থ, বিত্ত, প্রতিপত্তি, প্লট, ফ্ল্যাট—সবই মেলে। আত্মসম্মানবোধের কতটা অভাব হলে একজন নারী অন্যের দয়ার ওপর সওয়ার হয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছাতে চান, এটি তার একটি দৃষ্টান্ত। 

জাতীয় সংসদে নারীর জন্য আসন সংরক্ষিত থাকুক, তাতে আপত্তির কোনো কারণ দেখি না। কিন্তু সংরক্ষিত আসনে নির্দিষ্ট এলাকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসতে বাধা কোথায়? নির্বাচনের দিন ভোটাররা দুটি ব্যালট ব্যবহার করবেন। একটি সাধারণ আসনের এবং অন্যটি সংরক্ষিত আসনের প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য। তখন সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারবেন, তাঁরাও নির্বাচিত প্রতিনিধি। না হলে তাঁরা ৫০ সেট অলংকার হয়েই থাকবেন। প্রশ্ন হলো, সংসদ অধিবেশন অলংকৃত করার জন্য জনগণ কেন তাঁদের বেতন-ভাতা দেবেন?

এযাবৎ যতগুলো রাজনৈতিক দল সরকারে গেছে, তারা কেউই সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের জন্য বিল উত্থাপন করেনি। নাগরিক সংগঠনগুলো এ নিয়ে অনেক সভা-সেমিনার করেছে, দাবি তুলেছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাপ্রত্যাশী বড় দলগুলো তাতে কান দেয়নি।

‘এক-এগারোর’ নির্বাচন কমিশন নিয়ম করে দিয়েছিল, পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে রাজনৈতিক দলের সব স্তরের কমিটিতে ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ সদস্য হবেন নারী। আজ পর্যন্ত কোনো দল এটি কার্যকর করেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর অসহযোগিতার কারণে এই বিধান সম্ভবত উঠে গেছে।

সম্প্রতি রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ মাঠে নেই। বিএনপি ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। কিন্তু তার কোনো দফায় সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের উল্লেখ নেই। তাহলে কিসের সংস্কার? সংসদে দলের পাল্লা ভারী করার জন্যই কি তাঁরা নারী কোটা বহাল রাখতে চান?

  • মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক