মার্কিন ব্যাংক ডাকাত উইলি সাটনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ব্যাংক ডাকাতি করলে কেন? সাটনের উত্তর ছিল, ‘টাকা তো ব্যাংকেই থাকে!’ মনে হচ্ছে, আমাদের নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা গত ১৫ বছরে একই মানসিকতা ধারণ করেছেন। ব্যাংক ডাকাতির বিদ্যায় তাঁরা হয়ে উঠেছেন পারদর্শী। তাঁদের এই দক্ষতা খুবই উদ্বেগের বিষয়।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ঘুরপাক খাচ্ছে এক অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে। কীভাবে এই অবস্থা হলো? কারণগুলো বিভিন্ন বিশ্লেষক ভালোভাবে নথিভুক্ত করেছেন। উদাহরণ হিসেবে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের কথা উল্লেখ করা যায়। তারা কয়েকটি ভালো গবেষণামূলক কাজ করেছে এ বিষয় নিয়ে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা বাংলাদেশে কীভাবে এমন এক সন্ধিক্ষণে পৌঁছে গেল, সমস্যাগুলোর গভীরতা কেমন—এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই মোটামুটি একমত। আমাদের ব্যাংক ও নিয়ন্ত্রণ–কাঠামোর সংস্কার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়েও সাধারণত কেউ দ্বিমত করেন না। কারণ, আমাদের অর্থনীতিতে ঋণের প্রাথমিক উৎস হচ্ছে ব্যাংক। আর কার্যকর ঋণব্যবস্থা ছাড়া আমাদের অর্থনীতি অচল হয়ে যাবে।
আমি বাংলাদেশের নাগরিক। নিউইয়র্ক আর লন্ডনে অর্থবাজার নিয়ে কাজ করার উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা আমার আছে। এই প্রেক্ষাপট থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা নিয়ে আমার কিছু অভিমত আছে। তা জানাতেই এই লেখার অবতারণা।
আতঙ্কিত হওয়া যাবে না
আমাদের আতঙ্কিত হওয়া উচিত হবে না। সৌভাগ্যবশত, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে, তা নজিরবিহীন নয়। আমি অন্যত্র এর চেয়ে খারাপ অবস্থা দেখেছি। ব্যাংক খাতের সত্যিকারের চিত্র পেতে আমাদের একটি নিরীক্ষার প্রয়োজন হবে।
বিভিন্ন সূত্রমতে এখন পর্যন্ত জানা যাচ্ছে যে দেশের খেলাপি ঋণের অনুপাত মোট ঋণের প্রায় ১০-১৫ শতাংশ। এই খেলাপি ঋণের অনুপাত যদি দ্বিগুণ বেড়ে ৩০ শতাংশ হয়ে যায়, তাহলেও বলব যে এর চেয়ে খারাপ অবস্থা আমি নিজে দেখেছি। উদাহরণস্বরূপ, ইউক্রেন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের অনুপাত ২০১৮ সালে ৫০ শতাংশের ওপরে পৌঁছে গিয়েছিল।
নিয়ন্ত্রণকাঠামো দুর্বল হলে বহু অনভিপ্রেত ফল ঘটতে পারে। তাই আমাদের পা ফেলতে হবে সাবধানে। ব্যাংকগুলোর সঙ্গে খুব কঠোর আচরণ করলে তারা ঋণ দেবে না। আর তেমন হলে আমাদের অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে
গ্রিসের খেলাপি ঋণের অনুপাতও ২০১৫ সালে ৫০ শতাংশ অতিক্রম করেছিল। আর ২০০০ সালে তুরস্কে এর অনুপাত ছিল ৩০ শতাংশ। এই জগাখিচুড়ি অবস্থা থেকে উত্তরণের একাধিক পথ আছে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমার এই আত্মবিশ্বাসের পেছনে আছে অর্থায়ন নিয়ে দুই দশকের কাজ করার অভিজ্ঞতা। এই দুই দশকে আমি ব্যাংকিং খাতের অনেক বৈশ্বিক সংকট পর্যবেক্ষণ করেছি।
সংকট থেকে সম্ভাবনা
তরুণদের মনে আছে কি না জানি না, আজ থেকে ১৫ বছর আগে আমাদের বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা প্রায় ধসে পড়েছিল। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগাল, গ্রিস ও আইসল্যান্ডের মতো উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো তাদের ব্যাংকগুলোকে বেইল আউট করতে হয়েছিল। ব্যাংকসংক্রান্ত প্রবিধানগুলোও পুনর্মূল্যায়ন করেছিল তারা।
প্রতিটি দেশের সামনে একই রকম বিকল্প হাজির থাকে। তবে রাজনৈতিক সম্ভাব্যতা এবং দার্শনিক ঝোঁকের ভিত্তিতে দেশগুলো ভিন্ন পথ বেছে নেয়। কিছু কিছু সমাধান অন্যগুলোর চেয়ে ভালো কাজ করে। তবে সব পরিস্থিতিতে, ব্যাংকগুলোকে আবার পর্যাপ্ত পরিমাণ পুঁজির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল, যেসব সম্পদ মূল্য হারিয়েছে, সেগুলো নিষ্পত্তি করা হয়েছিল আর পরিবর্তিত হয়েছিল প্রবিধানগুলো। এমন সব উদ্যোগের ফলে কিছু ক্ষেত্রে (যেমন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, জার্মানি ও আইসল্যান্ড), অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ফিরে এসেছে।
আজ এই দেশগুলোর অর্থনীতির আকার বিগত ব্যাংকিং সংকটের কালের চেয়ে বড়; কিন্তু অন্য কিছু দেশে (ইতালি, স্পেন ও গ্রিস), অর্থনীতির আকার এখনো সংকটকালের আগের তুলনায় অনেক ছোট রয়ে গেছে। আমি বিশ্বাস করি, সমাধানের সঠিক মিশ্রণ এবং সঠিক রাজনৈতিক সংকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ বর্তমান দুর্দশা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। শুধু তা–ই নয়, ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির জন্য আরও ভালো ভিত্তিও এর মধ্য দিয়ে নির্মাণ করা সম্ভব।
যা করা যায়
এই লেখার ভিত্তিই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। সেই সব অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের জন্য বর্তমানে প্রাসঙ্গিক এমন কয়েকটা বিষয় পেশ করছি। এক. সরকারি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। তবে তা যেন উৎকট না হয়। তা হতে হবে বহুপক্ষীয় সংস্থার সহায়তায়। কিছু দেশ এমনকি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোতে হস্তক্ষেপ করে লাভবানও হয়েছে। দুই. ব্যাংকের মূলধন–কাঠামো ঠিক করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি ব্যাংকের একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরীক্ষা করতে হবে। এর মাধ্যমে তাদের প্রকৃত অবস্থা এবং তাদের কত মূলধন প্রয়োজন তা বুঝতে সুবিধা হবে। যতটুকু সম্ভব, ব্যাংকগুলোকে বেসরকারি বাজারে এই মূলধন সংগ্রহের সুযোগ দিতে হবে। সরকার এখানে আসতে পারে শেষ ভরসা হিসেবে। সে ক্ষেত্রে সরকারের দেওয়া শর্তাবলিতে তার প্রতিফলন থাকতে হবে।
তিন. দুর্বল ব্যাংকগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ব্যাংকগুলো তাদের উৎপাদনশীল সম্পদ বুঝে নিতে পারে। এর ফলে প্রথমে কেন্দ্রীভবন বেড়ে যেতে পারে। তবে নতুন ব্যাংকিং লাইসেন্স দেওয়ার মাধ্যমে এই অবস্থা সামলে নেওয়া যেতে পারে। চার. সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি স্থাপন করতে হবে। এর কাজ হবে সমস্যাজনক সম্পদ নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করা। সরকার এই কোম্পানির জন্য প্রয়োজনীয় ইকুইটি এবং গ্যারান্টি দিতে পারে। তবে সমস্যাজনক সম্পদগুলো নিয়ে এই কোম্পানি যেন বহাল আইনি ব্যবস্থার মধ্যে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
পাঁচ. রাজনৈতিকভাবে জড়িত ব্যক্তিরা যাতে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নিতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে আমাদের দরকার শক্তিশালী স্বাধীন ব্যাংক নিয়ন্ত্রক। মনে রাখতে হবে, লোভী বা অবিবেচকের মতো কাজ করার কারণে আমাদের ব্যাংকগুলো সমস্যায় পড়েনি। সমস্যা সমাধানের সময় একটা বিষয় স্বীকার করে নিতে হবে। আর তা হলো উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে আমাদের ব্যাংকগুলো সব সময়ই ঋণ দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক চাপের মধ্যে থাকবে। আমাদের নিয়ন্ত্রণ–কাঠামো সেই চাপ সামাল দেওয়ার মতো করে গড়ে তুলতে হবে।
নিয়ন্ত্রণ–কাঠামো দুর্বল হলে বহু অনভিপ্রেত ফল ঘটতে পারে। তাই আমাদের পা ফেলতে হবে সাবধানে। ব্যাংকগুলোর সঙ্গে খুব কঠোর আচরণ করলে তারা ঋণ দেবে না। আর তেমন হলে আমাদের অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তৌহিদ আলী বৈশ্বিক বিনিয়োগ সংস্থা অ্যালায়েন্স বার্নস্টাইনের (এবি) সাবেক প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা