১৪ অক্টোবর অর্থনীতিবিদ ড্যারন আসেমোগলু, সিন জনসন ও জেমস এ রবিনসনকে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। তাঁদের গবেষণার বিষয় ছিল ‘কীভাবে প্রতিষ্ঠান গঠিত হয় এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে’। উল্লেখ্য, ‘প্রতিষ্ঠান’ বলতে সাধারণত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, যেমন আইনের শাসন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, বাক্স্বাধীনতা, নাগরিকদের স্বাধীন মতামত, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহ, সরকারের কার্যকারিতা প্রভৃতিকে বোঝায়। একটি দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান অপরিসীম।
এ বছর শান্তিতে নোবেল পেয়েছে জাপানি প্রতিষ্ঠান নিহন হিদানকায়ো ‘পরমাণু অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব অর্জনের প্রচেষ্টায়’ ভূমিকা রাখার জন্য। এ প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে আছেন হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত অ্যাটম বোমার ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেঁচে ফেরা জীবন্ত সাক্ষীরা।
তাঁরা পারমাণবিক বোমার ক্ষতিকর দিকগুলোর সাক্ষ্যপ্রমাণ জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দায়িত্বশীল মহলে তুলে ধরেছেন। বিশ্ববাসীকে বিভিন্ন সেমিনার ও কর্মশালার মাধ্যমে তাঁরা বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যেন বিশ্বে আর কখনো পারমাণবিক বোমার ব্যবহার না হয়। এটি নিঃসন্দেহে একটি মহৎ উদ্যোগ।
কিন্তু এই কার্যক্রম পারমাণবিক বোমার অধিকারী দেশগুলোর একে অন্যের ওপর পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের আশঙ্কা কতটুকু কমিয়েছে? দুঃখজনক হলেও সত্য, নিহন হিদানকায়োর প্রচার–প্রচরণা সত্ত্বেও পারমাণবিক কর্মসূচির বিস্তার কোনোভাবেই কমেনি, বরং উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে।
এখন আসা যাক অর্থনীতিতে এ বছরের নোবেল পুরস্কারের কথায়। তিনজন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিরূপণে অনেক গবেষণা করেছেন। তাঁরা ‘একটি দেশ কেন ধনী এবং আরেকটি দেশ কেন দরিদ্র’, এর কারণ বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাঁদের মূল কথা হলো, একটি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান সে দেশের সাফল্য বা ব্যর্থতার প্রধান নির্ধারক। টেকসই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অবদান নিয়ে তেমন বিতর্ক নেই। কিন্তু নোবেল কমিটি এই অর্থনীতিবিদদের কোন অবদানকে বিশেষ স্বীকৃতি দিল বা হাইলাইট করল, তার কিছু অংশ নিয়ে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
যে বিষয় নিয়ে বেশি বিতর্ক, তা হলো নোবেল কমিটি হাইলাইট করেছে যে, নোবেল বিজয়ীরা দেখিয়েছেন, ঔপনিবেশিকতা, উন্নত প্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। বলা হচ্ছে, উপনিবেশকারীরা তাদের উপনিবেশ স্থাপন করা যেসব দেশে মানসম্পন্ন ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠান রেখে এসেছে, সেসব দেশের টেকসই উন্নতিতে ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। নোবেল কমিটি এই বিশ্লেষণকে নোবেল বিজয়ীদের বড় অবদানের মধ্যে একটি বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এ দাবি কতটা যৌক্তিক?
উপনিবেশের ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে বলা যাক। প্রথমত, আমাদের জানতে হবে, কেন ব্রিটিশ, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ ও ফরাসিরা বিভিন্ন দেশে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করেছিল? এর জবাবে বলা যায়, অর্থনৈতিক স্বার্থ (সম্পদ আহরণ ও বাণিজ্য), রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা (বিশ্বব্যাপী প্রভাব ও সামরিক শক্তি সম্প্রসারণ) এবং সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় প্রেরণা (খ্রিষ্টধর্ম ও ইউরোপীয় সভ্যতার প্রসার) ইউরোপীয় উপনিবেশ সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা মোটেই তাদের এজেন্ডার অংশ ছিল না।
নোবেল কমিটি বলছে, নোবেল বিজয়ীরা তাদের দেখিয়েছেন, যে অঞ্চলগুলো উপনিবেশের সময় সমৃদ্ধ ছিল, সেগুলোয় উপনিবেশকারীরা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গঠন করতে পারেনি। ফলে পরবর্তী সময়ে ওই অঞ্চলগুলো দরিদ্র হয়েছে। কিন্তু উপনিবেশ স্থাপনের সময় তুলনামূলক দরিদ্র অঞ্চলগুলোয় উপনিবেশকারীরা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছে। আর এই প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে সে অঞ্চলগুলোয় সমৃদ্ধি এসেছে। অর্থাৎ উপনিবেশকারীদের কল্যাণে দরিদ্র অঞ্চলে সমৃদ্ধি এসেছে। কিন্তু সমৃদ্ধ অঞ্চলে যেহেতু উপনিবেশকারীরা প্রতিষ্ঠান গঠনে অবদান রাখতে বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তাই সেই অঞ্চলগুলো টেকসই উন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। প্রকারান্তরে বলা হচ্ছে, ঔপনিবেশিক দেশগুলোয় টেকসই অর্থনৈতিক উন্নতিতে উপনিবেশকারীদের বিশেষ অবদান রয়েছে।
এ ক্ষেত্রে নোবেল কমিটি নোবেল বিজয়ীদের দেওয়া একটি উদাহরণকে কাজে লাগিয়েছে। স্প্যানিশ উপনিবেশের দুটি অঞ্চল—আমেরিকা ও মেক্সিকো। দেখা যাচ্ছে, উপনিবেশের সময়ে কম উন্নত আমেরিকা অংশ একই সময়ের বেশি উন্নত মেক্সিকো অংশের চেয়ে বর্তমানে বেশি সমৃদ্ধ। এতে অবদান নাকি ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠানের। বাস্তবে কি সেটা সত্য?
এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ উপনিবেশের সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের কয়েকটি অঞ্চলের উদাহরণ দেওয়া যাক। ব্রিটিশরা কলকাতায় তাদের রাজধানী স্থাপন করেছিল। ১৯১১ সালে ব্রিটিশরা তাদের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করে। এ সময় দিল্লি কলকাতার চেয়ে উন্নত। কিন্তু এর সঙ্গে ব্রিটিশরাজের তথাকথিত অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠানের তেমন কোনো ভূমিকা লক্ষ করা যায় না।
অন্যদিকে ১৯০৫ সালের পর পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকা ব্রিটিশরাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও শিক্ষাকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এখন আমরা যদি ঢাকা, কলকাতা ও দিল্লির মধ্যে তুলনা করি, তবে তথাকথিত ঔপনিবেশিক অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠানের অবদান কোথাও পরিলক্ষিত হয় না। প্রকৃতপক্ষে উপনিবেশ–পরবর্তী দুটি দেশের ভিন্ন ভিন্ন নীতি নির্ধারণ এই অঞ্চলগুলোর সমৃদ্ধি বা অবনতির জন্য দায়ী।
তবে তাই বলে বিজয়ীদের নোবেল পাওয়া অযৌক্তিক হয়ে যায় না। ‘ধনী দেশগুলো কেন ধনী, আর গরিব দেশগুলো কেন গরিব’, তার ওপর তাদের গবেষণা এবং এর ফলাফল অত্যন্ত চমকপ্রদ। একটা দেশের সমৃদ্ধির জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাকে তাঁরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। আর অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান মানে হলো রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় সব শ্রেণির লোককে অন্তর্ভুক্ত করা। সমাজের সব শ্রেণি-পেশার লোকের জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা।
নোবেল বিজয়ীরা তাঁদের গবেষণায় আরও পেয়েছেন, ‘নিষ্কাশনমূলক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান’ (এক্সট্রাকটিভ ইকোনমিক ইনস্টিটিউশনস) সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে সমাজের অভিজাত শ্রেণিকে আরও অভিজাত বানায়। এতে একশ্রেণির লোকের সমৃদ্ধি এলেও পুরো সমাজ বঞ্চিত হয় এবং দরিদ্র থাকে।
এ ধারণা বাংলাদেশের জন্যও প্রযোজ্য। বাংলাদেশেও একশ্রেণির মানুষের জন্যই সমাজের সব সুযোগ–সুবিধা তৈরি হয়। আর সেই শ্রেণি হলো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লোকজন। যেমনটি নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ রবিনসন বলেন, উন্নতির জন্য দরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা বণ্টন। সেটি বাংলাদেশে হয়নি। এখানে ক্ষমতার একচেটিয়াকরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও টেকসই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হওয়া দরকার।
ড. নুসরাতে আজীজ অধ্যাপক, আলগমা ইউনিভার্সিটি, কানাডা