বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে গিয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। মর্মান্তিক এই হত্যাকাণ্ডের পর কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশের গণমাধ্যম প্রতিদিনই সংবাদ পরিবেশন করে আসছে। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জন-আগ্রহ থাকার কারণে ‘সংবাদমূল্যের’ বিবেচনায় ফলোআপ সংবাদ পরিবেশন তাই সংবাদমাধ্যমগুলোর নিয়মতান্ত্রিক বিষয় হয়ে উঠেছে।
চারদিকে দুর্নীতি-অনিয়ম, ধর্ষণ, খুনোখুনির খবর প্রতিদিনই আমাদের মতো পাঠকদের হজম করতে হলেও সাম্প্রতিক সময়ের এই আলোচিত হত্যাকাণ্ডের খবর পরিবেশন নিয়ে কিছুটা হলেও তিক্ততা অনুভব করেছি।
প্রথমে ভেবেছিলাম, বিষয়টি হয়তো ‘স্পর্শকাতর’ হওয়ায় সংবাদমাধ্যমগুলো দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মুখনিঃসৃত বাণীই পরিবেশন করেছে কিন্তু দিনে দিনে যে অবস্থায় খবরগুলো আমাদের চোখের সামনে আসছে, তাতে সাংবাদিকতার যে ‘মাপকাঠি’ থাকার কথা, তা ভেঙে পড়ছে বৈকি।
এই লেখাটি যখন লিখছি (জুন ১২), তখন বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনে আনোয়ারুল আজীম হত্যাকাণ্ডের যে ‘এক্সক্লুসিভ’ সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে, তা দেখার পর অনেকটাই মানসিকভাবে অসুস্থ অনুভব করছি।
আমার মতো হাজারো মানুষ এসব দেখার পর কিছুটা হলেও বিচলিত হবেন আর হওয়াই স্বাভাবিক। তবে এই লেখার উদ্দেশ্য কোনো সংবাদমাধ্যমকে কটাক্ষ বা হেয় করার জন্য নয়। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে এ ধরনের ঘটনা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে ঠিক কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, তা থেকে ভবিষ্যতে পরিত্রাণের জন্য এই লেখার অবতারণা।
ঘটনার শুরু গত মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে। ঝিনাইদহের এক সংসদ সদস্য ভারতে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে যাওয়ার পর নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো এ-সংক্রান্ত খবর বেশ গুরুত্বের সঙ্গে পরিবেশন করে আসছিল।
২২ মে আনোয়ারুল আজীম খুন হয়েছেন বলে সংবাদমাধ্যমে পুলিশ জানানোর পর নানার ধরনের বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ পরিবেশনের পর ঢাকায় পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) প্রধান সংবাদ সম্মেলনে হত্যাকাণ্ডটি ঠিক কীভাবে ঘটেছিল, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি সরল মনে খুনিদের বক্তব্য টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে সরাসরি দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু এ ধরনের কথাবার্তা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘নৃশংস’ শব্দটির মাধ্যমে যে কতভাবে ‘নৃশংসতা’ তুলে ধরা সম্ভব হতো, তা তিনি বিবেচনায় নেননি। যদিও তিনি ‘নৃশংস’ শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন, তবে সংসদ সদস্য হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন যা ছিল একেবারেই অপ্রয়োজনীয়।
‘লাইভ’ কালচার সাংবাদিকতার কারণে সংবাদমাধ্যমের ‘গেটওয়ে’ নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এসব বাক্য সমাজে অস্থিরতার অনুষঙ্গ হিসেবে দাঁড়ায়। পরের দিন আমাদের প্রায় সব গণমাধ্যম ‘পুলিশের’ ওই বক্তব্যকেই আনকাটভাবে পরিবেশন করেছে, যা সাংবাদিকতার ‘ব্যাকরণে’ কখনোই যায় না।
এই হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে ভয়ানক খবরগুলোর মধ্যে যেসব ভিডিও ফুটেজ ‘পাবলিকলি’ এসেছে, তার মধ্যে বীভৎস ছিল কলকাতায় সেপটিক ট্যাংকে উদ্ধার হওয়া ‘সন্দেহভাজন’ ব্যক্তির দেহাবশেষ। সেপটিক ট্যাংক থেকে কীভাবে উদ্ধার হলো, দেহাবশেষ দেখতে কেমন, কত কেজি পাওয়া গেছে—উদ্ভূত এসব প্রশ্ন যেমন সাংবাদিকেরা করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের ‘নারকীয় সংবাদ’ পরিবেশন করেছেন, তেমনি ভিডিও ফুটেজে ‘অপ্রত্যাশিতভাবে’ ‘টুকরো’গুলো দেখিয়ে সাংবাদিকতার মানদণ্ড নিয়ে মূল ধারার কিছু সংবাদমাধ্যমই ‘প্রশ্ন’ তৈরি করে দিয়েছে।
আমি ঠিক জানি না, এসব সংবাদের ঠিক কতটুকু ‘সংবাদমূল্য’ ছিল, তবে ভিউজ অ্যান্ড ক্লিক কিংবা টিআরপির নেশায় আমরা সাংবাদিকতাকে কতটা নিচে নামিয়ে ফেলছি, তা এই সংসদ সদস্যের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও উন্মোচিত হলো।
প্রতিযোগিতার নেশায় সংবাদমাধ্যমগুলোর মৌলিক নীতি-নৈতিকতাকে গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে। ‘উলঙ্গ’ ছবি সেন্সরের মধ্যে পড়তে পারে, তাই ব্লার করে প্রকাশ করার নিয়ম থাকলেও গণমাধ্যমে চলে যাওয়া পুলিশের হাতে আটক ব্যক্তির বক্তব্য, খুনের বিবরণকে ‘সেন্সরের’ মধ্যে পড়ে কি না, তা জানার প্রয়োজনও বটে। বীভৎস বর্ণনা যে ‘উলঙ্গ’ ছবির চেয়ে ভয়ানক ক্ষতিকর হতে পারে, তার বোধগম্যতা আমাদের থাকা চাই।
আমরা ভুলে যাই, আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলো আমাদের ছোট বাচ্চারা দেখে, পড়ে। এসব নেতিবাচক সংবাদের অমার্জিত বর্ণনা আমাদের মনে একধরনের ট্রমা সৃষ্টি করে। শিশুদের মনে যে দাগ কাটে, সেটার স্থায়িত্ব দীর্ঘায়িত হয় বটে।
আপনি যখন আপনার শিশুকে এসব ‘নারকীয়’ বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত করবেন, তখন স্বাভাবিকভাবে মস্তিষ্কে অ্যাড্রেনালিনের অস্বাভাবিক ক্ষরণ হবে, নিউরোট্রান্সমিটারগুলোর মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হবে। যা পরবর্তী সময়ে তাঁদের সামাজিক অবক্ষয় কিংবা নৃশংসতায় প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে উসকানি দেয়।
দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা ঠিক কীভাবে কতটুকু তথ্য গণমাধ্যমের মাধ্যমে জনগণকে জানাবে, তার যেমন মাপকাঠি থাকা উচিত, তেমনি কোনো শব্দ চয়ন সমাজ ও রাষ্ট্রে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারে, সেই বিষয়ে দীক্ষা থাকা বাঞ্ছনীয়। এমনিতে আমরা একধরনের অস্থিরতার মধ্য দিয়ে সময় পার করছি। সেখানে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা হয়, এমন খবর পড়া কিংবা দেখার পর আমাদের মানবিকতায় যে আঘাত হানছে, তা বোঝার সক্ষমতা অবশ্যই সবার থাকা উচিত।
দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গর্জে ওঠা ‘কিশোর গ্যাং’ বিস্তারে এ ধরনের খবরগুলো উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। পৃথিবীর অনেক দেশেই ব্যক্তিগত ‘পিস্তল পাবলিকলি প্রদর্শনী’ যেমন নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তেমনি অনলাইন কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর ব্যবহার খর্বিত করা হয়েছে। আবার রক্তের ছবি, বীভৎস চেহারার খুন, দেহাবশেষ প্রকাশেও গণমাধ্যমের একাডেমিক নীতি রয়েছে।
বহুচর্চিত এসব বিষয় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে তফাত তৈরির সুযোগ দেয়। মূলত সমাজব্যবস্থাকে শৃঙ্খল রাখতে এসব নিয়ম থাকলেও আমাদের দেশে ক্রমেই এই চর্চা থেকে গণমাধ্যমগুলো সরে আসছে মূলত ক্লিক-বাইট সুবিধার লোভে। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক এই প্রতিযোগিতায় সাংবাদিকতা টিকে থাকার যে লড়াই চলছে, সেখানে মূলধারার গণমাধ্যমগুলো ‘ইলজার্নালিজমে’ ধাবিত হলে আমাদের সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা ঠিক কীভাবে কতটুকু তথ্য গণমাধ্যমের মাধ্যমে জনগণকে জানাবে, তার যেমন মাপকাঠি থাকা উচিত, তেমনি কোনো শব্দ চয়ন সমাজ ও রাষ্ট্রে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারে, সেই বিষয়ে দীক্ষা থাকা বাঞ্ছনীয়।
এমনিতে আমরা একধরনের অস্থিরতার মধ্য দিয়ে সময় পার করছি। সেখানে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা হয়, এমন খবর পড়া কিংবা দেখার পর আমাদের মানবিকতায় যে আঘাত হানছে, তা বোঝার সক্ষমতা অবশ্যই সবার থাকা উচিত।
আমাদের ঠিক করতে হবে, আমরা কোনো সংবাদ পরিবেশন করব আর কোনটি করব না। হ্যাঁ, এ কথা সত্য, ‘দায়িত্বশীল’ ব্যক্তিদের বক্তব্য ‘হুবহু’ দেওয়া উচিত, তবে আমরা তো এই গণমাধ্যমেই আঞ্চলিক বক্তব্যগুলোকে ‘চলিত’ ভাষায় লিখছি তো নাকি?
রংপুরের কৃষক কিংবা ভ্যানচালকের বক্তব্য কিংবা নোয়াখালী, ফেনীর কোনো দোকানদারের বক্তব্য পরিবেশনে চলিত ভাষায় রূপান্তর করা হয় মূলত সব ধরনের পাঠককে বোঝানোর জন্য। তেমনি আমরা দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মুখ থেকে ‘অশ্রাব্য’ শব্দগুলোকে কাট করে প্রকাশ করি।
তাহলে সংসদ সদস্যের এই খবর প্রকাশে সংবাদমাধ্যমগুলোকে কেন দায়িত্বশীল ভূমিকায় রাখল না? টুকরা টুকরা মাংসকে কেন ‘দেহাবশেষ’ লিখতে পারছে না? কেন ম্যানহোলের নোংরা ফুটেজ গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে?
সমাজ বা রাষ্ট্র গঠনে গণমাধ্যমের যে একটি বড় দায়িত্ব, সেটি ভুলে গেলে চলবে না। গণমাধ্যমই একটি দেশকে সঠিক নিশানা দিতে পারে। কোন শব্দ, বাক্য সমাজে ‘বিশৃঙ্খলা’ তৈরি করতে পারে, তা যেমন সংবাদসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানতে হবে, তেমনি প্রতিযোগিতার নেশায় গণমাধ্যমকে ‘পাবলিক ডোমেন’ মনে করা উচিত হবে না।
আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষ এখন রুচিশীল সংবাদপত্র খোঁজে, পড়ে। সব কটি যদি একই কাতারে চলে যায়, তাহলে সাধারণ সচেতন পাঠক-দর্শকদের ঠিকানা কোথায় হবে শুনি? সম্পাদকীয় নীতি ঠিক কোনটি হবে, তা যেমন প্রতিটি সংবাদপত্রের আলাদা আলাদা বিধান থাকে, তেমনি মৌলিক সংবাদ পরিবেশনেও ‘সর্বজনীন বিধান’ থাকা আবশ্যিক। বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতে আমাদের গণমাধ্যমগুলো আরও বেশি দায়িত্বশীল ও রুচিশীলতার পরিচয় দেবে।
ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: [email protected]