ভণিতা
নববর্ষ উৎসবকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিভিন্ন নামে অভিহিত করে থাকে। এই উৎসবটি মারমাদের কাছে ‘সাংগ্রাইং’, চাকমাদের কাছে ‘বিজু’ এবং ত্রিপুরাদের কাছে ‘বৈসু’ নামে পরিচিত।
আবার ম্রো জনগোষ্ঠীর কাছে এটি ‘চাংক্রান’, চাক জনগোষ্ঠীর কাছে ‘সাংগ্রাইং’, খুমী জনগোষ্ঠীর কাছে ‘সাংক্রাইং’, খেয়াং জনগোষ্ঠীর কাছে ‘সাংরান’ এবং তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর কাছে ‘বিষু’ নামে পরিচিত।
আবার বাংলা পঞ্জিকায় এই সময়টিকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘মহা বিষুব সংক্রান্তি’ হিসেবে। আমরা ধরে নিতে পারি, আদিবাসীদের উপরোক্ত বিভিন্ন শব্দাবলির উৎপত্তি ঘটেছে এই ‘বিষুব সংক্রান্তি’ শব্দদ্বয় থেকে।
নববর্ষ উৎসবের পরিব্যাপ্তি ও বিশ্বজনীনতা
পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই উৎসব উদযাপনের রেওয়াজ রয়েছে। বাংলাদেশের বাঙালি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ‘চৈত্র পরব’ বা ‘বিয়ু পরব’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশ ও মায়ানমারের রাখাইন জনগোষ্ঠীর কাছে এটি পরিচিত ‘সাংগ্রাইং’ হিসেবে। কমলগঞ্জের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের কাছে এটি ‘বিষু’ নামে পরিচিত। ভারতের হিমাচল প্রদেশ ও হিমালয়ের প্রায় সবক’টি রাজ্যে বিষুব সংক্রান্তি ‘বিষু’ বা ‘বৃষু’ নামে পরিচিত।
হিমালয়ের চম্বা (প্রাচীন নাম চম্বা নগরী) ও কিন্নৌর অঞ্চলের আদিবাসীরা ‘বিষু’ পালন করেন বর্ষবরণ উৎসব হিসেবে। নেপালেও এই উৎসবটিকে বলা হয় ‘বিষু’ উৎসব। ভারতের আসামে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী ‘স’ বা ‘ষ’-কে উচ্চারণ করে ‘হ’ হিসেবে। একারণে অহমীয়াদের কাছে ‘বিষু’র উচ্চারণটি হয়ে গেছে ‘বিহু’। আসামের প্রায় প্রতিটি জনগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব বিষু বা বিহু নৃত্য। দেওরী সম্প্রদায় মনে করে বিষু শব্দটি এসেছে তাদের ভাষা থেকে। তাদের ভাষায় ‘বি’ মানে চরম, ‘ষু’ মানে আনন্দ। তাদের কাছে ‘বিষু’ হলো চরম আনন্দের উৎসব। আসামের বোড়ো সম্প্রদায়ের কাছে এই নববর্ষের উৎসবটি পরিচিত ‘বৈশাগু’ হিসেবে, যা ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’ শব্দেরই আরেকটি রূপ।
খ্রিস্টীয় প্রথম-দ্বিতীয় শতাব্দী বা তারও আগে ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃতি পরিব্যাপ্ত হয়েছিল দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায়। অন্যান্য অনেক সাংস্কৃতিক উপাদানের সাথে বিষুব সংক্রান্তিও চলে গেল সেখানে। খ্রিস্টীয় ও ইসলামী প্রভাব পড়েনি এমন দেশ, যেমন মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশে এই উৎসব পালিত হয় বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণ উৎসব হিসেবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এটি পরিচিতি পেয়েছে ‘সংক্রান্তি’ বা ‘সংক্রান্ত’ হিসেবে। থাইল্যান্ডে এটি ‘সংক্রান’ এবং মায়ানমারে ‘থিংগিয়ান’ হিসেবে পরিচিত, যা সংস্কৃত শব্দ ‘সংক্রান্ত’ থেকে এসেছে।
মূলত ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এপ্রিলের মাঝামাঝি এই বর্ষবরণ উৎসব পালিত হয়ে আসছে স্মরণাতীতকাল থেকে। এ থেকে আমরা বলতে পারি, এই উৎসবটি একটি বিশ্বজনীন বা আন্তর্জাতিক উৎসব।
দেবলোকে দ্বৈরথ: একটি পৌরাণিক আখ্যান
এই উৎসবের উৎপত্তি নিয়ে একটি অতিকথা বা মিথ প্রচলিত রয়েছে। একদিন স্বর্গরাজ্যের দেবরাজ ইন্দ্র ও আসীব্রহ্মা নামক এক দেবতা জ্যোতিষশাস্ত্রের একটি গাণিতিক সমস্যার সমাধানের উপায় নিয়ে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন। উদ্ভূত বিতর্কের সমাধান করতে না পেরে তাঁরা দু’জনে মিলে ঠিক করলেন যে, মর্ত্যলোকে ‘কওয়ালমইং’ নামক একজন জ্ঞানী ঋষির কাছে গিয়ে এই বিতর্কের মীমাংসা করবেন। ঋষি যা সমাধান দেবেন তা-ই তাঁরা মেনে নেবেন। তাঁদের মধ্যে স্থির হলো যে, যিনি জিতবেন তিনি পরাজিতের মাথা তরবারি দিয়ে কেটে ফেলবেন।
এরপর মর্ত্যে এসে যখন তাঁরা ঋষির কাছে বিষয়টি খুলে বললেন, তখন ঋষি ইন্দ্রের মতটিকেই সঠিক বলে রায় দিলেন। ফলে দেবরাজ ইন্দ্র আসীব্রহ্মার মাথা তরবারি দিয়ে কেটে ফেললেন। কিন্তু আসীব্রহ্মা ছিলেন একজন শক্তিশালী দেবতা। যদি তাঁর ছিন্ন মুণ্ড সাগরে ফেলে দেওয়া হয় তাহলে সাগর শুকিয়ে যাবে। আর যদি মাটিতে ফেলা হয় তাহলে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। তাই তার ছিন্ন মুণ্ডটি বহনের জন্য সাতজন দেবীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সাতজন দেবী পালাক্রমে সেই মুণ্ডটি কোলে করে বহন করতে থাকে। সাতজন দেবীর নাম যথাক্রমে নন্দা, কন্যা,ধ্বংসী, ঘোর, মহোরাকা, প্রোক্কা ও হ্রস্বকা।
এরপর মস্তকবিহীন আসীব্রহ্মার দেহটির সাথে মহাপিঙ্গল নামক একটি হাতির মাথা কেটে জোড়া লাগিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে মহাপিন্নেঃ বা গণেশ-এর উৎপত্তি ঘটে। আসীব্রহ্মার ছিন্ন মুণ্ড সাতজন দেবীর কোলে থেকে যায়। একজনের কাছ থেকে অন্যজনের কোলে নেওয়ার সময় সেই মুণ্ড থেকে প্রচুর পরিমাণ পচা-গলা রক্ত স্বর্গ থেকে মর্ত্যলোকে এসে পড়ে। এতে মর্ত্যলোক অপবিত্র হয়ে যায়। তাই এই দিনে দেবরাজ ইন্দ্র দেব-দেবীদের নিয়ে সদলবলে মর্ত্যের মানব-মানবীদের সাথে মিলেমিশে ধোয়া-মোছার কাজে সহযোগিতা করেন। এই দিনে যেমন সকলে পরিশুদ্ধ ও পবিত্র হয় ঠিক তেমনি স্বর্গলোকবাসী এবং মর্ত্যবাসীদের মধ্যেও মিলন ঘটে। (সূত্র: লেখক: উ নিগ্রোধ, গ্রন্থ: বেদা উইজ্জা কোঃজং তোওয়েঃ/বেদ-বিদ্যা, নয়খণ্ড, ১২৯২ বর্মী/ ১৯৩১ খ্রি:, মিথিলা, মায়ানমার)।
বিষুব সংক্রান্তি: সৌরবর্ষের বিদায় ও বরণ
অতি প্রাচীনকালে সন গণনার ক্ষেত্রে চান্দ্রমাস ব্যবহৃত হতো। সাধারণত পূর্ণিমান্তে যে যে নক্ষত্রের সংযোগ দেখা যায়, সেইসব নক্ষত্রের নাম অনুযায়ী চান্দ্রমাসের নামকরণ করা হয়েছিল। বর্তমান সময়ে ভারতে প্রচলিত সংবৎ, ফসলি ও হিজরি সন চান্দ্রবর্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এ থেকে বোঝা যায় যে, প্রথমে চন্দ্রের স্থিতি অনুসারেই মাসের নামকরণ করা হয়েছিল। চান্দ্রমাস শুক্লা বা কৃষ্ণাপ্রতিপদ তিথি হতে আরম্ভ হয়ে অমাবস্যা বা পূর্ণিমান্তে সমাপ্ত হয়। চান্দ্রমাসে অন্যান্য দিন অপেক্ষা পূর্ণিমার দিন সহজে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। এ কারণে সাধারণত যে যে নক্ষত্রে পূর্ণিমার অন্ত হয় সেসব নক্ষত্রের নামানুসারে চান্দ্রমাসের নাম স্থিরীকৃত হয়েছিল। যে চান্দ্রমাসে সাধারণত বিশাখা নক্ষত্রে পূর্ণিমার অন্ত হয়, তাকে চান্দ্রবৈশাখ বলে। সূর্যের মেষরাশি স্থিতিকালেই এটির সম্ভাবনা। এজন্য সূর্যের মেষরাশি স্থিতিকাল সৌর-বৈশাখ নামে অভিহিত।
বর্তমানে বিভিন্ন কারণে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে চান্দ্রমাসের পরিবর্তে সৌরমাস ব্যবহৃত হচ্ছে। সূর্যের একেকটি রাশিস্থিতিকাল একেকটি সৌরমাস এবং সূর্যের বারটি রাশির সময়কাল হচ্ছে এক সৌরবছর। সৌরবর্ষের গতি প্রতি ১৫ দিনে আহ্নিক ও প্রতি ৩৬৫ দিনে বার্ষিক গতি সম্পন্ন হয়। অন্যদিকে চান্দ্রবর্ষ প্রতি ৩৬০ দিনে বার্ষিক গতি সম্পন্ন করে। একটি বিষয় হলো, সৌরমাসগুলির নাম তৎকালব্যাপী চান্দ্রমাসের নামানুসারেই স্থিরীকৃত হয়েছে। সৌরবর্ষের সাথে চান্দ্রবর্ষের মাসগুলির নাম এক হলেও বার্ষিক গতি ও রাশি গতি নিরূপণে সৌর ও চান্দ্রবর্ষ নিরূপণ করা যায়। মূলত বিষুব সংক্রান্তি হচ্ছে পুরাতন সৌরবর্ষের বিদায় ও নতুন সৌরবর্ষের আগমন।
এই কারণে দেখা যায় যে, মারমাদের (বর্মী ও আরাকানী) ব্যবহৃত চান্দ্রমাস ও চান্দ্রবর্ষের পঞ্জিকা অনুসারে বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিনে এই নববর্ষের উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয় না। মারমা পঞ্জিকা অনুসারে বছরের প্রথম মাস হচ্ছে ‘তাইংখুং’। খ্রিস্টীয় ২০২৫ সাল অর্থাৎ এ বছরের মার্চ মাসের ২৯ তারিখ হচ্ছে ‘তাইংখুং’ মাসের প্রথম দিন। এই দিনটিকে নববর্ষের প্রথমদিন হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।
এ বছরের ‘সাংগ্রাইং’ পালিত হবে ১৩ এপ্রিল থেকে ১৬ এপ্রিল। ১৩ এপ্রিল মারমাদের ব্যবহৃত পঞ্জিকা অনুসারে ‘তাইংখুং' মাসের কৃষ্ণপক্ষের প্রথম দিন। চারদিন ‘সাংগ্রাইং’ উৎসব উদযাপনের পর ১৭ এপ্রিল থেকে নতুন বছর গণনা শুরু হবে; অর্থাৎ নতুন বছরের (মারমা সন ১৩৮৭) প্রথমদিন হবে ১৭ এপ্রিল ২০২৫। আবার বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ৩০ চৈত্র ও ১লা বৈশাখ বিষুব সংক্রান্তির দিন বলে এ সময় নববর্ষ পর্ব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সাধারণত মনে করা হয় যে, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র ১২টি মাস এবং রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি ৭টি দিনের সপ্তাহ গণনা হচ্ছে বাংলা বর্ষীয় গণনা।
প্রকৃতপক্ষে, বাংলা সন প্রচলনের হাজার বছর আগে শকাব্দ ও সংবৎ পঞ্জিকায় এসব মাস ও সপ্তাহের নাম ছিল। সনাতনী বৈদিক মুনি-ঋষিরা এসব বৎসর, মাস, দিন, দণ্ড ও পলের প্রবর্তক। মোগল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে বাংলা পঞ্জিকায় বৈদিক মাস, দিন, তিথি সন্নিবেশিত করে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছিল। মূলত বিষুব সংক্রান্তি রাশিচক্রের সাথেই বেশি সঙ্গতিপূর্ণ। এটি মীন রাশি থেকে মেষ রাশিতে সংক্রমণের সময়টাকেই বোঝানো হয়ে থাকে।
মৈত্রী পানি বর্ষণ: নিরবিচ্ছিন্ন বিশ্ব মানবতা নির্মাণের যোগসূত্র
বিষুব সংক্রান্তির দিনে বিশ্বব্যাপী থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কিছু নির্দিষ্ট ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে দেখা যায়। থাইল্যান্ড, মায়ানমার, কম্বোডিয়া, লাওস প্রভৃতি দেশে এ সব আচার-অনুষ্ঠানের কিছু সাধারণ চিত্র রয়েছে। যেমন বুদ্ধমূর্তির স্নান করানো, মন্দির পরিষ্কার করা, বয়োবৃদ্ধদের মাথার চুল ধুয়ে দেওয়া, মন্দিরে প্রার্থনা করা, শীল পালন করা, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিশেষ খাবার দান করা প্রভৃতি। বিশ্বব্যাপী বিষুব সংক্রান্তির একটি প্রধান আচার বা অনুষ্ঠান হচ্ছে ‘মৈত্রী পানি বর্ষণ’।
পালি ভাষার একটি শ্লোকে বলা হয়েছে, 'রবি সংক্রান্ত পুন্নমে, য়ো সীরঞ্চ অনীহতা, সত্তমন্তরেচরোগা, দুক্ষ ভাগাসদাভবে'; অর্থাৎ রবি সংক্রান্তি পূর্ণ হবার সময় যে ব্যক্তি শির জল দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে না, তাকে সাতদিন হতে সাতমাসের মধ্যে সর্বদা রোগ-ব্যাধি ও দুঃখ-বেদনা ভোগ করতে হবে। সংক্রান্তিতে পালনীয় আচার আচরণ সম্পর্কে পালি ভাষার আরেকটি শ্লোকে বলা হয়েছে, সংক্রান্তির দিনে রোদন বা অশ্রু মোচন, মৈথুন বা সঙ্গম, মাংস ভক্ষণ, মদ্যপান, ক্রোধান্বিত হওয়া, রক্তপাত ঘটানো, তৈল লেপন, বৃক্ষ ছেদন, ক্রয় ও বিক্রয়-এই দশ প্রকার কাজ পরিহার্য I (সূত্র: লেখক উ নিগ্রোধ, গ্রন্থ: বেদা উইজ্জা কোঃজং তোওয়েঃ/বেদ-বিদ্যা, নয়খণ্ড, ১২৯২ বর্মী/ ১৯৩১ খ্রি:, মিথিলা, মায়ানমার)।
ইতোপূর্বে উল্লেখিত পৌরাণিক কাহিনীর বর্ণনা অনুসারে দেবরাজ ইন্দ্র কর্তৃক কেটে ফেলা আসীব্রহ্মার ছিন্ন মুণ্ড সাতজন দেবী বহন করে চলেছে, সেই ছিন্ন মুণ্ড থেকে বিষুব সংক্রান্তির সময় যে পচাগলা রক্ত মর্ত্যলোকে পড়ে তাতে পুরো পৃথিবী দুষিত হয়ে যায়। যার দরুন বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপদ-আপদ, রোগ-ব্যাধি ও অমঙ্গল দেখা দেয়। এ কারণে মর্ত্যের লোকজন জল দিয়ে ধুয়ে সবকিছু আবার পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন করে নেয়। বিষুব সংক্রান্তির সময় মাথার চুল ধুয়ে পরিষ্কার করাটা একটি অপরিহার্য রীতি হয়ে দাঁড়ায়। মূলত এই সময় একে অপরের মাথায় জল ঢেলে পরিশুদ্ধ করার রীতিটাই কালক্রমে মৈত্রী পানি বর্ষণের রীতিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ১২০ মিলিয়নেরও অধিক লোক নববর্ষে এই রীতিটি পালন করে থাকে।
এটা বিশ্বাস করা হয় যে, সংক্রান্তির প্রথম দিনে দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গ রাজ্য থেকে মর্ত্যে অবতরণ করেন প্রতিটি মানুষের পাপ-পূণ্য তাঁর ‘শোয়ে পরবইক্’ (স্বর্ণ গ্রন্থ)-তে লিপিবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে, যাতে তিনি নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে পারেন। ঠিক অবতরণের সময় অনুযায়ী পানি বর্ষণের রীতিটি উদযাপিত হয়ে থাকে। দ্বিতীয় দিনটি ইন্দ্র তার সোনার গ্রন্থ নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকেন। তৃতীয় দিনে তিনি আবার স্বর্গরাজ্যের দিকে প্রস্থান করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সময়ের দীর্ঘ পরিক্রমায় এ উৎসবটি ক্রমবর্ধমান হারে সামাজিক গুরুত্ব লাভ করেছে। মঙ্গল কামনা হচ্ছে এই উৎসবের মূল উপজীব্য বিষয়। এ উৎসবের আদর্শ হচ্ছে-সকলের প্রতি অহিংসা, সকলের জন্যে ভালোবাসা।
এ উৎসবে অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েরা মা-বাবা, বয়োজ্যেষ্ঠ ও বয়োবৃদ্ধদেরকে স্নান করা ও মাথার চুল ধোয়ার কাজে সহযোগিতা করে আন্তরিকতার সাথে। মৈত্রী পানি বর্ষণের উৎসবে বালক-বালিকারা পানি বর্ষণের মাধ্যমে আনন্দ-ফূর্তি করে থাকে। সারা পাড়া ঘুরে একে অপরের প্রতি পানি নিক্ষেপ করে এবং নিজেরাও ভিজে যায়। এ সময় রাস্তার পাশে পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুদের হাত থেকে পথচারীরাও রেহাই পায় না।
সংক্রান্তির পানি বর্ষণ উৎসবের অন্তর্নিহিত গুরুত্ব হচ্ছে এটি নির্মল ও বিশুদ্ধ করার এক প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে সকল প্রকার অসুস্থতা, দুর্ভাগ্য এবং অশুভকে বিশোধন করে যা কিছু মঙ্গলময় ও পবিত্রতা দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করা হয়।
প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে মনে করা হয়, সারা বছর ধরে যে পাপ সঞ্চিত হয়েছে তা ধুয়ে-মুছে ফেলা সম্ভব এবং একে অপরের প্রতি নববর্ষের মৈত্রী পানি বর্ষণের মাধ্যমে নতুন বছরে শারীরিক ও আত্মিক উভয় দিক দিয়েই পবিত্র হয়ে ওঠা সম্ভব। এই বিশ্বাসের দ্বারা সকলে আনন্দিত হয় যে, শারীরিক ও আত্মিক দিক দিয়ে পরিশুদ্ধ হবার মাধ্যমে পরবর্তী বছরে তারা সম্পূর্ণ নিষ্পাপ হয়ে উঠবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে মারমা সমাজে বেশ উৎসবমুখর পরিবেশে মৈত্রী পানি বর্ষণের রীতি পালিত হয়। চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরাসহ অন্যান্য সমাজের ক্ষেত্রে মৈত্রী পানি বর্ষণের রূপটি প্রকাশ পায় বয়োবৃদ্ধদের স্নান করানোর মধ্য দিয়ে। তবে তরুণ-তরুণীদের একে অপরের প্রতি পানি নিক্ষেপের রীতিটি এক্ষেত্রে অনুপস্থিত। একমাত্র মারমা সমাজেই আনুষ্ঠানিকভাবে মৈত্রী পানি বর্ষণের রীতিটি পালন করা হয়।
এই অনুষ্ঠানটি মারমা ভাষায় ‘রি লঙঃ বোওয়েঃ’ নামে পরিচিত। এটি যুবক-যুবতিদের জন্য একটি ঐতিহ্যবাহী সামাজিক অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানের দ্বারা চেনা-অচেনা মারমা যুবক-যুবতিগণ পরস্পরের সান্নিধ্য ও নৈকট্য লাভ করে। ‘রি লঙঃ বোওয়েঃ’ অনুষ্ঠান যুবক-যুবতিদের মনে আনন্দ, আবেগ, শিহরণ ও আলোড়ন সৃষ্টি করে থাকে। মূলত মহা বিষুব সংক্রান্তির দিনে মৈত্রী পানি বর্ষণের রীতিটি একটি বিশ্বজনীন রূপ পেয়েছে।
বর্তমান অবাধ তথ্য প্রবাহ ও তথ্য প্রযুক্তির যুগে বিশ্বব্যাপী মৈত্রী পানি বর্ষণ উৎসব যেন এক নিরবচ্ছিন্ন বিশ্ব মানবতা নির্মাণে কাজ করে যাচ্ছে যোগসূত্র হিসেবে। ইতিমধ্যে আমরা মৈত্রী পানি বর্ষণের বিশ্বজনীন সাংস্কৃতিক রূপরেখা দেখতে পেয়েছি। অবশ্য এর মাঝে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় সাংস্কৃতিক রূপরেখার আপেক্ষিকতাও অনুভব করা যায়।
শেষ কথা
আমরা দেখেছি, অতীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিঘাতের কারণে ভারতীয় উপমহাদেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চল থেকে বিষুব সংক্রান্তির বিলুপ্তি ঘটেছিল। আর এই উৎসবটি বিদ্যমান রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চলে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। এরকমই একটি প্রান্তিক অঞ্চল হচ্ছে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম। এখানেও বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায়ের উৎসবটি টিকে আছে বিভিন্ন নাম নিয়ে। এই টিকে থাকা সংস্কৃতির অন্যতম একটি উপাদান হচ্ছে মৈত্রী পানি বর্ষণ অনুষ্ঠান।
আশঙ্কা জাগাটা অস্বাভাবিক নয় যে, বিভিন্ন অভিঘাতে এই অনুষ্ঠানও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে হারিয়ে যাবে একদিন অন্যান্য অনেক উপাদানের মতো যদি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদান টিকে থাকার মত বাস্তব ভিত্তি অনুপস্থিত থাকে। তাই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি সবাইকে মিলেমিশে নির্মাণ করতে হবে।
বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু, সাংক্রাই, চাংক্রান, সাংলান, পাতা-২০২৫ উপলক্ষে পাহাড়ের আদিবাসীরা উদযাপন করছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠান I রাঙামাটিতে অনুষ্ঠিত একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত পাহাড়ের সিংহ হৃদয় রাজা দেবাশীষ রায় বলেছিলেন, 'অভ্যুত্থান পরবর্তীকালে বাংলাদেশকে নতুন আঙ্গিতে গড়তে নানা ধরনের কর্মসূচী হাতে নিতে দেখা গেছে। দেশকে গণতান্ত্রিক ও জনপ্রতিনিধিত্বশীল করতে বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন হয়েছে। তবে কমিশনগুলো আমাদের নিরাশ করেছে।
আদিবাসীদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গ্রাহ্য করা হয়নি।' তিনি আরও বলেন, ‘আজকে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বৃহত্তর সামাজিক উৎসবগুলো পালন করতে যাচ্ছি। কিন্তু আমরা নিরাশ। তবে আমরা তরুণদের নিরাশ করতে পারি না। তারা তাদের স্বকীয়তাকে উদযাপন করুক, উপভোগ করুক এবং জাতির বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে পাক।’ (হিলভয়েসডটনেট)
অন্য দিকে সাবেক সংসদ সদস্য, আদিবাসী নেতা ঊষাতন তালুকদার বলেছিলেন, ‘প্রতিবছরের মতো এবারো পার্বত্য চট্টগ্রামে যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যতায় আদিবাসী জুম্মদের বৃহত্তর সামাজিক উৎসবগুলো পালিত হবে। প্রতিটি জায়গায় মানুষ নিজেদের মতো করে উদযাপন করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন বাস্তবতা থাকা সত্ত্বেও আদিবাসীরা নিজেদের স্বকীয় সংস্কৃতি, জীবনবোধ ও শেকড়কে আগলে ধরে বেঁচে আছে। ইতিহাসের পাতায় আদিবাসী জুম্মরা অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু তারা নিজেদের স্বকীয়তাবোধ বিসর্জন দেয়নি। তারা যদি নিজেদের মতো করে স্বতন্ত্রতা নিয়ে বাঁচতে চায় তাহলে দেশের বৃহৎ জাতিগোষ্ঠীর সমস্যা থাকার কথা না। আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় জীবনধারাকে স্বীকার করে নিলে, তাদের অধিকার দিয়ে দিলে দেশটা সুন্দর হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাষ্ট্র উদারতা দেখাতে পারছে না বিধায় পার্বত্য সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। চুক্তি বাস্তবায়ন হয়ে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সুরক্ষিত থাকবে এটা রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে। কাজেই, রাষ্ট্রের শুভবুদ্ধি উদয় হওয়া জরুরী।’ (হিলভয়েসডটনেট)
জুলাই গণ অভুত্থানের পরে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, এটাই ছিল প্রত্যাশিত I কিন্তু আদিবাসীরা তাদের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তি মূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাঙ্খিত প্রতিফলন এখনো দেখতে পায়নি। পানি হচ্ছে পরিশুদ্ধতা ও পবিত্রতার দ্যোতক। নববর্ষে পারস্পরিক মৈত্রী পানি বর্ষণের মাধ্যমে আগামী বছরে আদিবাসীদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের সকল না পাওয়ার বেদনা ও দুঃখ-যন্ত্রণা ধুয়ে-মুছে যাক এবং আদিবাসীরা তাদের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তি মূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা পাক-এই কামনাটুকু আমরা করতে পারি।
মিলিন্দ মারমা আদিবাসী অধিকারকর্মী
milinda.marma@gmail.com