হানিয়া যে কারণে ফিলিস্তিনি নেতাদের মধ্যে ভিন্ন ছিলেন

নব্বইয়ের দশকে মূলধারার রাজনীতিতে আসেন ইসমাইল হানিয়া।ছবি : রয়টার্স

প্রতীকীভাবে ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যু ২০০৪ সালে হামাসের প্রতিষ্ঠাতা ও আধ্যাত্মিক নেতা আহমেদ ইয়াসিনের হত্যাকাণ্ডের পর ফিলিস্তিনি প্রতিরোধী গোষ্ঠীর জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি।

যদিও এই ক্ষতি বিবেচনা করার মতো একটা বিষয়। কিন্তু ইসমাইল হানিয়া না থাকায় হামাস ধ্বংস হয়ে যাবে না। ফিলিস্তিনের ভেতরে ও বাইরে এ গোষ্ঠিটি তাদের একটা সামষ্টিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। তারা এমন একটা নেতৃত্ব কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখানে কোনো একজন নেতা যতই গুরুত্বপূর্ণ হোন না কেন, তিনি না থাকলেও সংগঠন কোনো সমস্যায় পড়বে না।

হামাস নেতাদের হত্যাকাণ্ডের ধরন একই ধরনের আর বারবার তার পুনরাবৃত্তিও ঘটে চলেছে। ইতিহাস বলে, নির্দিষ্ট কোনো নেতাকে হত্যার পর সাময়িকভাবে প্রতিরোধ আন্দোলন দুর্বল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হামাস তার অবস্থান ও জনপ্রিয়তা সংহত করে নিয়েছে। তরুণ নেতৃত্ব সংগঠনের হাল ধরেছে, সংগঠনকে পুনর্গঠিত করেছে। সমর্থক গোষ্ঠী বেড়েছে।

হামাস ও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীর উত্থানের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে ইসরায়েলি দখলদারি ও তাদের চলমান নৃশংসতা।

ইসরায়েল প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) ও ফাতাহর বিরুদ্ধে লড়াই করে। একসময় পিএলও ও ফাতাহকে নিরপেক্ষ করে ফেলে। এরপর হামাস ও ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। যুক্তরাজ্য ও কয়েকটি দেশ হামাসকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তকমা দিয়েছে। সমীকরণ সেই একই—সামরিক আগ্রাসনের গর্ভে প্রতিরোধের বীজ জন্ম নেয়।

২০০৬ সালে হানিয়া যখন ফিলিস্তিনি সরকারের প্রধান নির্বাচিত হন তখন তিনি আল-শাতি শরণার্থীশিবিরে তাঁর কুঁড়েঘর থেকে সরকারি বাসভবনে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তিনি সাধারণ মানুষ, শরণার্থী, গরিব মানুষ ও মূলধারার সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলেন।

আশির দশকে গাজা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন আন্দোলনকর্মী হিসেবে ইসমাইল হানিয়া তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ও ব্যক্তিত্ব বোঝার জন্য শুরুর সেই দিনগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

নব্বইয়ের দশকে মূলধারার রাজনীতিতে আসেন হানিয়া। এ সময় তিনি আরও কিছু হামাস সদস্যের সঙ্গে ফিলিস্তিনি আইনসভার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন অসলো চুক্তি বয়কট আন্দোলনের বিরোধিতা করেই এ সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

কিন্তু কালক্রমে হানিয়া হামাসের আনুষ্ঠানিক অবস্থান মেনে নেন। সেটা করতে গিয়ে তিনি একটা বিবৃতি দেন, যেখানে স্পষ্ট করে নেতা হয়ে ওঠার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ফুটে উঠেছিল। বিবৃতিতে তিনি বলেছিলেন, ‘অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানগুলোয় ভীষণ প্রয়োজনীয় সংস্কার শুরু করা এবং ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হামাস খুব ভালো একটা অবস্থানে রয়েছে...নির্বাচনে অংশগ্রহণটা ছিল আমাদের বিরাটসংখ্যক জনগণ, যারা সত্যিকারের সৎ বিকল্প খুঁজছে তাদের চাহিদায় সাড়া দেওয়া।’

হানিয়ার নেতৃত্বে এই ধারণাগুলো আরও অনেক পরিপক্ব হয়ে উঠেছিল পরিবর্তন ও সংস্কারের মঞ্চে। ২০০৬ সালের নির্বাচনে এ মঞ্চটি বিজয়ী হয়েছিল।

হানিয়া হামাসের মধ্যে তাঁর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। মধ্যপন্থী অবস্থানের কারণে ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা তৈরি হয়। তিনি সাধারণ মানুষের ভাষায় কথা বলতেন, খুব দক্ষ একজন বক্তা ও সংগঠক ছিলেন।

তিনি এটা প্রমাণ করেছিলেন, নির্বাচন হলে ফিলিস্তিনি ন্যাশনাল অথরিটির প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে তিনি পরাজিত করতে সক্ষম।

হামাস নেতৃত্বের একেবারে সম্মুখভাগে থাকা হানিয়াকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের অনেকেও শ্রদ্ধা করতেন। হামাসের জন্য প্রভাবশালী কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। ২০১৭ সালে তিনি হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোপ্রধান নির্বাচিত হন এবং গাজা উপত্যকার বাইরে তিনি চলে যান।

হানিয়ার গাজার বাইরে চলে যাওয়া এবং বিশেষ করে কাতার ও তুরস্কে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে হামাস ভেবেছিল, এটা ক্ষতির চেয়ে লাভ বেশি হবে। গাজা থেকে তাঁর বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনেকে সমালোচনা করেন। কিন্তু তিনি তাঁর মধ্যপ্রাচ্য ও বাইরের বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে একটা সম্পর্কের জাল তৈরি করতে সক্ষম হন। মরক্কো থেকে মালয়েশিয়া পর্যন্ত মুসলমান নেতারা তাঁকে স্বাগত জানান। ওমানে তাঁর সাম্প্রতিক সফরে তিনি সুলতান, সরকার ও জনগণের কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা পান।

অস্তিত্বের যুদ্ধ

হানিয়ার পরে হামাস ও ফিলিস্তিনি জনগণের সামনে কী অপেক্ষা করছে? হামাসের এখন প্রয়োজন হানিয়ার মতো ধীশক্তিসম্পন্ন নেতৃত্ব তৈরি করা। ইয়াসিনসহ ও অন্য নেতাদের হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাক্রমে তারা সেটাই করেছে।

ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য তারা ঐক্যের পক্ষের একজন মানুষকে হারিয়েছে। ফাতাহর সঙ্গে অভ্যন্তরীণ মিলমিশ প্রচেষ্টাকে গতিশীল করতে এবং ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য হানিয়ার মতো শক্তিশালী নেতৃত্ব দরকার।

হামাস ও ফিলিস্তিনি অন্য অনেক নেতার চেয়ে হানিয়ার ভিন্নতা হলো, তিনি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি দ্বারা পরিচালিত। হামাসের সঙ্গে তাঁর যে দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রা, তাতে তাঁর অভিজ্ঞতা যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে আবার কীভাবে বিভিন্ন গোষ্টীর মধ্যে সবচেয়ে সেরা পন্থায় ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা যায়, সে দক্ষতা তিনি অর্জন করেছিলেন।

হানিয়া ছিলেন ফিলিস্তিনি প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি মধ্যপন্থী আর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর ও আপসহীন। তাঁর পরবর্তী নেতৃত্বের (ইয়াহিয়া সিনওয়ার) মধ্যে এই ধারাবাহিকতা ছেদ পড়তে পারে।

হানিয়া ও হিজবুল্লাহ কমান্ডার ফুয়াদ শুকরকে হত্যার পর গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের চাপিয়ে দেওয়া গণহত্যামূলক যুদ্ধ আরও উন্মুক্ত হয়ে পড়বে। গাজা যুদ্ধ পরিসমাপ্তি ঘটাতে কিংবা হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের মুক্তির আলোচনার ক্ষেত্রে হানিয়া ছিলেন মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল আলোচনার সুযোগকেই হত্যা করেছে।

বাস্তবতা হলো, হানিয়াকে হত্যা করা হয়েছে তেহরানে। এই হত্যাকাণ্ডে ইরান কী ব্যবস্থা নেবে, তাতে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, তা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ও গোটা বিশ্ব উদ্বিগ্ন। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে গুন্ডামি চালিয়ে পুরো অঞ্চলকে অবিশ্বাস্য বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে ইসরায়েল।

  • খালেদ হরুব, কাতারের নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য অধ্যয়নের অধ্যাপক, ইংরেজি থেকে অনূদিত, মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া