স্বাস্থ্য খাত সংস্কার: চাই সেবার উন্নয়ন, বৈষম্যের নিরসন

৬ জানুয়ারি রংপুর এসেছিলেন স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের কয়েকজন সদস্য। রংপুর মেডিকেল কলেজের সম্মেলনকক্ষে সুধীজনের সঙ্গে তাঁরা মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন। মেডিকেল কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মচারী, সিভিল সার্জন, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা, গণমাধ্যমকর্মী, সংশ্লিষ্ট কাজের সরকারি ও এনজিও কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন। প্রধানত উপস্থিত ছিলেন চিকিৎসকগণ। আমিও উপস্থিত ছিলাম ওই মতবিনিময় সভায়। স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সৈয়দ আকরাম হোসেনের সঞ্চালনায় সভাপতিত্ব করেন আরেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সায়েবা আক্তার।

স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিবর্তন ও চাকরির বৈষম্য নিরসনে কেমন সংস্কার হওয়া প্রয়োজন, সে বিষয়ে উপস্থিত প্রায় ৪০ জন কথা বলেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জাহান আফরোজ লাকি ক্যানসার বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। তিনি এমন সংস্কার চেয়েছেন, যাতে জনবল ঠিকঠাক থাকে। জনবল–সংকটের কারণে যেন সেবা প্রদান বাধাগ্রস্ত না হয়। তিনি আরও বলেন ‘বিভাগে একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীও নেই। আমি সহকারী অধ্যাপক।

এই পদে থেকে কয়েক দিন পর অবসরে যাব। কেউ যেন আমাদের মতো কষ্ট নিয়ে পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে চাকরি শেষ না করেন।’ জনবল–সংকটের কথা আরও অনেকের মতো গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক শারমিন সুলতানাও বলছিলেন।

হাসপাতালে যন্ত্রপাতি কেনা নিয়ে একজন চিকিৎসক বলেন, ‘আমরা চাই যন্ত্রপাতি কেন্দ্রীয়ভাবে কেনা হোক। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যেন কেনা না হয়।’ মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এমন সংস্কার চাই, যাতে নতুন ব্যবস্থাপনায় কোনোরকম সিন্ডিকেট গড়ে উঠতে না পারে। কেউ যাতে কোনো অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি চাপিয়ে দিতে না পারেন।’

তিনি আরও বলেন, আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং প্রয়োজন, যাতে তাঁরা হৃদ্যতার সঙ্গে রোগীদের সেবা প্রদান করতে পারেন। রোগীদের জন্য সেন্ট্রাল ডেটা সিস্টেম করা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শাহী ফারজানা তাসনিম বলেন, মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য বিহেভিয়ার সায়েন্স পড়ানো প্রয়োজেন। ভারতে যাঁরা চিকিৎসা নিয়ে সন্তুষ্ট হন, তাঁরা কেবল তাঁদের আচরণের কারণে। চিকিৎসকদের আচরণগত পরিবর্তনের কথা বলেছেন কয়েকজন।

সিনিয়র নার্স নাজমা খাতুন করুণ গলায় বলছিলেন, ‘৩২ বছর ধরে একবারও পদোন্নতি পাইনি। বিএসসি নার্সদের জন্য নার্স ক্যাডার চালু করা প্রয়োজন। নার্সরা যে সেবা দেন, এগুলো ডিজিটাল করা প্রয়োজন।’

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই একটি মাত্র সুযোগ এসেছে স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানোর। এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার যাতে আপামর জনগণ সহজে লাভ করতে পারেন, সেই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতেই হবে।

সব সময় প্রচুর জনবল–সংকটের কারণেও সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। উদাহরণ হিসেবে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কথা বলা হয়। এটি ছিল ৫০০ বেডের। সেটি এক হাজার বেডে উন্নীত করা হলেও জনবল বৃদ্ধি করা হয়নি। আবার সেই হাসপাতালে রোগী ভর্তি থাকে আড়াই থেকে তিন হাজার জন। ৫০০ বেডের হাসপাতালের জন্য যে জনবল কাঠামো আছে, সেই জনবলের অর্ধেক পদ শূন্য।

বাস্তবে ২০০ রোগীর সেবা দিতে পারে, এমন জনবল দিয়ে চলছে প্রায় আড়াই-তিন হাজার রোগীর চিকিৎসা। হাসপাতালে রোগীদের স্থান সংকুলান হয় না। রংপুর অঞ্চলের প্রতি বরাদ্দে বৈষম্যের কথা উল্লেখ করেন রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান শামু বলেন, বরাদ্দবৈষম্য কমিয়ে রংপুর মেডিকেলের অবস্থা ভালো করতে হবে।

রংপুর মেডিকেল কলেজের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান শাহীন শাহ। নতুন মেডিকেল কলেজের যেগুলোতে মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি, সেখানে মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া না গেলে সেগুলো বন্ধ করার পরামর্শ দেন।

একই সঙ্গে যত্রতত্র মেডিকেল কলেজ খোলার অনুমতি না দেওয়ার অনুরোধ করেন। সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে তিনি স্বাস্থ্য শিক্ষাকে উন্নততর পর্যায়ে নেওয়ার কথা বলছেন। শাহীন শাহ আরও বলেন, মেডিকেল কলেজের বিভাগগুলোর আনুষঙ্গিক খরচের জন্য একটি টাকাও বরাদ্দ নেই। তাহলে বিভাগ চলবে কীভাবে?

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান বলেন, সাধারণ রোগীরা যেহেতু অনেক কিছু বোঝেন না, তাই হাসপাতালে এমন একটি শাখা থাকা প্রয়োজন, যেখানে কয়েকজন চিকিৎসক থাকবেন এবং তাঁরা রোগীদের কাউন্সিলিং করবেন, ওষুধ কীভাবে খাবেন, তা–ও বুঝিয়ে বলবেন।

স্বাস্থ্য বিভাগের রংপুরের বিভাগীয় পরিচালক চিকিৎসক হারুন-অর-রশীদ বলেন, দুর্গম এলাকায় যে চিকিৎসকগণ সেবা দেন, তাঁদের জন্য প্রণোদনা দিতে হবে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও পদের বাধ্যতামূলক বাসাভাড়া কাটা হয়। সে জন্য কেউ আরএমও হতে চান না। এই বাসাভাড়া কাটার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়ার পরামর্শ দেন।

অনেকেই বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে তাঁরা চিকিৎসককে দেখতে চান। পদোন্নতিবৈষম্য একবারেই দূর করার দাবি জানান। সেবা দেওয়ার পরিবেশ নিশ্চিত থাকে, এই ব্যবস্থা করার কথা বলেন। প্রয়োজনে স্বাস্থ্য পুলিশ রাখার সুপারিশ করেন।
মেডিকেল কলেজের অনেক বিভাগে একটিও অধ্যাপক পদ নেই। অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করা না হলে কি সেসব বিভাগের চিকিৎসকগণ অধ্যাপক হবেন না? চিকিৎসকদের ১ কিংবা ২ নম্বর গ্রেডে যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি। ৩ নম্বর গ্রেডেও যাওয়ার পথ সংকুচিত। তাহলে কোন আশায় জুনিয়র চিকিৎসকগণ আনন্দের সঙ্গে চাকরি করবেন। স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত পদ সৃষ্টি করতে হবে।

মতবিনিময় সভায় সব ক্যাডারের পদোন্নতির সমসংখ্যক স্তর সৃষ্টির দাবি জানানো হয়। একই বিসিএসের সব ক্যাডারের একসঙ্গে পদোন্নতির প্রস্তাব দেওয়া হয়। আমলারা অন্য সব ক্যাডারের সঙ্গে নিজেদের বৈষম্য সৃষ্টি করে রেখেছেন। সেই আমলাদের যাঁরা পদোন্নতি বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, এমনকি তাঁরা যদি মারাও গিয়ে থাকেন, তবুও তাঁদের এক বা একাধিক পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু স্বাস্থ্য ক্যাডারের পদোন্নতি হচ্ছে না। শিক্ষা ক্যাডারের ২৪ ও ২৫তম বিসিএসের ব্যাচভিত্তিক সবাইকে (প্রায় ৮০০ জন) সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ২০তম বিসিএস পর্যন্ত ৯২২ জনকে ব্যাচভিত্তিক অধ্যাপক পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

সংস্কার কমিশন সারা দেশে মতবিনিময় সভা করছে। রংপুরের মতবিনিময় সভায় যেসব সমস্যা উঠে এসেছে, তা দেশের সব কলেজ কিংবা হাসপাতালের। এগুলো ছাড়া আরও যেসব সংস্কারের দাবি উঠে আসবে, সব কটি আমলে নিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা তথা স্বাস্থ্য ক্যাডারকে উন্নত পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই একটি মাত্র সুযোগ এসেছে স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানোর। এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার যাতে আপামর জনগণ সহজে লাভ করতে পারেন, সেই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতেই হবে।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক।