বিরোধীদের ‘খাটাখাট’, ‘ঘটাঘট’, ‘সাফাচটে’ টলে যায় বিজেপি

রাহুল গান্ধি এবং নরেন্দ্র মোদিছবি: রয়টার্স

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভোটারের দেশ ভারতের ভবিষ্যৎ সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের জন্য গত ১৯ এপ্রিল থেকে ১ জুন পর্যন্ত দীর্ঘ ৮২ দিনে ৭ পর্বে অনুষ্ঠিত হলো ১৮তম লোকসভা নির্বাচন। ভারতের প্রায় ১৪৫ কোটি মানুষের মধ্যে আনুমানিক ৯৬ কোটি ৯০ লাখ ভোটার রয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ৬৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ এই নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।

বিশ্বের বহু দেশ এমনকি একাধিক দেশ নিয়ে গড়া অঞ্চলের মোট জনসংখ্যাও ভারতের ভোটারসংখ্যার চেয়ে কম। এই ভোটাররা প্রায় ৮ হাজার প্রার্থীর মধ্য থেকে বেছে নিয়েছেন ৫৪৩ জনকে। জাতীয় পর্যায়ের ও আঞ্চলিক পর্যায়ের ৭৪৪টি রাজনৈতিক দল এই ভোটে অংশ নেয়। তবে জয় পান ৪১টি দলের প্রার্থীরা, যাঁদের মধ্যে কেউ জয় পেয়েছেন ১০ লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে, কেউবা আবার মাত্র ৪৮ ভোটের ব্যবধানে।

প্রায় ১০ লাখ ৫০ হাজার পোলিং বুথে নিয়োজিত প্রায় দেড় কোটি নির্বাচনী কর্মকর্তা এই নির্বাচন পরিচালনা করে নানা রকম চমক ও রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন; যেমন মাত্র একজন করে ভোটার আছেন জানা সত্ত্বেও চীন–ভারত সীমান্তের কাছে উঁচু পাহাড়ের ওপর ও গুজরাটের গহিন জঙ্গলে দুটি পৃথক ভোটকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল পূর্ণমাত্রার নির্বাচন কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা রক্ষীদের নিয়ে।

আরও পড়ুন

এ ছাড়া হিমালয় পর্বতমালার ১৫ হাজার ২৬৫ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত তাসিগাঁও গ্রামের মাত্র ৬২ জন ভোটারের জন্যও ভোটকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিস্ময় ছিল নির্বাচনের ফলাফল। এমন ফলাফল অনেকেরই ধারণার বাইরে ছিল, যা থেকে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক থিঙ্কট্যাংক, গবেষক, পর্যালোচক, বিশ্লেষক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের শিক্ষা নেওয়ার মতো অনেক কিছুই আছে।

রাজনীতিতে সুষ্ঠু ভোট হলে দেশের পরবর্তী নেতা ও প্রশাসনের প্রধান নির্বাচনে মূল ভূমিকা পালন করেন ভোটাররা। এই ভোটারদের কখনো দলের আজীবন সমর্থক বা নিশ্চিত সমর্থক বলে ধরে নেওয়া বড় রকমের ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে এবারের ভারতীয় নির্বাচনে। কংগ্রেস অতীতে এই ভুল করেছে, আর এবার করল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। (সূত্র: এনডিটিভি)  

ভোটে ভালো ফল প্রত্যাশা করা এবং বেশি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনের ইঙ্গিত দিয়ে ভোটার ও সমর্থকদের উজ্জীবিত করা দোষের কিছু নয়। তবে বিজেপি জাতীয় সংসদের ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ৪০০টিতে জয়লাভের মানসে স্লোগান তোলে ‘আব কি বার ৪০০ পার’, অর্থাৎ এবার আসনসংখ্যা ৪০০ পার হবে। পক্ষান্তরে কংগ্রেসের অতি উৎসাহী নেতারা ২৯৫টি আসনে জয়ের আভাস দেন।

বিশ্লেষকদের মতে, উভয় দলের এমন মনোভাব ক্রিকেট খেলায় ৯০ শতাংশ বলে আঘাত করে রান সংগ্রহের সঙ্গে তুলনীয়, যা সাধারণ ভোটাররা পছন্দ করেননি। এ জন্য উভয় দলকেই মূল্য দিতে হয়েছে। তবে বেশি মূল্য দিয়েছে বিজেপি। কারণ, বিজেপিবিরোধীরা বিষয়টি সামনে এনে প্রচার করে যে বিজেপি ৪০০ আসন পেলে সংবিধান পরিবর্তন করে ফেলবে এবং পিছিয়ে পড়া দলিত সম্প্রদায়, উপজাতি ও মুসলমানদের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করবে। এ ছাড়াও নাগরিকত্ব আইন প্রয়োগ করে বিভিন্ন অজুহাতে গণহারে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করা ভারতীয়দের দেশছাড়া করবে। (সূত্র: এনডিটিভি ও আল–জাজিরা)

ভারতের দিল্লিসহ ৩৫টি রাজ্যের লোকসভায় ৫৪৩টি আসনের মধ্যে সর্বাধিক ৮০টি (প্রায় ১৫ শতাংশ) উত্তর প্রদেশ রাজ্যে অবস্থিত। ২০১৯ সালে নির্বাচনে উত্তর প্রদেশে বিজেপি ৬২টি আসনে জয় পেলেও এবার পেয়েছে মাত্র ৩৩টিতে।

আরও পড়ুন

উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে পাওয়া ১০টি আসন থেকে ২০১৪ সালে বিজেপির ৭১টি আসনে পৌঁছেছিল। তাই এবারের ভোটে এমন ফলাফল যাবতীয় ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, অনুমান ও জরিপ; বিশেষত বুথফেরত জরিপকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছে। ভোটের মাঠে উত্তর প্রদেশ বরাবর ‘আন প্রেডিক্টেবল’ বা অনুমানের বাইরে কথাটির সত্যতা আবারও প্রমাণিত হয়েছে এই ভোটে। তাই ‘উত্তর প্রদেশকে গুরুত্ব দাও’ প্রবাদটি পুনরায় শাণিত করেছে এবারের নির্বাচন। (সূত্র: এনডিটিভি ও আল–জাজিরা)

রাজনীতির মাঠে ধর্মকে পুঁজি করে বৈতরণি পার একটি সহজ সমাধান, এমন কথার বিপরীত চিত্র দেখা গেছে উত্তর প্রদেশসহ বেশ কিছু অঞ্চলে। রামমন্দির কেন্দ্র করে বিশাল আশায় বুক বেঁধেছিল বিজেপি। এই লক্ষ্যে রামমন্দির অর্ধনমিত থাকতেই ভোটের আগে তা উদ্বোধন করা হয়। রামমন্দির উত্তর প্রদেশের ফয়েজাবাদ সংসদীয় এলাকায় অবস্থিত। এই আসনেও বিজেপিকে হারিয়েছেন সমাজবাদী পার্টির অবধেশ প্রসাদ, যিনি মূলত পিছিয়ে থাকা দলিত পাশী সম্প্রদায়ের একজন নেতা।

বহু কারণে বিজেপি আশানুরূপ ফল করতে পারেনি বলে প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন কারণ খুঁজে পাচ্ছেন রাজনৈতিক গবেষক ও বিশ্লেষকেরা। ভাষা, সংস্কৃতি ও মানসিকতার দিক থেকে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক মিল। তাই ভবিষ্যতের ভোটযুদ্ধে ২০২৪ সালের ভারতীয় লোকসভা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবার জন্য হতে পারে এক শিক্ষণীয় বিষয়।

ভোটের আগে সমাজবাদী পার্টির সভাপতি অখিলেশ যাদব ও কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীকে তাচ্ছিল্য করেছিলেন বিজেপি নেতা ও উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। তিনি রামমন্দির ঘিরে বিশাল পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন এবং ‘বালক জোড়া’ (অখিলেশ ও রাহুল) এসবের কিছুই বোঝেন না বলে মন্তব্য করেন। তবে বাস্তবে টি–শার্ট ইমেজের রাহুলকে বেছে নিয়েছেন ভোটাররা। গেরুয়া বসনের যোগী আদিত্যনাথকে নয়। (সূত্র: দ্য ইকোনমিক টাইমস, আনন্দবাজার ও আল–জাজিরা)

২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি দলীয় ইশতেহার বা বিভিন্ন আসনে তাদের প্রার্থীদের যোগ্যতার চেয়েও মোদির ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়। উন্নয়ন ও সুশাসনের ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা উপস্থাপনের বদলে ‘মোদিকা গ্যারান্টি’ বা ‘মোদিকা চ্যালেঞ্জ’ ও ‘ফের একবার—মোদিকা সরকার’ প্রভৃতি নির্বাচনী স্লোগান সামনে নিয়ে আসে। তবে কেবল মোদি ফ্যাক্টর তথা ব্যক্তিবন্দনা বা এক ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে ভোট দেননি ভোটাররা। ফলে মূল্য দিতে হয়েছে বিজেপিকে এবং স্বয়ং মোদিজিকে।‌

উত্তর প্রদেশের বারানসি আসনে মোদি ২০১৪ সালে প্রায় পৌনে ৪ লাখ ও ২০১৯ সালে প্রায় পৌনে ৫ লাখ ভোটে জিতলেও এবার জিতেছেন ১ লাখ ৫২ হাজার ৫১৩ ভোটের ব্যবধানে। ভোটের ব্যবধান বিবেচনায় নবনির্বাচিত ২৪০ জন বিজেপির সংসদ সদস্যের মধ্যে মোদির অবস্থান নিচ থেকে ১১৬তম। এর আগে ভিন্ন পরিস্থিতিতে দুজন ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর কথা বাদ দিলে ক্ষমতায় থেকে কম ভোটের ব্যবধানে জয়ের ক্ষেত্রে এটি একটি নতুন মাইলফলক। (সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট)

কৌতুকময় শব্দমালা যে ভোটে প্রভাব ফেলতে পারে, তা–ও প্রমাণিত হয়েছে এ নির্বাচনে। কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী নির্বাচনী ইশতেহারের একটি অংশে প্রতিশ্রুতি দেন যে তাঁর দল ক্ষমতায় গেলে ৪ জুন থেকেই পরিবারপ্রতি একজন নারী নির্বাচন করার কাজ শুরু হবে, যাঁদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৪ জুলাই থেকে শুরু করে ১২ কিস্তিতে বছরে ১ লাখ রুপি ‘খাটা খাট’, অর্থাৎ দ্রুত সময়ে জমা হতে থাকবে। মোদি ও তাঁর শিবির বিষয়টিকে নিয়ে হাস্যরস করে।

এতে বিচলিত না হয়ে মোদির সমর্থক মিডিয়াকে একহাত নেন রাহুল। তিনি বলেন, ‘তোমরা মিডিয়ারা কেবল মোদির বন্দনা করো, বড়লোকের তোষামোদ করো আর আম্বানি পরিবারের বিয়েশাদি ও ৮ কোটি টাকা দামের হাতঘড়ি দেখিয়ে মানুষকে ভুলিয়ে রাখো। আমরা ঠিকই “খাটাখাট” টাকা পাঠাব আমাদের মা-বোনদের কাছে, যা আমাদের নির্বাচনী এলাকায় শুরু হলেও ছড়িয়ে পড়বে সারা ভারতে। প্রয়োজনে ও সুযোগ-সুবিধা পেলে বছরে দুই লাখ টাকাও পাঠানো হবে মা–বোনদের কাছে।’

রাহুল–শিবিরের অন্য নেতারাও প্রায় একই রকম শব্দমালা ব্যবহার করে ভোটের মাঠ গরম করে তোলেন। ইন্ডিয়া জোটের শরিক সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব নির্বাচনী ফান্ডের নামে বিতর্কিত সব ভ্যাকসিন ও ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে বিজেপি ‘ঘটাঘট ঘটাঘট’ টাকা এনেছে বলে বোমা ফাটান। জোটের পূর্বাঞ্চলীয় নেতা তেজস্বী যাদব ক্ষমতায় গেলে বেকারদের জন্য ‘ফটাফট’ চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাড়া ফেলেন।

অন্য নেতারা ৪ জুনের নির্বাচনী ফলাফল বিজেপিকে ‘সাফাচট সাফা চট’ করবে, অর্থাৎ চট করে সাফ বা পরিষ্কার করবে তথা বিদায় করবে বলে প্রচার করে ব্যাপক কৌতূহল সৃষ্টি করেন। এসব শব্দও বহু ভোটারকে প্রভাবিত করেছে বলে সাক্ষ্য দিয়েছে ভারতীয় মূল ধারার বহু গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একাধিক সূত্র।

আরও বহু কারণে বিজেপি আশানুরূপ ফল করতে পারেনি বলে প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন কারণ খুঁজে পাচ্ছেন রাজনৈতিক গবেষক ও বিশ্লেষকেরা। ভাষা, সংস্কৃতি ও মানসিকতার দিক থেকে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক মিল। তাই ভবিষ্যতের ভোটযুদ্ধে ২০২৪ সালের ভারতীয় লোকসভা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবার জন্য হতে পারে এক শিক্ষণীয় বিষয়।

  • ড. মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) গবেষক, অনুবাদক ও কলামিস্ট। ই-মেইল: [email protected]