রাজধানী ঢাকার একটি নামী স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের অকপট স্বীকারোক্তি, তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এবারের এসএসসির ফল ততটা ভালো হয়নি। তিনি সরাসরি দোষ দিলেন শিক্ষার্থীদের। তারা ঠিকমতো ক্লাসে আসতে চায় না। অনেকেরই মুঠোফোনে আসক্তি আছে। গভীর রাত অবধি এই যন্ত্র নিয়ে পড়ে থাকে। সকালে উঠতে দেরি হয়। এসবের ফলই এবার তাঁরা পেয়েছেন।
পাবলিক পরীক্ষায় কোনো কোনোবার ফল আশানুরূপ না-ও হতে পারে। কিন্তু নামী ও সফল প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাদের পরিচিতি সমাজে স্বীকৃত, তাদের ফল যখন ভালো না হয়, তখন তা নিয়ে কথাবার্তা-আলোচনার প্রয়োজন আছে বৈকি।
এখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানপ্রধান সরাসরি শিক্ষার্থীদের ওপর দায় চাপিয়ে দিলেন। কিন্তু শিক্ষক হিসেবে তাঁরা কতটা কী করতে পারছেন, তাঁদের সফলতা বা ব্যর্থতা কোথায়, শিক্ষার্থীরা কেন ক্লাসে উপস্থিত হতে আগ্রহী হচ্ছে না, সে বিষয় নিয়ে তাঁর মুখ থেকে কথা শোনা গেল না।
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য যেমন মেধাবী শিক্ষার্থী দরকার, তেমনি মানুষ ও সমাজের প্রতি কর্তব্যনিষ্ঠ শিক্ষার্থী আরও বেশি দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্বিক পরিবেশ উন্নত হলেই কেবল উন্নত মেধা ও বোধবুদ্ধির শিক্ষার্থী তৈরি হতে পারে। ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ শিক্ষকেরা যদি নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভাবতে না পারেন, তাহলে আর কে ভাববে?
এখন অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, ফলাফল—সবকিছুর চিন্তা যেন অভিভাবকদের ওপর এসে পড়েছে। যেহেতু স্কুলে অতটা পড়াশোনা হয় না, তাহলে প্রাইভেট টিউটর রাখতে হবে, অথবা ভালো শিক্ষকের কাছে ব্যাচে পড়াতে হবে, সেই শিক্ষক যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হন, তাহলে আরও ভালো।
অভিভাবকদের একে তো ‘ভালো’ স্কুলের উচ্চ বেতন পাই পাই করে পরিশোধ করতে হচ্ছে, অন্যদিকে প্রাইভেট টিউটর, ব্যাচের শিক্ষকের জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বিলাতে হচ্ছে। চাকুরে অভিভাবকদের মানিব্যাগ ফাঁকা হয়ে যায় মাসের প্রথম সপ্তাহেই। এরপর বাজারে নিত্যপণ্যের দামে আগুনের কথা এ লেখায় আর নাই-বা তুললাম।
তবে ওই নামী স্কুলের একজন অভিভাবকের কথা পুনরায় বলতেই হচ্ছে। তিনি বললেন, তাঁর দুই মেয়ে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ে, কিন্তু সেখানে লেখাপড়া আগের মতো ভালো নেই। তাঁর দাবি, এখন এই বিদ্যালয়ে ছাত্রীদের ভালো করার জন্য অভিভাবকদের ভূমিকা অনেক। কারণ, অভিভাবকেরা সন্তানদের কোচিং-প্রাইভেটের মাধ্যমে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করেন (১৭ মে প্রথম আলো)।
২.
কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যদি সামগ্রিক পরিবেশ অনুকূলে না থাকে, তাহলে সেখানে লেখাপড়া ততটা ভালো হতে পারে না। যদিও লেখাপড়ার ব্যাপক অর্থ আমরা ভুলে গেছি। এখন আমাদের নজর হলো ফলাফলের ওপর। লেখাপড়া এখন পুরোটাই ফলভিত্তিক। জিপিএ-৫ না হলে যেন সব শেষ। শিক্ষার্থীর চাওয়া জিপিএ-৫, অভিভাবকের চাওয়া জিপিএ-৫, শিক্ষকের চাওয়া জিপিএ-৫, মিষ্টির দোকানদারের চাওয়াও জিপিএ-৫! এমনকি গণমাধ্যমের চাওয়াও জিপিএ-৫।
বলছিলাম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক পরিবেশের কথা। ঢাকা শহরে কিছুদিন পরপর বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যৌন হয়রানির ঘটনায় উত্তাল হয়। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। শিক্ষার্থী-অভিভাবকেরা দল বেঁধে পথে নামেন। সেসব ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। যে শিক্ষকের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ ওঠে, অভিযোগ প্রমাণের আগেই তাঁর ছবি প্রকাশিত হয়ে পড়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেয়ালে, ল্যাম্পপোস্টে তাঁর ছবি। মিছিলের প্ল্যাকার্ডে তাঁর ছবি। এ রকম যখন চিত্র, সেখানে লেখাপড়ার পরিবেশ কীভাবে বজায় থাকে? শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীর ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ কি আর থাকে?
আবার এমনও দেখা যায়, যৌন হয়রানির যেসব অভিযোগ দেওয়া হয়, কিছু ক্ষেত্রে তা সত্য হয় না। অনেক সময় শত্রুতাবশত বা ঈর্ষাবশত এমন অভিযোগ দেওয়া হয়। ওই শিক্ষকের কাছে হয়তো ছেলেমেয়েরা বেশি প্রাইভেট পড়তে যায়, তখন তিনি অনেকের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন। ‘ওনার কাছে এত ছেলেমেয়ে কেন পড়তে যাবে, উনি কেন এত টাকা কামাবেন, আমার কাছে কেন ছেলেমেয়েরা আসবে না’, অতএব দাও তাঁকে ফাঁসিয়ে! সহজ তরিকা যৌন হয়রানি? তাহলে ‘আবার যৌন হয়রানি যে আদতে ঘটে না তা নয় মোটেই।’
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদেরও সচেতনতার ঘাটতি আছে। ক্লাসে-কোচিং সেন্টারে ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হয়, অনেক সময় ছেলেমেয়েরা আর তা বাড়িতে এসে মা-বাবাকে বলে না। একদম চেপে যায়, যা খুবই ক্ষতিকর। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অভিভাবকদের এমন সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা থাকতে হবে, যাতে তাঁরা সব তথ্য জানতে পারেন, বুঝতে পারেন। এসব বিষয়ে বেসিক ধারণাটুকু ছেলেমেয়েদের দিতে হবে।
৩.
আমরা ফলাফলের প্রসঙ্গে আসি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যতই নামকরা হোক, এর সার্বিক পরিবেশ যদি ভালো না থাকে, কাঙ্ক্ষিত ফল আসতে পারে না।
গত বছর রাজধানীর আরেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিচালনা বোর্ডের এক সদস্যের সঙ্গে এক ছাত্রীর প্রেম-বিয়ে নিয়ে কত কাণ্ড ঘটে গেল। পক্ষে-বিপক্ষে যত মতই থাকুক, এটা সমাজে ভালো বার্তা দেয়নি।
কেবল ভালো ফলই একটা প্রতিষ্ঠান ভালো কি না, তা ঠিক করে দেয় না। ভালো ফলের পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমে ওই প্রতিষ্ঠানের ছেলেমেয়েরা কতটা ভালো, তা গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি একটি মেয়ে বা একটি ছেলে যখন এসএসসির চৌকাঠ পেরিয়ে যায়, তখন তার মধ্যে নিজ পরিবার, ভাইবোন ও আশপাশের মানুষের প্রতি কতটা দায়িত্ব ও বোধ তৈরি হলো, সেটা বিবেচনা করার দরকার পড়ে। কারণ, এ বোধই তাকে তার পরবর্তী জীবনের গতিপথ ঠিক করে দেয়।
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য যেমন মেধাবী শিক্ষার্থী দরকার, তেমনি মানুষ ও সমাজের প্রতি কর্তব্যনিষ্ঠ শিক্ষার্থী আরও বেশি দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্বিক পরিবেশ উন্নত হলেই কেবল উন্নত মেধা ও বোধবুদ্ধির শিক্ষার্থী তৈরি হতে পারে। ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ শিক্ষকেরা যদি নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভাবতে না পারেন, তাহলে আর কে ভাববে?
গ্রামে-শহরে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেক ভালো শিক্ষক এখনো আছেন। তাঁরা নীরবে-নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা তাঁদের শ্রদ্ধা জানাই। ভালোবাসা জানাই।
• কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক