সিরিয়ার বিরোধী বাহিনী মাত্র দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে রাজধানীসহ সিরিয়ার প্রধান শহরগুলো দখল করে ফেলেছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েছে। এই বাহিনীর নেতৃত্বে চিল হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)।
ইসলামিক স্টেটের (আইএস) যে অবশিষ্ট অংশ আছে, তারা সম্ভাব্য ক্ষমতার শূন্যতাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে, এমন ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। শুক্রবার এক বিবৃতিতে কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের (এসডিএফ) নেতা মাজলুম আবদি সতর্কবার্তা দিয়েছেন, ‘সিরিয়ার মরুভূমিতে হামলার মাধ্যমে আইএস সুবিধা নিচ্ছে এবং যেখানে শাসনব্যবস্থা দুর্বল, সেই সব নতুন এলাকা দখল করার চেষ্টা করছে।’
গত রোববার যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে আইএসের অবস্থানের ওপর বিমান হামলা চালায়। মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ড জানিয়েছে যে এই হামলার উদ্দেশ্য হলো, ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে বহিরাগত অভিযান চালানো থেকে বিরত রাখা’ এবং নিশ্চিত করা যে আইএস যেন ‘বর্তমান পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে মধ্য সিরিয়ায় আবার নিজেদের পুনর্গঠনের চেষ্টা না করে।’
এইচটিএসের নেতৃত্বে অগ্রযাত্রার মুখে আসাদের সেনা প্রত্যাহারের পর এসডিএফ পূর্বের শহর দেইর আজ-জোরে প্রবেশ করে। দেইর ছিল ২০১৭ সালে আইএসের কথিত খিলাফতের রাজধানী। এসডিএফ ঘোষণা দেয়, ‘আইএস আমাদের এলাকায় বিস্তারের কোনো চেষ্টা করলে প্রতিহত করব।’ কয়েক দিন পর এইচটিএস জানায় যে তারা এসডিএফ থেকে দেইর আজ-জোরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে।
এসডিএফ দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেয়ে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করে ২০১৯ সালের শুরুতে সিরিয়ায় তাদের অঞ্চলভিত্তিক খিলাফত ধ্বংস করেছে। তবে এখনো আইএসের অবশিষ্ট অংশ মরুভূমি থেকে বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে।
সিরিয়ার শাসক বাহিনী এবং সিরিয়ায় রাশিয়ার সেনাবাহিনী বছরের পর বছর আইএসের এই অবশিষ্ট বাহিনীকে দমন করার চেষ্টা করেছে। অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র মরুভূমিতে আইএসের নেতাদের ওপর বিমান হামলা চালিয়েছিল। এই হামলা আইএস দমনের চেষ্টার একটা স্বীকৃতি, এতে সন্দেহ নেই।
এখন রাশিয়া ও আসাদের শাসন না থাকায় আইএস নতুন করে আক্রমণ চালিয়ে তাদের ঘরোয়া প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে আবার রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে পারে।
বিশ্লেষণ সংস্থা রেনের সিনিয়র বিশ্লেষক রায়ান বোহল দ্য নিউ আরবকে বলেছেন, ‘আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি যে সিরিয়ার সেনারা দ্রুত ইউফ্রেটিস নদীর উপত্যকার এলাকাগুলোর অবস্থান ছেড়ে দিচ্ছে আর আইএস তা দখল করার চেষ্টা করছে।...আইএসের প্রচারমাধ্যম ঘোষণা দিচ্ছে যে তারা তাদের অভিযান ত্বরান্বিত করবে ক্ষমতার শূন্যতাকে কাজে লাগানোর জন্য।’ সম্প্রতি আইএস তাদের সংবাদপত্র আল-নাবায় এইচটিএসকে জাতীয়তাবাদী এবং অ-ইসলামিক বলে ঘোষণা করেছে। বোহল বিশ্বাস করেন যে আইএস অন্য গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ এড়ানোর চেষ্টা করবে, অন্তত কিছু সময়ের জন্য।
নিউ লাইনস ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ডিরেক্টর নিকোলাস হেরাস বলেছেন, এই সময়ে আইএসের পক্ষে মধ্য ও পূর্ব সিরিয়ায় দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা লাভজনক হবে না।...এই মুহূর্তে তাদের দখল এবং শাসন করার মতো কাঠামো নেই। আর তা করলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ক্ষিপ্তভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। হেরাস বলেন, এখনই বড় আকারে আক্রমণ করার পরিবর্তে সম্ভবত আইএস অপেক্ষা করবে আসাদ-পরবর্তী বিশৃঙ্খলা থেকে সুবিধা নেওয়ার জন্য।
এসডিএফের হাতে হাজার হাজার আইএস যোদ্ধা এবং তাঁদের পরিবার কারাগার ও ক্যাম্পে বন্দী আছে। অতীতে এই যোদ্ধাদের কেউ কেউ কারাগার থেকে পালানোর চেষ্টা করেছেন। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, শরণার্থীদের ঢল এবং নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আইএস জেল ভাঙার মতো অভিযান, ব্যক্তিগত হামলা এবং গুপ্তহত্যা চালানোর চেষ্টা করবে।
তুরস্ক–সমর্থিত সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এসএনএ) উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে আসাদবিরোধী অভিযানের সময় কুর্দিদের লক্ষ্য করে অভিযান চালিয়েছিল। ফলে কয়েক হাজার কুর্দি বেসামরিক নাগরিক বাস্তুচ্যুত হয়ে ইউফ্রেটিস নদীর পূর্বে এসডিএফ-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। তুরস্ক দীর্ঘদিন ধরেই এই অঞ্চলে আক্রমণ চালানোর হুমকি দিয়ে আসছে। তারা অতীতে এসএনএকে এসডিএফের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে।
এসডিএফের হাতে হাজার হাজার আইএস যোদ্ধা এবং তাঁদের পরিবার কারাগার ও ক্যাম্পে বন্দী আছে। অতীতে এই যোদ্ধাদের কেউ কেউ কারাগার থেকে পালানোর চেষ্টা করেছেন। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, শরণার্থীদের ঢল এবং নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আইএস জেল ভাঙার মতো অভিযান, ব্যক্তিগত হামলা এবং গুপ্তহত্যা চালানোর চেষ্টা করবে।
এর মধ্যে তুরস্ক–সমর্থিত এসএনএ ইউফ্রেটিস নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত মানবিজ শহরে এসডিএফের ওপর হামলা চালায়। এই শহর এসডিএফ ২০১৬ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আইএস থেকে মুক্ত করেছিল। গত বুধবার এসডিএফ মার্কিন মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।
হেরাস মনে করেন, ‘তুরস্ক ইউফ্রেটিসের পশ্চিমে থাকা সব এসডিএফ নিয়ন্ত্রিত এলাকা নিজের হাতে নিতে চায়। আলেপ্পো থেকে কুর্দিদের ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি ঘটেছে। সৃষ্টি হয়েছে বিশৃঙ্খলা। এমন অবস্থায় এসডিএফের জন্য নতুন বাস্তুচ্যুত মানুষ সামলানো আর তুরস্ক–সমর্থিত আক্রমণ প্রতিহত করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অবশ্য রেনের বিশ্লেষক বোহল মনে করেন যে নিকট ভবিষ্যতে ইউফ্রেটিসের পূর্বে এসডিএফ এলাকায় আরেকটি তুর্কি-এসএনএ আক্রমণের আশঙ্কা কম। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্র চাইবে, যেন আইএস ক্ষমতার শূন্যতা কাজে না লাগাতে পারে। তবে এটা নিশ্চিত যে তুরস্ক এসডিএফের ওপর সামরিক চাপ বাড়াবে তাদের কাছ থেকে ছাড় আদায় এবং নিরস্ত্রীকরণের জন্য।
এইচটিএস যখন আল-কায়েদা-সংযুক্ত জাবহাত আল-নুসরা নামে আন্দোলন করত, তখন তারা খিলাফতের অধীনে আসতে অস্বীকার করেছিল। সে সময় আইএস আর আজকের এইচটিএসের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। এইচটিএস এখন সিরিয়ার প্রধান গোষ্ঠী হওয়ার পর নতুন সংঘর্ষ শুরু হতে পারে।
বোহল বলছেন, ‘যখন এইচটিএস সিরিয়ার সরকার হিসেবে দায়িত্ব নেবে, সন্দেহ নেই যে তখন এইচটিএস এবং আইএসের মধ্যে সংঘর্ষ ত্বরান্বিত হবে। তখন সমস্যা হবে এই যে এইচটিএসকে সীমিত সম্পদ নিয়ে হঠাৎ করে পুরো দেশের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে হবে। আগামী সপ্তাহ ও মাসগুলোতে যেখানে এইচটিএসের প্রতিরোধ কম হবে, আইএস সম্ভবত তেমন সব অঞ্চল এবং গ্রাম দখল করতে পারবে।’ এবার বোধ হয় আইএস একসঙ্গে অনেক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো ভুল করবে না।’
এবার মনে হচ্ছে, আইএস সিরিয়ার ভেতরেই জাতীয় কৌশলে মনোযোগ দেবে। বিভিন্ন গোষ্ঠীকে একে অপরের বিরুদ্ধে নামিয়ে আর শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়ে তারা নিজেদের পুনর্গঠনের চেষ্টা করবে।
পল ইদন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক
দ্য নিউ আরব থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত