কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত একজন দিনমজুরের মন্তব্য ‘আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব’ সংবলিত ফটোকার্ডে ‘দেশকে অস্থিতিশীল’ করার চেষ্টা করা হয়েছে। অনেকের অভিযোগ, ওই এক ফটোকার্ডের মাধ্যমে দেশের সম্মানহানি করা হয়েছে। যে বা যাঁরা এই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন, তাঁদের কাছে আমার কিছু সরল প্রশ্ন রয়েছে।
অনেকে বলার চেষ্টা করছেন যে প্রথম আলো ওই ফটোকার্ড ইচ্ছাকৃতভাবেই করেছে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য। এই খবরটা দেশে ঠিক কী ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে পারে, তা কি কেউ আমাকে বলতে পারেন? এ খবরের কারণে কি দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিপদে পড়ত? এটা কি কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানত? দাতা সংস্থাগুলো তহবিল দিতে অপারগতা জানাত? নাকি দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হতো?
ফটোকার্ডটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে প্রথম আলো প্রত্যাহার করে নিয়েছে। কারণ, তারা মনে করেছে, সেখানে বিভ্রান্তির একটি সুযোগ রয়েছে। অনলাইনে প্রকাশিত যে প্রতিবেদন থেকে কার্ডটি করা হয়েছে, সেখানে অনেকের বক্তব্য ছিল। কিন্তু কার্ডটিতে ছবি গেছে একটি শিশুর এবং মন্তব্যটি গেছে একজন দিনমজুরের। কোনোভাবেই যাতে ভুল–বোঝাবুঝি না হয়, সে জন্য দ্রুত সেটি তারা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এটা সাংবাদিকতার দায়িত্ব থেকেই তারা করেছে বলে মনে করি। এমনকি অনলাইনের প্রতিবেদনটিতে তারা নিয়ম মেনে সেই সংশোধনীও দিয়েছে।
আপনি যদি প্রথম আলো অনলাইনের সেই মূল সংবাদ আর ফটো প্রত্যাহার করার মধ্য দিয়ে সংশোধিত সংবাদ তুলনা করেন, তাহলে শিরোনাম ছাড়া আর একটি শব্দও বদল করা হয়নি। সংশোধনী দেওয়ার আগে প্রথমবার প্রকাশিত প্রতিবেদনটির শব্দসংখ্যা ছিল ৩৯০ আর সংশোধনীর পর তা নেমে এসে ৩৮৯ শব্দ হয়েছে। সেখানে শিশু সবুজ আর দিনমজুর জাকির হোসেনের বক্তব্যের কোনো পরিবর্তন আমি দেখতে পাইনি। জাকিরের বক্তব্য যদি প্রত্যাহার করে নেওয়া হতো কিংবা সেখানে সবুজের নাম আসত, তাহলে এই সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন করা যেত। যেহেতু দিনমজুর জাকিরের বক্তব্য নিয়ে সংশয় নেই, সেহেতু এই সংবাদটিকে আপনি কিছুতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলতে পারেন না।
সংবাদপত্র রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ নয়, তা আমাদের মনে রাখতে হবে। আবার সংবাদপত্র আইনের ঊর্ধ্বে নয়, সেটিও সংবাদপত্র–সংশ্লিষ্টদের মানতে হবে। প্রতিপক্ষ ভেবে নিজেদের ক্ষতি যেন না করি, সেটি ভাবার সময় এসেছে। আমরা চাই অতি শিগগির সরকার ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন বাতিল করুক। প্রথম আলো সম্পাদকসহ সব সাংবাদিককে এসব মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হোক। সংবাদপত্রের ওপর সব খড়্গ উঠে যাক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সবাই এগিয়ে আসুক, এ প্রত্যাশা করি।
স্রেফ ফেসবুকে প্রকাশিত ফটোকার্ডের ব্যবহৃত ছবিটি নিয়ে তর্ক করা যায়। এ ধরনের প্রচ্ছদ ছবি হামেশাই আমাদের পত্রপত্রিকাগুলো করে আসে, যার শত শত উদাহরণ রয়েছে। দিনমজুরের বক্তব্যের সঙ্গে যে শিশুটির ছবি এসেছে, তা সংবাদমাধ্যমের গেটকিপিংয়ে আটকে দেওয়া উচিত ছিল। এই কারণে তারা সংশোধনী দিয়েছে, যা সাংবাদিকতার নীতিমালাকে পোক্ত করেছে। এটা ছাপা কাগজে হলে, তা তাৎক্ষণিক সংশোধনীর সুযোগ ছিল না। কিন্তু অনলাইন পোর্টালগুলোর জন্মই হয়েছে ফলোআপ প্রটোকল মেনে। তবে শিশুদের ছবি ব্যবহারের যে নীতিমালা আমাদের রয়েছে, প্রথম আলোর ওই ছবিতে তার সবকিছুই ছিল। সেই দিক দিয়ে কথা বলার অবকাশ নেই।
এবার আলোচনা করি প্রকাশিত ছবিটির শিশুকে আর্থিক সহায়তা প্রসঙ্গে। বলা হচ্ছে, প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট সংবাদকর্মী ১০ টাকার বিনিময়ে ছবিটি তুলেছেন। এটা সত্য কিনা জানি না। তবে একে অনেকেই সাংবাদিকতার মানদণ্ডে অনৈতিক বলে মনে করছেন। একটি শিশু ফুল বিক্রি করে মা-বাবাকে সহায়তা করা শিশুর সঙ্গে আপনি যখন কথা বলবেন, তার একটি ছবি তুলবেন, তখন তার সময় আপনি নষ্ট করলেন।
এ সুযোগে তার যদি ফুল বিক্রি কম হয়, সেটির জন্য সেই সংবাদকর্মী মানবিক কারণে যদি ১০ টাকা দেন, সেটিকে অন্যায় অন্যায় বলে চেঁচিয়ে ওঠা কতটা শোভন আমি জানি না, তবে সাংবাদিকতায় সোর্স ডেভেলপমেন্টের কৌশলের একাডেমিক পাঠে আপনি এ ধরনের সহায়তার তথ্য পাবেন। বিশ্বের অনেক দেশে সাক্ষাৎকার নিতে গেলে, যিনি সাক্ষাৎকার দেন, তাঁকে উপযুক্ত সম্মানী দেওয়া হয়। আমি চাক্ষুষ প্রমাণ, জাপানে থাকাকালীন সেই দেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এনএইচকের এক সাংবাদিক আমার এক পরিচিত বন্ধুর সাক্ষাৎকার নিয়ে তাকে সম্মানী দিয়েছিল।
সেই সম্মানী ওই সাংবাদিক পকেট থেকে নয়, বরং এনএইচকে দাপ্তরিক চেকে তা পরিশোধ করেছিল। যে দেশে হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে লুট হয়, শতকোটি টাকা পাচারের অভিযোগ পত্রপত্রিকায় আসে, সেখানে এক সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে ১০ টাকা দিয়ে ‘ন্যায়ের যে মানদণ্ড’ আমরা দেখানোর চেষ্টা করলাম, সেটি অন্তত আমাদের জন্য মানায় না।
আপনি যদি সূক্ষ্মভাবে বিবেচনা করেন, তাহলে নিজের কাছে প্রশ্ন করেন তো, সাত বছরের এই বাচ্চাগুলোকে কেন ফুল বিক্রি করতে হবে? দেশের শিশুশ্রম আইনে এই বাচ্চাদের পারমিট করে? রাষ্ট্র কি এই বাচ্চাদের মৌলিক চাহিদা দেখভাল করছে? আমরা কি এই বাচ্চাদের শৈশবের কষ্টগুলো চোখ বন্ধ করে অস্বীকার করতে পারি? এ দায় কি রাষ্ট্র এড়িয়ে যেতে পারে?
পত্রিকার মূল কাজ সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা অসংগতি তুলে আনা, নিজ উদ্যোগে অন্যায়কারী কিংবা অপরাধীদের খুঁজে বের করে সংবাদ পরিবেশন করা, যাতে করে সেই রোগগুলো রাষ্ট্র পরিচালনাকারীরা সারাতে এগিয়ে আসে। পত্রিকার কাজ কখনোই পাবলিক রিলেশনের মতো দাপ্তরিক কাজ নয়, যেখানে কেউ কথা বলতে না পারলে তার মুখের কথা বলতে সহায়তা করে। এ আদর্শের ওপর ভিত্তি করে দেশে দেশে গণমাধ্যমগুলোর জন্ম হয়েছে।
১৬ বছরের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার মধ্যে আমার এক দশক সাংবাদিকতায় কেটেছে দেশের শীর্ষ এক অনলাইন নিউজ পোর্টালে। সেই অভিজ্ঞতায় কিছুটা হলেও বলতে পারি, অনলাইন সংবাদপত্র চরিত্র আর কাগজে প্রকাশিত সংবাদ পরিবেশনের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। এখানে খবর জানার পরপরই বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে দ্রুততম সময়ে পাঠকদের জানাতে হয়। আপনি যদি অনলাইন খবরগুলোর দিকে নজর দেন, দেখবেন বেশির ভাগ খবরই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপডেট করা হয়, যেখানে শিরোনাম পরিবর্তনের সুযোগ থাকে, মূল সংবাদে তথ্যের সংযোজনের সুযোগ থাকে এবং সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো তা করেও। আর এটিই সারা দুনিয়ার অনলাইন পত্রিকা পরিচালনার কৌশল। কয়েক মাস আগে খোদ বিবিসি এক এমপির নাম ভুল ছবিতে ব্যবহার করেছিল, হালের বড় এক গায়িকার ছবির সঙ্গে তাঁর ভুল নাম তুলেছিল, যার জন্য পত্রিকাটি সংশোধনী দিয়েছে, ক্ষমা চেয়েছে। এটিই সংবাদমাধ্যমের স্বচ্ছতার চরিত্র। ভুল হলে সংশোধন করে পাঠকদের সঠিক তথ্য জানানোয় সংবাদপত্রের বড় ট্রান্সপারেন্সি।
সংবাদপত্রের কাজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করা। ভিকটিমের পক্ষাবলম্বন সাংবাদিকতার অন্যতম আদর্শ বটে। ফলে এখানে বরাবরই অন্যায়কারীরা সংক্ষুব্ধ হবেন, এটাই স্বাভাবিক। কেউ যদি সংক্ষুব্ধ হতে চান, সেই ক্ষেত্রে প্রথম আলো কেন, দেশের যেকোনো পত্রিকার সংবাদ নিয়ে সংক্ষুব্ধ হতে পারেন। কারণ, প্রতিদিনই আমাদের পত্রিকাগুলো ডজন ডজন মন খারাপ করা সংবাদ ছাপে। কোথাও দুর্নীতি, কোথাও ডাকাতি, কোথাও জবরদখল আবার কোথাও খুনোখুনি। আর এই সব খবর পড়ে, কেউ যদি সংক্ষুব্ধ হন, আদালতে ডিজিটাল সিকিউরিটি মামলা করেন, তাহলে প্রতিদিন শত শত মামলা করা সম্ভব।
কিন্তু এই সব মামলা দিয়ে কি সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা সম্ভব? হয়তো সম্ভব। অতীতে অনেক সাংবাদিকই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলায় হয়রানি হয়েছে। এই আইনের খপ্পরে পরে গত পাঁচ বছর ধরে আমাদের সাংবাদিকতার মান কমতে শুরু করেছে। তোষামোদি সংবাদ পরিবেশনের মুখ্য হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ সাহস দেখানোর চেষ্টা করলেও ডিএসএর ধারায় হয়রানির ভয়ে সংবাদপত্রগুলো নিজেদের গুটিয়ে আনছে। সংবাদপত্র যদি সত্য বলতে ভয় পায়, তাহলে তা চূড়ান্ত বিচারে রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের আগামীর প্রজন্ম ভয়ের সংস্কৃতি এই চর্চার মধ্যে পড়ুক তা আমরা চাই না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে যদি আমরা ধারণ করতে চাই, তাহলে সংবাদপত্রের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। এভাবে রাতবিরাতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা, তাঁদেরকে বাসা থেকে তুলে নেওয়া, ভয় দেখানো, শাস্তি দেওয়া বস্তুত আমাদের রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড দুর্বল করে দেওয়ার শামিল। আবার কথা বলার স্বাধীনতার সুযোগে রাষ্ট্রকে ছোট করা হয়, এমন কর্মকাণ্ড থেকেও সাংবাদিকদের সচেতন থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ দেশের মানুষের জন্য সংবাদপত্র, ভিনদেশিদের সুখের জন্য নয়।
সংবাদপত্র রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ নয়, তা আমাদের মনে রাখতে হবে। আবার সংবাদপত্র আইনের ঊর্ধ্বে নয়, সেটিও সংবাদপত্র–সংশ্লিষ্টদের মানতে হবে। প্রতিপক্ষ ভেবে নিজেদের ক্ষতি যেন না করি, সেটি ভাবার সময় এসেছে। আমরা চাই অতি শিগগির সরকার ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন বাতিল করুক। প্রথম আলো সম্পাদকসহ সব সাংবাদিককে এসব মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হোক। সংবাদপত্রের ওপর সব খড়্গ উঠে যাক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সবাই এগিয়ে আসুক, এ প্রত্যাশা করি।
ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
ই–মেইল: [email protected]