রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক চারটি উপাদানের মধ্যে অন্যতম হলো জনসংখ্যা। তাই সংবিধানের কেন্দ্রে জনসংখ্যার গুণগত ও পরিমাণগত দিক বিবেচনায় রাখা উচিত।
১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে মিসরের কায়রোতে অনুষ্ঠিত হয় জনসংখ্যা ও উন্নয়নবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। সেখানে জনসংখ্যা ও উন্নয়ন ভাবনায় অধিকার ও উন্নয়নকে কেন্দ্রে রেখে জনসংখ্যার গুণগত দিক গুরুত্ব পায়। ফলে একধরনের প্যারাডাইম শিফট ঘটে। মানুষ ও মানব অধিকার হয়ে ওঠে টেকসই উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে চূড়ান্ত করা প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন-এ জেন্ডার সমতা; ন্যায়বিচার; নারীর ক্ষমতায়ন; জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কাঠামোর মতো ১৩টি দিক নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত হয়। বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে সেগুলো বিবেচনায় নেওয়া উচিত। এই সূত্র ধরে কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় আলোচনা করা যাক।
সংবিধান সংস্কারে সঠিক জনমিতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা একেবারে মৌলিক একটি প্রয়োজনীয়তা। সেই বিবেচনায় জনমিতি ও জেন্ডার ভাবনাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। বর্তমানে জনসংখ্যায় নারীর সংখ্যা (৮ কোটি ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭৮৪) পুরুষের (৮ কোটি ৪১ লাখ ৩৪ হাজার ৩ জন) চেয়ে বেশি। সর্বশেষ জনশুমারি (২০২২) নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও প্রাপ্ত তথ্য তাই বলেছে। ফলে বিদ্যমান কাঠামোতে থাকা সংরক্ষিত নারী আসনসংখ্যা জনমিতিক পরিমাপে উন্নীত করা (কমপক্ষে আনুপাতিক হারে সমসংখ্যা বা অর্ধেক) এবং সরাসরি নির্বাচনের বিধান প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
সংসদে আসনবিন্যাসে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জনমিতিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এবং এ-সংক্রান্ত কার্যকর সংজ্ঞা নির্ধারণ দরকার। ২০২২ জনশুমারিতে ৫০টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব এসেছে। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের নামকরণে আপত্তি লক্ষণীয়। ফলে কমিশনকে এ বিষয়ে সুচিন্তিত দৃষ্টি দিতে হবে।
জনঘনত্বকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়ে নীতি-পরিকল্পনা করা দরকার। বাংলাদেশ পৃথিবীর অষ্টম জনবহুল দেশ। আয়তনে দেশটি ছোট ও জনঘনত্ব পৃথিবীর অন্যতম সর্বাধিক। ফলে যেকোনো উন্নয়ননীতি ও পরিকল্পনাতে জনঘনত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। ব্যক্তির সম্পত্তি অর্জনে সীমারেখা নিয়ে পর্যালোচনা করা এবং এ-সংক্রান্ত একটি বিধান সংযোজন করা বা সাংবিধানিক নির্দেশনা প্রদান করা প্রয়োজন।
দেশের জনসংখ্যা কাঠামো ও উপগোষ্ঠী নির্ধারণে সঠিক একীভূত সংজ্ঞায়ন ও গুণগত-নির্ভরযোগ্য উপাত্তের ব্যবহার নিশ্চিতে অত্যাবশ্যকীয় তাগিদ ও নির্দেশনা প্রদান। উদাহরণস্বরূপ, যুব বা যুব জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সংজ্ঞায়নে পার্থক্য দূর করে নীতি-পরিকল্পনায় ভিন্নতা দূরীকরণ। তা ছাড়া উপাত্তের রাজনীতিকরণ পরিহারে নির্দেশনা থাকা।
জনসংখ্যার বিভিন্ন উপগোষ্ঠীর সুরক্ষাহীনতা দূর করা এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত করা দরকার। যেমন দেশ ও দেশের বাইরে অভিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার; বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অধিকার; যৌন, প্রজননস্বাস্থ্য ও অধিকার এবং হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টি প্রদান।
জাতীয় সংসদে যেন কোনো সুনির্দিষ্ট পেশাগোষ্ঠীর আধিপত্যে (যেমন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর) না পড়ে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দরকার। সংসদ হবে পেশাগত রাজনীতিবিদদের। তবে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের যোগ্যতার মাপকাঠি ও তথ্য প্রদানের বিধানে নজর দেওয়া প্রয়োজন। আইনপ্রণেতা হতে হলে তাঁকে সংবিধান ও আইনকানুন বুঝতে পারার মতো শিক্ষিত হতে হবে।
সুশাসন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নীতি-পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সংবিধানের কার্যকারিতা নিয়ে ঘাটতি রয়েছে। বিদ্যমান সংবিধান দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মর্ম অনুযায়ী সংবিধানের বিধানগুলো এমনভাবে রূপ দিতে হবে যেন তা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে কার্যকর হয়।
গত ১৩ বছরে দেশের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় জনসংখ্যা পরিষদের একটি সভাও নাকি অনুষ্ঠিত হয়নি। অন্যদিকে দেশে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন রয়েছে কিন্তু তা বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে। ফলে এখনো বাংলাদেশে প্রতি দুজন নারীর একজনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ১৮ বছরে পৌঁছানোর আগেই। আর প্রতি ৩ জন কিশোরীর ১ জন মা হয়ে যান ১৯ বছরের মধ্যেই। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের সর্বশেষ জরিপ তো সেটিই বলছে। বাংলাদেশ ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল গৃহীত রেজল্যুশনে শিশু বা বাল্যবিবাহকে মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে স্বীকৃতি দেয়নি বা ভোট দেয়নি।
বর্তমান সংবিধান হলো ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ বাংলাদেশের সংবিধান। স্বাধীন দেশের জনগণ হলো নাগরিক—‘প্রজা’ নন। ফলে নাগরিকের অধিকারকে বিবেচনায় নিয়ে সংবিধানের শিরোনাম থেকে ‘প্রজাতন্ত্র’ কথাটি বাদ দেওয়া উচিত।
জনসংখ্যার পরিবর্তিত আকার ও কাঠামো বিবেচনায় নিয়মিত বিরতিতে সংবিধান আধুনিকীকরণ বা যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে পর্যালোচনা করার জন্য কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। প্রয়োজন দেশ ও জনগণের স্বার্থে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাদ বা আমূল সংস্কার করা। স্বৈরাচারী বা স্বেচ্ছাচারী ব্যবস্থা নির্মূলে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা এবং একটি বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আমাদের সবারই দায়বদ্ধতা রয়েছে। সর্বোপরি, দেশ ও জনগণের প্রয়োজনে জনমিতিক ভাবনাকে বিবেচনায় রেখে সংবিধানের কোথায় সংস্কার প্রয়োজন, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
● ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান