সরকার আকবর হলে জনতা হোক আনারকলি

নর্তকী হয়ে শাহজাদা সেলিমের সঙ্গে ভাব–ভালোবাসায় জড়ানোর ‘অপরাধে’ বাদশাহ আকবর আনারকলিকে জ্যান্ত কবর দেওয়ার হুকুম দিয়েছিলেন বলেই এত দিন জানতাম। মুঘল-এ-আজম দেখার পর মনে হলো, ভুল জানতাম।

সেলুলয়েডের পর্দায় ভারতসম্রাটের সামনে নাচতে নাচতে আনারকলি যখন গাইল, ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া’, তখন বাদশাহর বেজার মুখ দেখিনি। কিন্তু গানের শেষ কলিতে আনারকলি যেই–না বলল, ‘পর্দা নেহি যব কোয়ি খুদা ছে, বান্দা ছে পর্দা কারনা কিয়া’; অমনি বাদশাহ রেগে কাঁই।

বাদশাহ রাগলেন, কারণ আনারকলি বলেছে, খোদা আর আমার মাঝে পর্দা নেই। আমার প্রেমের কথা যেহেতু খোদ খোদা জানে, সেহেতু খোদার বান্দা আকবর জানলে তাঁকে ভয় পাওয়ার কী আছে?

আনারকলি জানত, খোদার সামনে যা বলা যায়, বান্দার সামনে তা বললে জান হারানোর ঝুঁকি আছে। সেই ঝুঁকি নিয়েই আনারকলি বলেছে।

বাদশাহ আকবরের বিবেচনায় সেলিমকে ভালোবাসা আনারকলির মূল অপরাধ ছিল না। তার মূল অন্যায় ছিল বাদশাহকে ভয় না পাওয়া। তার আসল অপরাধ ছিল ভরা মজলিশে আজিমুশ্বান ভারতসম্রাটকে ‘বান্দা’ বলে জনসাধারণের কাতারে নামিয়ে আনা। রাজাকে প্রজার আসনে বসানো বা শাসক-শাসিতকে এক করে ফেলার মতো বেয়াদবি আর নেই। শাসকের কাছে শাসিতের এই গোস্তাখির ক্ষমা হয় না।

৫ আগস্টের আগে গণভবন নামক দরবারে যাঁরা যেতেন, আকবর বাদশাহর দরবারের পাত্রমিত্রদের মতো তাঁরাও জানতেন, মজলিশের মাঝখানে পাতানো বড় গদিটি দখল করে থাকা ব্যক্তি সবার চোখে ভয়ভীতি দেখতে পছন্দ করতেন। তিনি যে একজন বান্দা, আনারকলির মতো কেউ সাহস করে মুখের ওপর বলে তাঁকে সে কথা মনে করিয়ে দেয়নি। তাঁকে কেউ বলেছে ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’, কেউ বলেছে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’, কেউ বলেছে ‘কওমিজননী’। স্তাবকপরিবেষ্টিত সেই দরবারে কোনো ‘আনারকলিকে’ ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সেপাই-কোটাল যখনই কারও মধ্যে ‘আনারকলি সিনড্রোম’ দেখেছে, তখনই তাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে।

আমলাতন্ত্র গোষ্ঠীতন্ত্রে পরিণত হয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এতটাই কুক্ষিগত করেছে যে বিগত সরকারের আমলে অনেক নেতাকেও আক্ষেপ করে বলতে শুনেছি, দেশ তো মন্ত্রীরা চালায় না, চালায় আমলারা। সেই অবস্থা এখনো আছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধানকে সরানোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতিকে বলতে শুনেছি, ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কমিশন প্রধানকে সরকার যদি অপসারণ না করে, কীভাবে অপসারণ করতে হবে, সেই হাতিয়ার আমাদের জানা আছে।’

কিন্তু ৫ আগস্ট লাখ লাখ ছাত্র-জনতার বিপ্লবী স্রোতের তোড়ে সব ভয়ভীতি ভেসে গেছে। শাসকের ঘরে ঢুকে তঁার পালঙ্কে শাসিত শুয়ে সেলফি তুলেছে। শাসকের সাঁতারপুকুরে নেমে শাসিত কেলি করেছে। শাসিত বুঝিয়েছে, এই প্রাসাদের মালিক সে; এই সাঁতারপুকুরের মালিক সে; এই খাটপালঙ্কের মালিক সে; শাসক তাঁর প্রতিনিধি তথা কর্মচারীমাত্র তথা ‘বান্দা’। কর্তৃত্ব পেয়ে কর্মচারীর কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠাতেই রাজধর্মের বিপদ। দেশের মালিকেরা দেড় দশক এই বিপদ সহ্য করেছে।

এখন নতুন দিন। জনতা কুমির তাড়িয়েছে, কিন্তু বাঘের ভয় তার কাটেনি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে একের পর এক দাবির মিছিল নামছে। এখনো সমানে ঘুষ-বাণিজ্য চলছে। উত্তরের অস্থিরতা সামলাতে না সামলাতে দক্ষিণ বেসামাল হয়ে উঠছে। ফুটপাত থেকে রাজপথে ‘চাঁদাবাজ যায় চাঁদাবাজ আসে’ অবস্থা জারি আছে।

এই সিলসিলা জিইয়ে রাখার জন্য আবু সাঈদরা গুলির সামনে বুক পেতে দাঁড়ায়নি। এই বস্তাপচা অবস্থা বদলাতে ব্যবস্থা না নিলে তাদের রক্ত ঢালা অর্থহীন হয়ে যাবে। সেই ব্যবস্থা নেওয়ার পথে যত বাধা আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় বাধাটির নাম আমলাতন্ত্র।

আমলাতন্ত্র গোষ্ঠীতন্ত্রে পরিণত হয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এতটাই কুক্ষিগত করেছে যে বিগত সরকারের আমলে অনেক নেতাকেও আক্ষেপ করে বলতে শুনেছি, দেশ তো মন্ত্রীরা চালায় না, চালায় আমলারা। সেই অবস্থা এখনো আছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধানকে সরানোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতিকে বলতে শুনেছি, ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কমিশন প্রধানকে সরকার যদি অপসারণ না করে, কীভাবে অপসারণ করতে হবে, সেই হাতিয়ার আমাদের জানা আছে।’

ব্রিটিশ টিভি সিরিয়াল ‘ইয়েস মিনিস্টার’ দেখিয়েছিল, আমলাতন্ত্রের অচলায়তন কীভাবে সরকারের সংস্কারের উদ্যোগ নস্যাৎ করে দিতে পারে। এখানেও তা-ই দেখা যাচ্ছে।

নতুন বছরে মানুষ এই সরকারকে সংস্কারের হাত ধরে নতুন চেহারায় দেখতে চায়। জনতা সরকারের হাতে তাদের দেওয়া কর্তৃত্বের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা দেখতে চায়। অমুককে তমুক কারণে কিছু বলা ঠিক হবে না; তমুকের বিরুদ্ধে অমুক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না—এমন দোটানাভাবে আটকে থাকলে সংস্কার কমিশনগুলো শেষ পর্যন্ত ‘কুসংস্কার কমিশনে’ রূপ নেবে। ‘বাঁয়ে বাঁচিয়ে, ডাইনে রুখে’, তাকে এড়িয়ে, ওকে না ঘাঁটিয়ে ব্যবস্থা নিলে কোনো সংস্কার টিকবে না। ভজহরির মতো ‘কড়া ব্যবস্থা’ নিলে হবে না। ভজহরির ব্যবস্থা নেওয়ার গল্পটা হলো:

ভজহরি শহরে চাকরি করে। একটা মেসে থাকে। বউ থাকে গ্রামে। বউটার সঙ্গে এলাকার মাতব্বর জগাদার একটু ‘এন্টুফেন্টু’ আছে। পুকুরপাড়ের খেজুরগাছটার তলায় রোজ দুপুরবেলা দুজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুজুর-গুজুর করে। এগুলো পাড়ার লোক ভালো চোখে দেখে না।

ভজহরির ছোট ভাই তাকে ফোন করে বলল, ‘দাদা, জগাদার সঙ্গে বউদির কীসব হচ্ছে, পাড়ায় তো মুখ দেখানো যাচ্ছে না। কিছু একটা ব্যবস্থা করো।’

ভজহরি বলল, ‘দ্যাখ, জগা হচ্ছে পাড়ার মাতব্বর। তাকে কিচ্ছু বলা যাবে না; বললে গ্রামে থাকতে পারব না। আর তোর বউদি হচ্ছে বাড়ির বড় বউ। তাকেও তো কিছু বলা উচিত হবে না।’ ছোট ভাই বলল, ‘তাহলে কি কোনো ব্যবস্থা নেবে না?’ ভজহরি বলল, ‘নেব না মানে! কড়া ব্যবস্থা নেব।’ ছোট ভাই বলল, ‘কী ব্যবস্থা নেবে?’ ভজহরি বলল, ‘আমি বাড়ি এসেই খেজুরগাছটা কেটে ফেলব।’

অন্তর্বর্তী সরকার ভজহরির মতো খেজুরগাছ না কেটে কঠোর সংস্কারের মধ্য দিয়ে এমন একটি নির্বাচনী পথরেখা তৈরি করুক, যে পথে হেঁটে জাতি দিনের বেলায় ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবে।

ভোটের মধ্য দিয়ে রাজদণ্ড হাতে জনগণের প্রতিনিধি গদিতে গিয়ে বসুক; আর সেই প্রতিনিধি নিজেকে ‘আকবর বাদশাহ’ ভাবলেই তাঁর সামনে ভয়ডরহীন আনারকলিরা নেচে নেচে বলুক, ‘পর্দা নেহি যব কোয়ি খুদা ছে, বান্দা ছে পর্দা কারনা কিয়া’। নতুন বছরে ‘এর বেশি কী পাওয়ার আছে? এর বেশি কে চায়?’

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

    [email protected]