১৮ অক্টোবর ঢাকায় বড় সমাবেশ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছেন। দুই দলই মনে করছে, জয়ের প্রান্তে চলে আসছে। কিন্তু তাদের এই সমাবেশের কারণে যে নগরীর লাখ লাখ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে, আধা ঘণ্টার পথ পার হতে কয়েক গুণ সময় লেগেছে, সেসব নিয়ে আমাদের ‘জনদরদি’ ও ‘গণতন্ত্রকামী’ নেতাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
বিএনপির সমাবেশ থেকে বলা হয়েছে, ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ থেকে সরকার পতনের মহাযাত্রা শুরু হবে। মহাযাত্রা মানে আরও কঠোর কর্মসূচি, সর্বাত্মক আন্দোলন। আওয়ামী লীগের সমাবেশ থেকে বলা হয়েছে, বিএনপি ঢাকা অবরোধ করতে এলে তাদের বুড়িগঙ্গার ওপারে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ঢাকা শহরে দাঁড়াতেই দেওয়া হবে না তাদের।
কেবল কথার হুংকার নয়। এর পাশাপাশি বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার অভিযানও চলছে। অনেক মামলায় বিরোধী দলের নেতারা দণ্ডিত হয়ে জেলে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, নতুন করে কারও বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে না। পুরোনো মামলায় আসামিদের আটক করা হচ্ছে। বিচার চলছে।
আওয়ামী লীগ নেতাদের এই দাবি কতটা যৌক্তিক? সরকার যদি আইনের প্রতি এতটাই শ্রদ্ধাশীল থাকবে, তাহলে ২০২১ সালের দুর্গোৎসবে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর-মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের দায়ে করা ৫২টি মামলার একটিরও বিচার শুরু হলো না কেন? সরকার যখন যে মামলা সচল করতে চায়, সেটি সচল হয়। সরকার যেটি চালু করার প্রয়োজন মনে করে না, সেটি ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়।
বিএনপির নেতারা বলছেন, সরকারের পতন না হলে তাঁরা ঘরে ফিরে যাবেন না। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, কেউ পতন ঘটাতে এলে তাদের প্রতিরোধ করা হবে। এই পতন ও প্রতিরোধের আন্দোলন এ দেশের মানুষ দেখে আসছে পঞ্চাশের দশক থেকে।
১৯৫৪ সালে রাজপথে নয়, ভোটের যুদ্ধে মুসলিম লীগের পতন হয়েছিল, কিন্তু গণতন্ত্র আসেনি। ষাটের দশকে স্বাধিকার আন্দোলনের পথ ধরে উনসত্তরে আইয়ুব খানের পতন হয়েছিল। গণতন্ত্র আসেনি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এই স্বাধীনতারও প্রধান প্রত্যয় ছিল গণতন্ত্র। বাহাত্তরের সংবিধানেও গণতন্ত্রকে অন্যতম মূলনীতি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তিন বছরের মাথায় সেই গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়ে একদলীয় শাসন কায়েম করা হলো। এরপর পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে দেশে জারি করা হয় সেনাশাসন। অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর সেই সেনাশাসনের অবসান হয় নব্বইয়ে আরেক গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। কিন্তু গণতন্ত্র অধরাই থেকে গেল।
বিএনপি বলছে, গণতন্ত্র ধ্বংসের মূলে আওয়ামী লীগ। আর আওয়ামী লীগ বলছে, সব সর্বনাশের হোতা বিএনপি। আর তারা যেই স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল, সেই স্বৈরশাসকের দল মিটমিট করে হাসছে।
রাজপথ থেকে দুই পক্ষই ‘জয়’ নিয়ে ঘরে ফিরতে চায়। কিন্তু গণতন্ত্রের ন্যূনতম শর্ত কেউ মানছে না। গণতন্ত্রের মূল কথা হলো আলোচনা। যুক্তিতর্কের মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্তে আসা। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এতটাই দক্ষ, প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ যে গত ৫২ বছরেও তারা নির্বাচনটি কীভাবে হবে, সে ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। তারা গণতন্ত্র চায়, কিন্তু গণতন্ত্রের মৌলিক শর্ত সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে ভয় পায়। ইতিহাসের বড় শিক্ষা হলো ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। যাঁরা একসময় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন, তাঁরাই ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সেদিকে ঠেলে দিয়ে উল্লসিত হন।
আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপির আমলে কতটি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, গ্রেনেড হামলা হয়েছে, জঙ্গি উত্থান ঘটেছে, তার বিবরণ দেন। আবার বিএনপির নেতারা আওয়ামী লীগ আমলে কতটি হত্যা-গুম-নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তার ফিরিস্তি দেন। কিন্তু কেউ নিজের দিকে তাকান না। আত্মসমালোচনা করেন না। তাঁরা অতীতের বৃত্তে বন্দী থাকেন, সামনে তাকান না।
এ কারণেই প্রতি পাঁচ বছর পরপর নির্বাচনে যে–ই জিতুক না কেন, হেরে যায় গণতন্ত্র ও জনগণ। আমাদের রাজনৈতিক বিজ্ঞ নেতৃত্ব দেশকে এমন অবস্থায় নিয়ে গেছে যে বিদেশিরা কথায় কথায় সবক দেয়; পরামর্শের নামে প্রচ্ছন্ন ও প্রকাশ্য হুমকি দেয়। যারা প্রকাশ্যে হুমকি দেয় না, তারাও বাংলাদেশকে খুব সমীহের দৃষ্টিতে দেখে না।
দুই পক্ষের এই রণহুংকারে জনগণের অবস্থা যে ত্রাহি মধুসূদন, সে কথাটি কি অতিবিজ্ঞ রাজনীতিকেরা বোঝেন না? অবশ্যই বোঝেন কিন্তু মানেন না। তাঁদের কাছে দেশ ও জনগণের চেয়ে ক্ষমতা বড়। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পাল্টে দেন তাঁরা। পৃথিবীর কোনো দেশে সুষ্ঠু ভোটের জন্য দশকের পর দশক আন্দোলন হয়েছে, এমন নজির নেই।
আমাদের নেতারা গণতন্ত্রের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। কিন্তু তাঁদের কথা ও ভাষাভঙ্গিতে গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। রাজনীতিকদের বক্তব্য–বিবৃতিতে যুক্তিতর্কের সঙ্গে শ্লেষ, কৌতুক ইত্যাদি সব সময়ই ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে সেটি ব্যক্তিগত আক্রমণের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কে কতটা নিচে নামতে পারে, সেই প্রতিযোগিতা চলে। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে যে ভাষায় গালমন্দ করে, তা নিম্নরুচির বললেও কম বলা হবে। একবার এক টেলিভিশন টক শোতেও এক নেতা তো আরেক নেতার চোখ তুলে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। নেতাদের ভাষাভঙ্গি দেখে জীবনানন্দ দাশের ‘অদ্ভুত আঁধার’ কবিতাটি মনে পড়ে। তিনি লিখেছিলেন, ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,/ যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;/ যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই—প্রীতি নেই—করুণার আলোড়ন নেই।’
রাজনীতিকদের কাছ থেকে আমরা মহৎ সত্য, শিল্প কিংবা সাধনা না পেতে পারি, ন্যূনতম শিষ্টাচার, দেশ ও মানুষের প্রতি ন্যূনতম দায়িত্ববোধ তো আশা করতে পারি।
স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত তিনটি রাজনৈতিক দল দেশ শাসন করেছে—আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। কিন্তু এই তিন দলের কেউ নির্বাচনটি কীভাবে হবে, সে বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। ক্ষমতায় থাকতে তাদের কাছে যেটি পরম সত্য, ক্ষমতার বাইরে গেলে সেটাই পরিত্যাজ্য হয়। ক্ষমতার বাইরে থেকে তারা যে কর্মকাণ্ডকে গণতান্ত্রিক অধিকার বলে দৃঢ় কণ্ঠে সমর্থন জানায়, ক্ষমতায় গিয়ে তার মধ্যে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র খোঁজে।
নব্বইয়ে স্বৈরাচার পতনের পর আমাদের নেতা-নেত্রীরা বলতেন, ‘শিশু গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হবে।’ ২৩ বছর পর গণতন্ত্রই যে কেবল রুগ্ণ শিশু রয়ে গেছে তা–ই নয়, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বও সাবালক হতে পারেনি।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি