ইসরায়েলের হামলার কারণে সব চোখ এখন গাজার দিকে। পুরো বিশ্ব যখন বোমায় বিধ্বস্ত গাজার ভবনগুলোর নিচে চাপা পড়া শিশু-নারী-বৃদ্ধ-যুবার লাশ গুনতে ব্যস্ত, তখন ফিলিস্তিনের আরেক অংশ পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার খবর চাপা পড়ে যাচ্ছে।
পশ্চিম তীরের, বিশেষ করে জেরুজালেমে মুসলমানদের ওপর এখন ইসরায়েল যে উৎপীড়নের মাত্রা বাড়িয়েছে, তা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তেমন কোনো গুরুত্ব পাচ্ছে না।
এর মধ্যে তুরস্কের সংবাদমাধ্যম আনাদোলু নিউজ এজেন্সির একটি খবর চোখে পড়ল। সেখানে তারা জানাচ্ছে, আল-আকসা মসজিদে গত পরপর পাঁচটি শুক্রবারে ফিলিস্তিনিরা জুমার নামাজ পড়তে পারেননি।
শিগগিরই তাঁরা সেখানে নামাজ পড়তে পারবেন, এমন আশাও নেই। ইসরায়েলের সেনাবাহিনী কোনো মুসল্লিকে সেখানে ঢুকতে দিচ্ছে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন করে আল-আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডে ইহুদিরা প্রতিদিনই ঢুকছেন, এমনকি এই চত্বরে তাঁরা প্রার্থনাও করছেন।
আল-আকসায় মুসলমানদের নামাজ পড়তে না দেওয়ার এ ঘটনা শুধু ফিলিস্তিনি মুসলমানদের জন্য নয়, পুরো আরব বিশ্ব তথা মুসলিম বিশ্বের মুসলমানদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ উদ্বেগের পেছনে শুধু ধর্মীয় বিষয় নয়; বরং রাজনৈতিক বিষয়ও বড় কারণ হয়ে উঠেছে। ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সে উদ্বেগের বিষয়টি ফুটে উঠছে।
এই প্রেক্ষাপটে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ তাওরাত [ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ হিব্রু বাইবেল বা ওল্ড টেস্টামেন্ট, যেটিকে মুসলমানরাও তাদের পূর্ববর্তী নবী মুসা (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ আসমানি কিতাব বলে বিশ্বাস করে। তবে মুসলমানরা বিশ্বাস করে, মুসা (আ.)-এর ওপর যে তাওরাত অবতীর্ণ হয়েছিল, সেই তাওরাতের আদি টেক্সট অবিকৃত অবস্থায় নেই; সেই তাওরাতকে ইহুদিরা বিকৃত করেছে] এবং তালমুদে (তালমুদ হলো তাওরাতের প্রত্যাদেশগুলোর আলোকে ইহুদিদের ধর্মবেত্তাদের রচিত আইন শাস্ত্র বা ন্যায়শাস্ত্র, যা ইহুদিদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে) বিশ্বাসী ইহুদি থেকে শুরু করে ইসরায়েল সরকারের প্রভাবশালী মহলের আলোচনায়ও ‘মাসিয়াহ’, ‘থার্ড টেম্পল’, ‘লাল গরু’ ইত্যাকার শব্দবন্ধ ঘুরেফিরে আসছে।
বিশেষ করে আরব বিশ্বে এই শব্দবন্ধগুলো বারবার আলোচনায় আসার কারণ হলো ইহুদি সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ, এমনকি ইসরায়েল সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন নেতা মনে করছেন, আল-আকসা মসজিদ ভেঙে সেখানে ‘থার্ড টেম্পল’ (‘তৃতীয় মন্দির’, যাকে ‘সোলাইমানি মন্দির’ও বলা হয়) নির্মাণের জন্য ইহুদিরা অপেক্ষা করে আসছে এবং সেই অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে।
তারা মনে করছে, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আল-আকসা মসজিদ ভেঙে সেখানে থার্ড টেম্পল নির্মাণ করা যাবে। এর জন্য যেসব প্রস্তুতি নেওয়ার দরকার, তার সবই নেওয়া হয়ে গেছে।
ইসরায়েল শিগগিরই থার্ড টেম্পল নির্মাণের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে—এমন একটি আশঙ্কাই গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের আচমকা হামলা চালানোর পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে বলে হামাসের বরাত দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই জানিয়েছে।
মসিহ বা ত্রাতার আবির্ভাবের আয়োজন
ইহুদিরা বিশ্বাস করে, তাদের মুক্তি দিতে এবং সারা বিশ্বে ইহুদিদের একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠা করতে তাদের মধ্যে একজন মসিহ বা ত্রাতা আসবেন। কিন্তু যতক্ষণ না কয়েক হাজার বছর আগে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কিং সলোমনের [মুসলমানদের কাছে যিনি নবী সোলাইমান (আ.) ] টেম্পল বা সোলাইমানি মন্দির পুনরায় তৈরি করা হচ্ছে, ততক্ষণ সেই ত্রাতা আবির্ভূত হবেন না।
ইসলামের ভাষ্য অনুযায়ী, ইহুদিদের এই মসিহই দাজ্জাল, যে কিনা গোটা বিশ্ব শাসনব্যবস্থার একক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে।
ইসরায়েলের কট্টর ইহুদিদের একাধিক গোষ্ঠী মসিহের আগমনের শর্ত পূরণ করতে বহু বছর ধরে আল-আকসা মসজিদ ভেঙে সেই জায়গায় ‘থার্ড টেম্পল’ (তৃতীয় মন্দির তথা সোলাইমানি মন্দির) নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।
এই টেম্পল নির্মাণের লক্ষ্য সামনে রেখে সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে প্রভাবশালী যে সংগঠন দাঁড়িয়ে গেছে, সেটির নাম টেম্পল ইনস্টিটিউট। আলট্রা-অর্থোডক্স বা চরম কট্টর ইহুদিরা ১৯৮৭ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন।
আল-আকসা ভেঙে সেই জায়গায় থার্ড টেম্পল বানানোর জন্য কাজ করে যাওয়া আরেকটি সংগঠনের নাম ‘বোনেহ ইসরায়েল’ (নোট: ‘বনি ইসরায়েল’ বা ‘বনু ইসরায়েল’ নয়। এটি হলো ‘বোনেহ ইসরায়েল’, যার মানে ‘ইসরায়েল গঠন’) নামে একটি সংস্থা।
মজার বিষয় হলো এই সংগঠনটিতে ইহুদি ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরা একজোট হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
আরেকটি প্রতিষ্ঠানের নাম ‘রিটার্নিং টু দ্য মাউন্ট’। সংগঠনটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা তাদের ওয়েবসাইটে বলেছে, ‘টেম্পল মাউন্টের ওপর পূর্ণ ইসরায়েলি সার্বভৌমত্বের আদায় ও প্রয়োগ।’
গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি বিবিসি বাংলা ‘আল-আকসা: নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মুসলমানের বেশ ধরে প্রার্থনা করছেন ইহুদিরা’ শিরোনামে একটি ডকুমেন্টারি প্রকাশ করেছিল। তাতে ‘রিটার্নিং টু দ্য মাউন্ট’-এর কর্মীরা কীভাবে আল-আকসা মসজিদে মুসলমান সেজে ঢুকে ইহুদি প্রার্থনা করে, তা দেখানো হয়েছে।
থার্ড টেম্পল গড়তে যেসব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে
প্রস্তাবিত থার্ড টেম্পল নির্মাণের মিশনে সবচেয়ে এগিয়ে আছে টেম্পল ইনস্টিটিউট। এই প্রতিষ্ঠান মন্দিরটি নির্মাণের জন্য অনেক আগে থেকেই সাজসরঞ্জাম প্রস্তুত করছে। মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় পুরোহিতেরা যেসব পোশাক পরবেন, তা আগেভাগেই তারা বানিয়ে রেখেছে।
তাওরাতের নির্দেশনা অনুযায়ী মন্দিরের জন্য তামার জলপাত্র (কপার লিভার), ২৪ ক্যারেট সোনা দিয়ে বানানো ৪৫ কেজি ওজনের আলোকদানিসহ (গোল্ডেন ম্যানোরাহ) নানা ধরনের আসবাব তারা তৈরি করে রেখেছে। টেম্পল ইনস্টিটিউটের প্রকাশ করা ভিডিওতে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেরুজালেরেমের ওল্ড সিটির ইহুদি মহল্লার সেন্ট্রাল প্লাজায় এসব সংরক্ষিত আছে।
তাদের এসব জোগাড়যন্ত্র দেখে ফিলিস্তিনিদের এবং এ বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন এমন মুসলমানদের মধ্যে আশঙ্কা ও ভীতি তৈরি হয়েছে। উদারপন্থী ইহুদিরাও মনে করছেন, থার্ড টেম্পল তৈরির এসব উদ্যোগ ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের বাসিন্দাদের আরও বেশি শত্রুভাবাপন্ন করে তুলছে।
অনেকে ধারণা করছেন, শিগগিরই ইহুদিরা থার্ড টেম্পল নির্মাণের উদ্যোগ নিতে পারে। ইতিমধ্যে সে রকম লক্ষণ প্রকট হয়ে উঠেছে।
গত ৫ জুন ফরাসি সংবাদ সংস্থা এএফপি এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ছেপেছে। ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আন্তর্জাতিক নিউজ টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ফ্রান্স-২৪ তাদের ওয়েবসাইটে ‘দ্য ইসরায়েলিস সেট ফর নিউ জুইশ টেম্পল অন আল-আকসা সাইট’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি ছাপিয়েছে।
তাতে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের কট্টর জাতীয়তাবাদীরা জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ ভেঙে সেখানে তাদের থার্ড টেম্পল বা তৃতীয় সোলাইমানি মন্দির নির্মাণের বিষয়ে আশাবাদী হয়ে উঠেছে।
থার্ড টেম্পল কী
ইসলামি ভাষ্য, খ্রিষ্টীয় ভাষ্য, ইহুদি ভাষ্য এবং ঐতিহাসিক গবেষণায় স্বীকৃত তথ্য অনুযায়ী, জেরুজালেমের আজকের আল-আকসা মসজিদ যেখানে অবস্থিত, ঠিক এখানেই পয়গম্বর সোলাইমান (আ.) (পশ্চিমে যিনি কিং সলোমন বলে পরিচিত) মসজিদটি বানিয়েছিলেন। ইহুদিরা যেহেতু ইসরায়েলের [ইয়াকুব নবীর আরেক নাম ইসরাইল; বাইবেলে যাঁকে জ্যাকব বলে উল্লেখ করা হয়েছে] বংশধর; সেহেতু সোলাইমান (আ.) বা কিং সলোমন ইহুদিদের কাছে পবিত্র পুরুষ। সোলাইমানের বানানো এই মসজিদ বা উপাসনালয়ই হলো ইহুদিদের ‘ফার্স্ট টেম্পল’।
৫৮৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ইরাকের ব্যাবিলনের শাসক বখতে নাছর (পশ্চিমা বিশ্বে যিনি ব্যাবিলনের সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার নামে পরিচিত। তিনিই প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যান বানিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়) হামলা চালিয়ে এই ফার্স্ট টেম্পল গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং সব বনি ইসরায়েল বা সব ইহুদিকে দাস হিসেবে বন্দী করে ইরাকে নিয়ে গিয়েছিলেন।
এরপর পারস্য শাসকেরা বখতে নাছরের সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে বনি ইসরায়েল তথা ইহুদিদের ইরাক থেকে মুক্ত করে আবার ফিলিস্তিনে নিয়ে আসেন। ধ্বংস করে ফেলা সোলাইমানের মসজিদ বা ফার্স্ট টেম্পলের ওপর ৫১৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আবার আরেকটি উপাসনালয় নির্মাণ করার কাজ শুরু হয়। এটিকে বলা হয় ‘সেকেন্ড টেম্পল’। পরে রোমানরা পারস্যদের পরাজিত করে বাইতুল মুকাদ্দাস বা জেরুজালেম দখল করে এবং ৭০ খ্রিষ্টাব্দে তারা সেকেন্ড টেম্পলও ধ্বংস করে ফেলে। রোমানরা সেই জায়গায় দেবতা জুপিটারের উপাসনালয় বানিয়েছিল।
বর্তমানে আল আকসা বলতে পুরো কম্পাউন্ডকে বোঝানো হয়। পুরো কম্পাউন্ডকে বলা হয় ‘হারাম আল শরিফ’। এই কম্পাউন্ডের চার দেয়ালের মধ্যে থাকা কিবলি মসজিদ, কুব্বাতুস সাখরা (ডোম অব দ্য রক) ও বুরাক মসজিদ—এই তিন মসজিদের সমন্বয়ই হলো আল আকসা। মূল আল আকসা বা কিবলি মসজিদ হলো ধূসর সীসার প্লেট দিয়ে আচ্ছাদিত গম্বুজওয়ালা স্থাপনাটি।
তবে মিডিয়ায় আল আকসা নামে বেশি প্রসিদ্ধ সোনালী গম্বুজের স্থাপনার নাম কুব্বাতুস সাখরা বা ডোম অব দ্য রক। ইহুদিদের মূল লক্ষ্যস্থল হলো এই ডোম অব দ্য রক যেটিকে তারা টেম্পল মাউন্ট বলে। উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান এটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ছেলে খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের শাসনামলে এর কাজ শেষ হয়।
৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদটি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর আব্বাসীয় শাসনামলের খলিফা আল মনসুর এটি পুনর্নির্মাণ করেন। তারও পরে তাঁর উত্তরসূরি আল মাহদি এটি পুনর্নির্মাণ করেন।
১০৩৩ খ্রিষ্টাব্দে আরেকটি ভূমিকম্পে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফাতেমিদের শাসনামলের খলিফা আলী আজ-জাহির পুনরায় মসজিদটি নির্মাণ করেন।
ইহুদিরা মনে করেন, রোমানরা ‘সেকেন্ড টেম্পল’ ধ্বংস করে জুপিটারের মন্দির বানিয়েছিল। আর সে স্থলেই টেম্পল মাউন্ট বানানো হয়েছে। তাঁরা এর হিব্রু নাম দিয়েছেন, ‘হার হাবাইত’। এই টেম্পল মাউন্টের স্থলেই আদি সোলাইমানি মন্দিরের নকশায় থার্ড টেম্পল বানানোর পরিকল্পনা আছে ইহুদি কট্টরপন্থীদের।
থার্ড টেম্পল নির্মাণের শাস্ত্রীয় ভাষ্য ও এর রাজনৈতিক দিক
তালমুদের ব্যাখ্যানুযায়ী, মাসিহের আবির্ভাবের তিনটি প্রধান শর্ত আছে।
১. সারা পৃথিবীতে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিদের ইসরায়েলে জড়ো হতে হবে।
২. একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৩. সোলাইমানি মন্দির আগে যেখানে ছিল, ঠিক সেখানেই সেই মন্দির তৈরি করতে হবে।
ইহুদিরা বিশ্বাস করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই তারা প্রথম দুটি শর্ত পূরণ করতে পেরেছে। অর্থাৎ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা ইহুদিরা ইসরায়েলে জড়ো হয়েছে এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রও গঠন করে ফেলেছে।
এখন তৃতীয় শর্ত বাকি আছে। সেই শর্ত পূরণ করতে হলে আল-আকসা মসজিদ ভাঙতে হবে আর সেখানেই সোলাইমানি মন্দির বা থার্ড টেম্পল গড়তে হবে।
ধর্মীয় বিশ্বাস ও এর সামাজিক প্রভাব ইসরায়েলের রাজনীতিকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। কারণ, ইসরায়েলের রাজনৈতিক নীতি কী হবে, তা ঠিক করার পেছনে তাদের ধর্মবেত্তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এসব ধর্মীয় ভাষ্যনির্ভর সিদ্ধান্তের প্রভাব শুধু ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিকে অধিকতর নাজুকই করে না; বরং তা গোটা বিশ্বের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলে।
অনেকেই মনে করেন, ইসরায়েলের রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি প্রসঙ্গে এসব ধর্মগ্রন্থকেন্দ্রিক ভবিষ্যদ্বাণী ও অল্প কিছু মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস সংশ্লিষ্ট কথাবার্তাকে সামনে আনার কোনো মানে হয় না।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, এসব ধর্মীয় বিশ্বাস ও এর সামাজিক প্রভাব ইসরায়েলের রাজনীতিকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। কারণ, ইসরায়েলের রাজনৈতিক নীতি কী হবে, তা ঠিক করার পেছনে তাদের ধর্মবেত্তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
এসব ধর্মীয় ভাষ্যনির্ভর সিদ্ধান্তের প্রভাব শুধু ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিকে অধিকতর নাজুকই করে না; বরং তা গোটা বিশ্বের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলে।
চিন্তা করুন, ইসলামের অসংখ্য নবী-রাসুলের জন্মভূমি বায়তুল মুকাদ্দাসে অবস্থিত ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ (যা মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মিরাজের ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট) গুঁড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ পুরো মুসলিম বিশ্বে কী ভীষণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে।
খুবই লক্ষ করার বিষয় হলো, ইসরায়েলে বসবাসকারী কট্টর ইহুদি জাতীয়তাবাদীরা রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখছে। এই ইহুদিরা যেহেতু তাওরাত এবং তালমুদের নির্দেশনা অনুযায়ী চলে, সেহেতু রাজনীতি বা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে।
থার্ড টেম্পল গড়তে চাওয়া ইহুদিরা মনে করে, আল-আকসা মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে এখনই মন্দির বানানোর সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা তাদের আছে। কিন্তু ধর্মীয় গ্রন্থে বলা আছে, সেই মন্দির বানানোর কাজ করতে হলে তাদের আগে পবিত্র হতে হবে। তার জন্য কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের একটি লাল গাভি দরকার। সেই গাভি পেয়ে গেলেই মন্দির বানানোর কাজ শুরু করা যাবে।
ইহুদিরা মনে করে, তাওরাতের ভাষ্যমতেই তারা অপবিত্র অবস্থায় আছে। আগে তাদের জাতিগতভাবে পবিত্র হতে হবে। পবিত্র হতে হলে তাদের অনিবার্যভাবে একটি ‘লাল গরু’ দরকার।
কী সেই লাল গরু
তাওরাতে বলা আছে, কোনো ব্যক্তি লাশ স্পর্শ করলে সে সাতদিন পর্যন্ত অপবিত্র থাকে। তাকে পবিত্র করতে হলে লাশ স্পর্শ করার তৃতীয় ও সপ্তম দিনে একধরনের বিশেষ শুদ্ধকরণ পানিতে তাকে গোসল করিয়ে পবিত্র করতে হবে। তা না হলে সে অপবিত্রই থেকে যাবে।
সেই বিশেষ পবিত্রকরণ পানি তৈরি করতে লাগবে বিশেষ একটি গরু। যেহেতু সেই লাল গরুর সন্ধান এতদিন পাওয়া যায়নি, তাই পুরো ইহুদি জাতি তাঁদের বিশ্বাস অনুযায়ী ‘অপবিত্র’ হয়ে আছে।
তাওরাতের ভাষ্য অনুযায়ী, গরুটির প্রতিটি পশমকে লাল রঙের হতে হবে। একটি পশমও লাল ছাড়া অন্য রঙের হলে হবে না। গরুটির গায়ে কোনো কাটাছেঁড়া বা খুঁত থাকতে পারবে না। গরুটিকে একেবারে কম বয়সী হলেও হবে না, আবার বুড়ো হলেও হবে না; সেটিকে হতে হবে মাঝারি বয়সের। সেটির কাঁধে কখনো পানি সেচার কিংবা জমি চাষের জোয়াল পড়লে চলবে না। তার ঘাড়ের পশমকে খাড়া হতে হবে। এই গরুকে বিশেষ প্রার্থনা সহযোগে জবাই করার পর পুরো দেহটি পুড়িয়ে ফেলতে হবে। সেই ছাই পানিতে মিশিয়ে শুচিকরণ পানি তৈরি করতে হবে। সেই পানি দিয়ে যাজকেরা পবিত্র হবে। এর মধ্য দিয়ে পুরো ইহুদি জাতি পবিত্র হবে। ‘রেড কাউ’—শব্দবন্ধটি এই লাল গরুকে বোঝাতে পশ্চিমা সমাজে ব্যবহৃত হয়।
হয়তো এই বিবলিক্যাল ভাষ্যের কারণেই লাল রংয়ের গরুকে অনেক সমাজে বিশুদ্ধতার প্রতীক ভাবা হয়।
তাওরাতের গণনা পুস্তকের ১৯ অনুচ্ছেদের ১ থেকে ১৭ তম শ্লোকে গাভিটির বৈশিষ্ট্য ও শুদ্ধিকরণ পানি প্রস্তুতের বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে।
সেখানে বলা আছে: ‘সদাপ্রভু মোসেজ (মুসা আ.) ও হারোনকে (মুসা আ.-এর ভাই হারুন আ.) বললেন, ‘এটি একটি বিধি যেটি অনুযায়ী আমি আদেশ করছি: ইসরায়েলের সন্তানদের (বনী ইসরায়েলদের) বলে দাও, তারা যেন গায়ে কোনো খুঁত নেই এবং কাঁধে জোয়াল টানেনি এমন একটি লাল গরু নিয়ে আসে।
তোমরা এলিয়েজার যাজককে (ইসলামে যিনি ইলিয়াস আ.) সেই গরু দেবে তারপর গরুটাকে শিবিরের বাইরে নিয়ে যাবে এবং এলিয়েজারের সামনে সেটিকে বলি দেবে। এরপর এলিয়েজার যাজক সেই বলি দেওয়া গরুর রক্ত আঙুলে মাখিয়ে তা শিবিরে জড়ো হওয়া সবার সামনে সাত বার ছিটিয়ে দেবে। তার সামনেই সেই বলি দেওয়া গরু পোড়ানো হবে; সেটির গোবরসহ চামড়া, মাংস ও রক্ত পোড়ানো হবে। যাজক তখন দারুবৃক্ষ, হাইসোপ (এক ধরনের তৃণবিশেষ) পুড়তে থাকা গরুর ওপর ফেলে দেবে। তখন যাজক তার পোশাক ধোবে ও শরীর জলে ধোবে। পরে শিবিরে ঢুকতে পারবে যদিও যাজক সন্ধ্যা পর্যন্ত অশুচি থাকবে।’ (তাওরাত, অনুচ্ছেদ ১৯, শ্লোক ২-৮)
কোরআনে মুসা (আ.)-এর নেতৃত্বাধীন বনি ইসরাইল সম্প্রদায়কে আল্লাহ একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে গরু জবাই করার আদেশ দিয়েছিলেন বলে উল্লেখ আছে, তার সঙ্গে তাওরাতের লাল গরুর বৈশিষ্ট্যের মিল আছে। সুরা বাকারার ৬৭ থেকে ৭১ নম্বর আয়াতে বলা আছে:
‘স্মরণ কর, যখন মূসা (আ.) স্বীয় সম্প্রদায়কে বলেছিল, “আল্লাহ তোমাদেরকে একটি গরু যবহ করার আদেশ দিচ্ছেন”; তারা বলেছিল, “তুমি কি আমাদের সঙ্গে ঠাট্টা করছো?” মূসা বলল, “আল্লাহর আশ্রয় নিচ্ছি, যাতে আমি অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত না হই।”
তারা বলল, “আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বল তা কীরূপ?” মূসা বলল, “আল্লাহ বলেছেন, তা এমন এক গরু যা বৃদ্ধও নয় এবং অল্প বয়স্কও নয়- মধ্য বয়সী। সুতরাং যা (করতে) আদিষ্ট হয়েছ, তা পালন কর।”
তারা বলল, “আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বল, ওর রং কী?” মূসা বলল, “আল্লাহ বলছেন, তা হলুদ বর্ণের গরু, তার রং উজ্জ্বল গাঢ়, যা দর্শকদেরকে আনন্দ দেয়।”
তারা বলল, “আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বল গরুটি কেমন? কারণ সব গরু আমাদের কাছে সমান, আর আল্লাহ ইচ্ছা করলে নিশ্চয় আমরা পথের দিশা পাব।”
মূসা বলল, “তিনি বলছেন, তা এমন এক গরু যা জমি চাষে ও ক্ষেতে পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত হয়নি বরং সুস্থ ও নিখুঁত।” তারা বলল, “এখন তুমি সত্য প্রকাশ করেছ।” তারা তাকে যবহ করল যদিও তাদের জন্য সেটা প্রায় অসম্ভব ছিল।
তবে কোরআনে বর্ণিত গরুটির গায়ের রং লাল নয়, সেটির রং হলুদ।
যেহেতু এতদিন সেই লাল গরু পাওয়া যায়নি, সেহেতু ইহুদি সম্প্রদায় থার্ড টেম্পল বানানোর কাজে হাত দেওয়ার উপযোগী পবিত্র হতে পারেনি। তবে লাল গরুর অনুসন্ধান থেমে থাকেনি।
লাল গরু পাওয়া গেছে!
কোথাও লাল গরুর সন্ধান পেলে টেম্পল ইনস্টিটিউট সেগুলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করে তারা নিশ্চিত হতে চায় সেটি আসলেই সেই লাল গরু কি না। এতদিন পর্যন্ত কোনো গরুকেই কাঙ্ক্ষিত গরু বলে তারা নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে এখন তারা বলছে, সেই গরু তারা পেয়ে গেছে।
ওপরে উল্লেখিত এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বোনেহ্ ইসরায়েল নামের সংগঠনটি গত বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঁচটি লাল গরু আমদানি করেছে। সংগঠনটির মুখপাত্র হাইম বারকোভিতস বলেছেন, আল-আকসা মসজিদের অদূরেই জাবাল উজ জয়তুন বা মাউন্ট অলিভ এলাকায় একটি খামারে গরুগুলোকে রাখা হয়েছে।
হামাসের হামলার মূল কারণ থার্ড টেম্পল!
আগামী বছরের ২২ থেকে ২৯ এপ্রিল ইহুদিদের পেসাখ উৎসব বা পাসওভার ফেস্টিভ্যাল। মিসরের জালিম শাসক ফেরাউনের কবল থেকে যেদিন ইহুদিরা মুক্তি পেয়ে তাঁদের পূর্বপুরুষদের আবাসস্থল জেরুজালেমের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল, সেই দিনকে মুক্তি দিবস হিসেবে স্মরণে রেখে তারা এক সপ্তাহ ব্যাপী উৎসব উদযাপন করে।
গত ৪ নভেম্বর মিডল ইস্ট আই বিখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড হার্স্টের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন ওয়ার: হাউ হামাস সিইস দ্য গাজা কনফ্লিক্ট আনফোল্ডিং অ্যান্ড হোয়াই ইট থিংকস ইট ক্যান উইন’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হামাসের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে খবর ছিল, আগামী বছরের এপ্রিলে যে পাসওভার বা পেসাখ উৎসব হবে, সে সময়ই আল আকসার নিকটস্থ মাউন্ট অলিভ এলাকায় আমেরিকা থেকে আনা লাল গরুগুলো বলি দেওয়া হবে। সেই গরুর দেহ পোড়ানো ছাই দিয়ে শুচিকরণ পানি প্রস্তুত করে ইহুদি যাজকদের পবিত্র করা হবে। সেটি করা হয়ে গেলে থার্ড টেম্পল নির্মানের পথে ধর্মীয় কোনো বাধা থাকবে না।
যেহেতু আল আকসা মসজিদ ফিলিস্তিনিদের কাছে তাদের আত্মপরিচয়ের প্রধান প্রতীক এবং সমগ্র মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ, সেহেতু সেটিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষায় মরিয়া হয়েই হামাস ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে।
হামাসের একটি সূত্র মিডল ইস্ট আইকে বলেছে, সংগঠনটির সামরিক শাখা ইজ আল দ্বীন আল কাসেম ব্রিগেডের প্রধান মোহাম্মাদ দেইফ তাদের দোহাভিত্তিক রাজনৈতিক শাখার প্রধানকে না জানিয়েই এই হামলা চালিয়েছেন।
হামাস মনে করে, ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস পশ্চিমা এবং ইসরায়েলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে গদিতে আছেন। তিনি বা তাঁর দল ফাতাহ ইহুদিদের থার্ড টেম্পল নির্মাণে বাধা দেবে না। কিন্তু হামাস বসে থাকতে পারে না। এ কারণে তারা বহু প্রাণহানি হবে জেনেও আল আকসাকে রক্ষা করতে ৭ অক্টোবর হামলা চালিয়েছে। আর হামাসকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে আল আকসা দখল নির্বিঘ্ন করতে ইসরায়েল গাজায় এখন গণহত্যা চালাচ্ছে।
মিডল ইস্ট আই-এর ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, একটি সূত্র তাদের জানিয়েছে, আল-আকসাকে ইতিমধ্যেই কার্যত দুই ভাগ করে ফেলা হয়েছে। মুসলমানেরা সেখানে যেমন নামাজ আদায় করে, তেমনি বসতি স্থাপনকারী ইহুদিরা ওই কম্পাউন্ডে ‘সবজি বলি’ দিয়ে থাকে। গত মাসেও ইহুদিদের ছুটির দিন সুখোট ডেতে পাম গাছের শাখা নিয়ে আল আকসা চত্তরে কয়েক ডজন ইহুদি ঢুকেছিলেন।
সূত্রটি বলেছে, থার্ড টেম্পল নির্মানের আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা লাল গরু বলি দেওয়াই বাকি আছে। যদি তারা এটি করতে পারে, তাহলে সেটি হবে থার্ড টেম্পল পুনর্নির্মাণের সবুজ সংকেত।
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তেল আবিবের কাছে একদল উগ্র ইহুদি জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী ধর্মপ্রাণ ইহুদিদের নিয়ে নিয়মিত বিশেষ প্রার্থনা সংগীতের মহড়া দিচ্ছে। থার্ড টেম্পল নির্মাণের কাজ শুরুর সময় এই সংগীত গাওয়া হবে।
এই সম্মিলিত প্রার্থনাগীতির অন্যতম আয়োজক শামুয়েল কাম এএফপিকে বলেছেন, তাঁরা দুই হাজার বছর ধরে অপেক্ষা করছেন। সেই অপেক্ষা শেষ হতে চলেছে। তিনি বলেছেন, প্রাচীন সোলাইমানি মন্দিরে ইহুদিদের একটি গোষ্ঠী প্রার্থনাগীতি গাইত। সেই গোষ্ঠীর নাম ছিল লেভি। শামুয়েল নিজেকে সেই প্রাচীন লেভি গোষ্ঠীর বংশধর বলে দাবি করেছেন।
এই প্রার্থনাগীতির প্রশিক্ষক মেনাহেম রোজেনথাল বলেছেন, ‘মন্দির যখন প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন আমরা সব লেভি ইহুদিদের মন্দিরে এসে গান গাওয়ার জন্য ডাকব। তার আগে সবাইকে এই প্রার্থনাগীতি গাওয়া শেখাচ্ছি।’
বোনেহ্ ইসরায়েলের মুখপাত্র হাইম বারকোভিতস বলেন, ‘আপনি এটি নিয়ে যা ইচ্ছা বলতে পারেন। আমরা মনে করি, এটি ইহুদিদের জায়গা এবং এখানেই (আল-আকসা মসজিদ) আমরা তৃতীয় মন্দির বানাব। এটি এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।’
ইসরায়েলের গণতন্ত্র সুরক্ষার পক্ষে কাজ করে থাকে ‘কেসেভ সেন্টার ফর দ্য প্রোটেকশন অব ডেমোক্রেসি ইন ইসরায়েল’ নামের একটি সংগঠন। এটির পরিচালক জিজহার বিয়ার বলেছেন, এই ‘থার্ড টেম্পলপ্রেমীদের’ সংখ্যা মোটেও উপেক্ষা করার মতো নয়।
তাদের প্রভাব এখন রাজনীতির কেন্দ্রস্থল পার্লামেন্ট থেকে একেবারে সরকারে গিয়ে পৌঁছেছে। তিনি বলেছেন, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বর্তমান মন্ত্রিসভায় বেশ কয়েকজন নেতা আছেন, যাঁরা আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েলি সার্বভৌমত্ব চাপিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা-তদবির করে যাচ্ছেন।
আল-আকসায় ইহুদিদের আনাগোনা বেড়েছে
১৯৬৭ সালে ছয় দিন ধরে আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের যে যুদ্ধ হয়েছিল, সেই যুদ্ধের পর করা চুক্তিতে বলা হয়েছিল, আল-আকসা মসজিদ চত্ত্বরের ভেতরের অংশের দেখভালের দায়িত্বে থাকবে জর্ডানের ওয়াক্ফ ইসলামিক অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিল। আর এর বাইরের এলাকার নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইসরায়েলের হাতে। মুসলমানরা এই মসজিদে নামাজ পড়তে পারবে। ইহুদিরা এখানে সপ্তাহের নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট সংখ্যায় দর্শনার্থী হিসেবে মসজিদ কম্পাউন্ডে ঢুকতে পারবে। কিন্তু তারা প্রার্থনা করার অনুমতি পাবে না।
নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত সব ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু এর পর থেকে ইহুদিদের অনুপ্রবেশ বেড়ে গেছে। আল জাজিরার একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, এখন প্রায় প্রতিদিনই মসজিদ চত্ত্বরে ইহুদিরা নিরাপত্তারক্ষীদের উপস্থিতিতেই ঢুকে সেখানে প্রার্থনা করছেন।
গত বছর রাব্বিদের (ইহুদি ধর্মগুরু) নেতৃত্বে ৫০ হাজার ইহুদি আল-আকসায় ঢুকে সমবেত হয়েছিল। তাদের মধ্যে চরম দক্ষিণপন্থী ইহুদি জাতীয়তাবাদী নেতা ও ইসরায়েলের বর্তমান নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গ্যাভিরও ছিলেন। চলতি বছর তিনি আরও দুবার আল-আকসায় ঢুকেছেন।
যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ ও ইইউ—সবাই ইসরায়েলিদের চুক্তির শর্ত মানার আহ্বান জানানোর পরও এ বিষয়ে তারা কান দিচ্ছে না। কেসেভ সেন্টার ফর দ্য প্রোটেকশন অব ডেমোক্রেসি ইন ইসরায়েলের মুখপাত্র জিজহার বিয়ার বলেছেন, কট্টর ইহুদিদের এভাবে আল-আকসায় ঘন ঘন অনুপ্রবেশের কারণে তাঁদের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের বড় ধরনের সংঘাত বেধে যেতে পারে।
টেম্পল ইনস্টিটিউটের প্রধান মুখপাত্র ইৎচ্যাক রিউভেন বলেছেন, ‘আমরা এখানে (জেরুজালেম) আসতে পারব, এটি আমাদের কাছে একসময় স্বপ্ন ছিল। আমরা ইসরায়েলে ফিরতে পারব, এটা একসময় আমাদের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এখন এটি বাস্তব হয়েছে। এখানে ঈশ্বরের উপাসনালয় হবে—এটি এখনো আমাদের স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্নও বাস্তব হবে।’
জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তর ও নেতানিয়াহুর ভাষণ
আল-আকসা দখল ও জেরুজালেমে ইসরায়েলের পূর্ণ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় অনুমোদন দেওয়ার বিষয়ে ওয়াশিংটন এ পর্যন্ত যত কাজ করেছে, তার মধ্যে প্রধান হলো মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে সরিয়ে জেরুজালেমে নিয়ে আসা।
এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প নিজে ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানদের পৃষ্ঠপোষক। তাঁর মেয়ে ইভাঙ্কা ট্রাম্পের স্বামী জ্যারেড কুশনার একজন জায়নবাদের সমর্থক ইহুদি। জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের ক্ষেত্রে কুশনারের বিশেষ ভূমিকা ছিল।
দূতাবাস উদ্বোধন উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এ কারণে বারবার ট্রাম্প ও কুশনারকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন।
২০১৮ সালের ১৪ মে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আল-আকসার স্থলে থার্ড টেম্পল বানানোর কথা সরাসরি বলেননি। তবে এ বিষয়ে তিনি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়েছেন।
তিনি তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ( টাইমস অব ইসরায়েল–এ প্রকাশিত নেতানিয়াহুর ভাষণের পূর্ণাঙ্গ টেক্সট):
‘এই জেরুজালেমে আব্রাহাম [ইসলামে যিনি পয়গম্বর ইব্রাহিম (আ.) ] ইমানের পরীক্ষায় পাস করেছিলেন এবং আমাদের জাতির পিতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
এই জেরুজালেমে কিং ডেভিড [ইসলামে যিনি পয়গম্বর দাউদ (আ.) ] তিন হাজার বছর আগে আমাদের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এই জেরুজালেমে কিং সলোমন [ইসলামে যিনি পয়গম্বর সোলাইমান (আ.) ] আমাদের মন্দির (সোলাইমানি মন্দির) গড়েছিলেন, যা বহু শতাব্দী টিকে ছিল।
এই জেরুজালেমে ব্যাবিলনে নির্বাসিত ইহুদিরা ফিরে এসে (ধ্বংস হওয়া) মন্দির পুনঃস্থাপন করেছিল, যা আরও বহু শতাব্দী টিকে ছিল।
এই জেরুজালেমে মাকাবিরা (ইহুদিদের প্রাচীন একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী) আবার ধ্বংস হওয়া সেই মন্দিরকে পুনঃস্থাপন করেছিল এবং এই ভূমিতেই ইহুদি সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল।
এরও প্রায় দুই হাজার বছর পরে এখানেই, এই জেরুজালেমে ইসরায়েলের সেনারা তিনটি অমর শব্দ বলেছিল, “হার হাবাইত বেয়াদেইনু” (টেম্পল মাউন্ট আমাদের হাতে)। এই শব্দগুলো সমগ্র ইহুদি জাতির আত্মাকে উদ্দীপ্ত করেছিল।
আজ আমরা সেই জেরুজালেমে একত্র হয়েছি এবং এখানেই আমাদের থাকতে হবে।’
এই যখন বাস্তবতা, তখন আল-আকসা মসজিদের অস্তিত্ব নিয়ে মুসলিম বিশ্বের উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক