সোমবার দুপুরে মাত্র ১১ মিনিটে মতিঝিল থেকে কারওয়ানবাজার পৌঁছে গেলাম। ভাড়া লাগল ২৭ টাকা। আগের দিন সন্ধ্যায় ৫০০ টাকা দিয়ে কিনে রেখেছিলাম এমআরটি কার্ড। তাই লাইনে দিয়ে টিকিট কাটার সময় বেঁচে গেল।
মেট্রোর স্টেশনে ঢুকে সরাসরি প্ল্যাটফর্মে। বেশ ফাঁকাই ছিল। আরাম করে বসলাম। পরের স্টেশন সচিবালয় থেকে বেশ কিছু যাত্রী উঠলেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন থেকে উঠলেন তরুণ-তরুণীরা। ততক্ষণে কোনো আসন আর অবশিষ্ট নেই। দাঁড়িয়ে গেলেও তাঁদের চোখেমুখে আনন্দই দেখলাম।
মনে পড়ল, আড়াই দশক আগে যখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম, তখন ঢাকার মধ্যে দূরের পথে যেতে বাস ছাড়া কম পয়সায় আমাদের আর কোনো বিকল্প গণপরিবহন ছিল না। তখন নীলক্ষেত থেকে মিরপুর-১০, ১১, সাড়ে ১১ পর্যন্ত যেতে বাসভাড়া লাগত তিন টাকা বা সাড়ে তিন টাকা। তখন অবশ্য এই টাকাটাই অনেক বেশি মনে হতো। যানজট তখনো ছিল, তবে এখনকার মতো প্রকট হয়তো নয়।
সবাই বলছেন, মেট্রোরেল রাজধানীবাসীর জন্য আশীর্বাদ। আমরাও তা–ই বলি। যাঁরা এই মেট্রোতে ভ্রমণ করেছেন, সবাই তা–ই বলবেন। এখন মনে হয়, আরও আগে কেন এই শহরে মেট্রোরেল হলো না। পাশের দেশের কলকাতায়ও মেট্রো হয়েছে কত আগে! আক্ষেপ করে আর কী হবে! তবু তো হলো। সামনে মেট্রোরেল কমলাপুর পর্যন্ত যাবে। তবে এই নগরীর যতটা বেশি সম্ভব এলাকা মেট্রোরেল কভার করতে পারবে, ততই এর উদ্দেশ্য-বিধেয় ফলপ্রসূ হবে। বিশেষ করে রাজধানীর পূর্বাঞ্চলকে এর সঙ্গে যুক্ত করা খুব জরুরি। কারণ, এলাকাটা ঘনবসতিপূর্ণ এবং বঞ্চিত।
আশা করা যায়, ঢাকার পরে একদিন চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনার মতো বড় বড় শহরেও মেট্রোরেল চলবে।
মেট্রোরেলের ভাড়া নিয়ে অনেকেই কথাবার্তা বলছেন। তাঁদের কথা, ভাড়া আরেকটু কম হতে পারত কি না। কিন্তু মানবজীবনের জরুরি সময় নষ্ট হওয়া থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে, দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো যাচ্ছে, সেটাও তো কম নয়। তারপরও যদি কিছু করার থাকে, কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় তা পর্যালোচনা করে দেখবে।
২.
বাস্তবতা হলো, রাজধানীতে যতই মেট্রোরেল চালু হোক, গণপরিবহন হিসেবে এখনো বাসের ওপর নির্ভরশীল বেশির ভাগ যাত্রী। সামনেও তা–ই থাকবে বলে প্রতীয়মান হয়। কারণ, এই শহরের জনসংখ্যা দুই কোটি। এই জনসংখ্যা কমার কোনো লক্ষণ নেই। পদ্মা সেতু, বিআরটি প্রকল্প ঢাকামুখী জনস্রোত বন্ধ করতে পারছে না। ভবিষ্যতে পারবে বলেও মালুম হয় না।
এখন জরুরি প্রশ্ন হলো, মেট্রোরেলের এই যুগে রাজধানীর বাসসেবা যে অন্ধকার কানাগলিতে ছিল, সেখানেই থাকবে নাকি আলো আসবে? পরিবর্তন কিছু আসবে?
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বা বিআরটিএর এক হিসাব বলছে, রাজধানীতে চলাচল করা বাসগুলোর পাঁচটির মধ্যে একটি আনফিট। এই সংস্থার হিসাবে, ঢাকায় ৭৫টি কোম্পানির ৩৯৭৪টি বাস চলাচল করে। কিন্তু পরিবহন খাতের ভেতরের তথ্য বলছে, অন্তত ১২০টি কোম্পানির পাঁচ হাজারের বেশি বাস ঢাকায় চলাচল করে। এর অর্থ হলো, হিসাবের বাইরে থাকা বাসের বেশির ভাগই লক্কড়ঝক্কড়। এরা সড়কে চলছে অবৈধভাবে, ওপরের কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে। অথচ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
আর এসব বাসে করে প্রাণটা হাতের মুঠোয় নিয়ে চলাচল করছেন এ শহরের বাসিন্দারা। নিজস্ব পর্যবেক্ষণে বলছি, এসব বাসের বেশির ভাগ চালক ও তাঁদের সহকারীরা ছোকরা ধরনের। ঘুম, খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে ন্যূনতম কোনো স্বাভাবিক, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন তাঁদের নেই। এর প্রভাব পড়ে তাঁদের আচরণে।
যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, বিশেষ করে নারীদের সঙ্গে, প্রায় রোজকার ঘটনা। আর এসব বাসের ভেতরটাও থাকে অপরিষ্কার। সিট কভার লাগানোর পর আর ধোয়া বা পরিষ্কার করা হয় বলে মনে হয় না। তেল চিটচিটে দাগ এবং এ থেকে আসা দুর্গন্ধে শরীর গুলিয়ে ওঠে। তবু যাত্রীরা নিরুপায়। কারও কাছে তাঁদের অভিযোগ দেওয়ার নেই। কিছু বলতে গেলে উল্টো নাজেহাল হওয়ার ঝুঁকি। এর চেয়ে নাকমুখ চেপে বসে থেকে কোনোমতে নামতে পারলেই স্বস্তি।
আমাদের গণপরিবহনের এমন দশা হবে না কেন? কারণ, আমাদের মন্ত্রী, এমপি, আমলা, সরকারি দল, বিরোধী দল, বুদ্ধিজীবীদের কেউই এসব গণপরিবহন ব্যবহার তো দূরের কথা, কোনো খবর রাখেন বলে মনে হয় না। যদিও বা কোনো মন্ত্রী-আমলা কোনো দিন গণপরিবহনে ওঠেন, তা লোক দেখানোর জন্য। ক্যামেরার সামনে কথা বলার জন্য। ছদ্মবেশ ধারণ করেও তাঁরা গণপরিবহনে উঠে প্রকৃত চিত্রটা দেখতে পারেন।
শুনেছি, কলকাতার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি থাকা সত্ত্বেও প্রায়ই পাবলিক বাসে ওঠেন। সমাজের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করেন। কিন্তু ঢাকাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীরা কেমন যেন নিষ্প্রভ। এখানকার বুদ্ধিজীবীরা কোনো কিছু করার আগে বা বলার আগে ভাবেন, কার পক্ষে বা বিপক্ষে যাবে। অথচ বইপত্রে পড়েছি, বুদ্ধিজীবীদের অবস্থান হবে সব সময় সত্য, ন্যায় ও প্রগতির পক্ষে। সর্বোপরি মানুষের পক্ষে।
৩.
মেট্রোরেল রাজধানীবাসীকে নতুন অভিজ্ঞতা দিয়েছে। এখন রাজধানীবাসী বাসের মতো অন্যান্য গণপরিবহনসেবার ক্ষেত্রেও নতুন অভিজ্ঞতা পেতে চায়।
রাজধানীতে পচাগলা, ভাঙাচোরা, নোংরা-অপরিষ্কার বাস তুলে দেওয়ার সময় এসেছে। যুক্ত করতে হবে নতুন বাস, যে বাস বেশিসংখ্যক যাত্রী পরিবহন করতে পারে। বাসে উঠে নাগরিকদের যেন গুড ফিল বা ভালো অনুভূতি হয়, তারা যেন নিজেদের বঞ্চিত মনে না করে। এ ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থাকেই প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ, জনগণের কর্তব্যকাজে সরকারের ভূমিকাই প্রধান।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মধ্য দিয়েও নতুন বাস আনা ও পরিচালনার কাজ করা যেতে পারে। কোনো কিছু না করাটা বড্ড বেমানান হবে। মেট্রোরেলের যুগে ঢাকার বাসসেবায় ‘আঁধার’ কেটে যাক, এই প্রত্যাশায় এখানেই শেষ করলাম।
কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
[email protected]