ভারতের নীতিতে আওয়ামী লীগ–নির্ভরতা ও অপতথ্যের রাজনীতি

ভারতের নীতিনির্ধারকদের মনে রাখা উচিত, আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা মানেই বাংলাদেশ নয়­প্রথম আলো

কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিটি সার্বভৌম দেশ ১৯৬১ সালে গৃহীত ভিয়েনা কনভেনশন মেনে চলে। এই কনভেনশনে গৃহীত সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং আইনসিদ্ধ (লিগ্যালি বাইন্ডিং)। ভিয়েনা কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ৫–এর ৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী, রাষ্ট্রদূত বা দূতাবাসের সদস্যরা সে দেশের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত হবেন।

এ ছাড়া অনুচ্ছেদ ২২ অনুযায়ী, দূতাবাসের সীমানায় অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করা যাবে না, যে দেশে দূতাবাস থাকবে, সে দেশের দায়িত্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এমনকি দূতাবাসের ভবন, আসবাব ও অন্যান্য সম্পত্তি এবং যানবাহনে কোনো তল্লাশি বা অভিযান চালানো যাবে না। 

সম্প্রতি ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে যে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে, তা ওপরে উল্লেখ করা অনুচ্ছেদগুলোর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ভারত সরকারের বাংলাদেশ দূতাবাসে হামলা প্রতিরোধ করতে না পারা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত না করতে পারার মাধ্যমে ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘিত হয়েছে। 

এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিবাহিনী পাঠানোর আরজি জানিয়েছেন। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়েছে। এমনকি সীমান্তের কাছে এসে বিক্ষোভ করা হচ্ছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ–বিদ্বেষ উত্থানের পেছনের কারণ এবং কেন ভারতের রাজনীতিবিদেরা কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ করছেন, তা বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। 

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই ভারতীয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং ভারত থেকে পরিচালিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশে ঘটা বিভিন্ন ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে বা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও অপতথ্য প্রচার করা হচ্ছে। এসব অপপ্রচারের শীর্ষে রয়েছে ‘রিপাবলিক বাংলা’ নামের একটি সংবাদমাধ্যম।

গত ১২ নভেম্বর এই চ্যানেলে ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ নামের এক উপস্থাপক চট্টগ্রামকে ভারতের অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে দাবি তোলেন। রিপাবলিক বাংলা থেকে আরও গুজব ছড়ানো হয় যে বাংলাদেশে ভারতের স্যাটেলাইট চ্যানেলের প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে।

মনগড়া ও ভুয়া খবরের আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে ক্যালকাটা নিউজ থেকে ছড়ানো অপতথ্য, যেখানে বলা হয়েছে ভারত ও চীনের কাছাকাছি অঞ্চল, যা চিকেন নেক নামে পরিচিত, সেখানে চীনের সহায়তায় বিমানঘাঁটি তৈরি করছে বাংলাদেশ। 

আরও পড়ুন

মূলধারার মিডিয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, বিশেষ করে টুইটারেও গুজব ছড়াতে দেখা গেছে। ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান ডিসমিস ল্যাবের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘বাবা বানারস’ নামে একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে ‘চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর অভিযানে ৫০ জন হিন্দু নিহত ও আহত এবং ৬ জন হিন্দু নারীকে অপহরণ’ করার মিথ্যা অভিযোগ ছড়ানো হয়।

‘বাবা বানারস’–এর মতো অসংখ্য অ্যাকাউন্ট থেকে টুইটার, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ও টেলিগ্রামে ভুয়া খবর ছড়িয়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের মিথ্যা বয়ান তৈরি করা হচ্ছে।

গত ২৬ নভেম্বর আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে হত্যার পর তাঁকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর আইনজীবী হিসেবে ভুল ও অপতথ্য প্রচার করে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, হিন্দুস্তান টাইমসসহ অসংখ্য ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। 

এর আগে ৫ আগস্টের পরে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের উদ্দেশ্যে ভারতের বিভিন্ন মিডিয়া ও বিভিন্ন ব্যক্তির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হিন্দুদের বাড়িঘর-মন্দিরে হামলার ঘটনাগুলোকে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরোনো ঘটনাকে নতুন বলে প্রচার করে, অন্য দেশের বা অন্য ঘটনার অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও ও ছবি ব্যবহার করে ভুয়া ও অপতথ্য চালানো হয়।

ডয়চে ভেলে (৭ আগস্ট ২০২৪) ও বিবিসি বাংলার (১১ আগস্ট ২০২৪) অনুসন্ধানে দেখা যায়, মন্দিরে, দোকানপাটে হামলা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার অসংখ্য মিথ্যা দাবি ও ভুয়া তথ্য প্রচার করা হয়। 

এসব ভুয়া, অতিরঞ্জিত ও অপতথ্য প্রচারের কারণে একদিকে যেমন ঘৃণার পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তেমনি সত্যিকারের ঘটনাগুলোও তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে।

পুরো বিশ্বে ভারত অপতথ্য ও ভুয়া তথ্যের ফলে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে নিয়ে যে অপতথ্য ও ভুল তথ্য ভারতে প্রচার করা হচ্ছে, তা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে দেশটির রাজনীতিবিদ, নাগরিক সমাজ ও জনগণকেও প্রভাবিত করছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য ও সহকারী দূতাবাসে হামলা এই বিদ্বেষেরই ফলাফল। অপতথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন যে শুধু ভারতের জনগণ ও রাজনীতিবিদদের কাছেই যাচ্ছে তা নয়, বিশ্বের নানা দেশের আইনপ্রণেতাদেরও বিভ্রান্ত করছে। 

আরও পড়ুন

ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের পেছনে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতের বাংলাদেশ নীতিতে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার প্রভাব। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে যে ভারত শুধু শেখ হাসিনাকে আশ্রয়ই দেয়নি, সেই সঙ্গে শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের প্রচারিত বয়ানগুলোকেই আঁকড়ে ধরে আছে। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি যাঁরা নেন, তাঁদের বুঝতে হবে যে বাংলাদেশের মানুষ একটি স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়েছে।

শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ প্রচারিত বয়ান এখন বাংলাদেশের জন–আকাঙ্ক্ষার বিরোধী। তাই শুধু আওয়ামী লীগের সঙ্গে বন্ধুত্বের ওপর যে পররাষ্ট্রনীতি প্রতিষ্ঠিত, তার ওপরে ভর করে কখনোই ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করতে পারবে না। বরং ভারত একটি ঝুড়িতে সব ডিম না রেখে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিতে সচেষ্ট হতে পারে। 

ভারতের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নকারীদের মনে রাখতে হবে, একটি অস্থিতিশীল ও ভারতবিরোধী বাংলাদেশ ভারতের নিজের ভূরাজনীতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা মানেই বাংলাদেশ নয়। বরং বাংলাদেশ একটি বিস্তৃত, বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বহুমতের দেশ, যেখানে নানা রাজনৈতিক বিশ্বাসের মানুষ বাস করে। শুধু একটি রাজনৈতিক দলের ওপর নির্ভরতা শুধু বিপজ্জনক নয়, বরং একটি অযৌক্তিক, অলস এবং অকার্যকর পররাষ্ট্রনীতিরই উদাহরণ। 

বাংলাদেশের ভেতরে সংঘটিত সহিংসতা ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ভারত তার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ, দূতাবাসে হামলা, জাতিসংঘ শান্তিবাহিনী প্রেরণের মতো হঠকারী মন্তব্য দুই দেশের সম্পর্ককে আরও তিক্ত করে তুলবে।

ভারতের রাজনীতিবিদদের নিজেদেরও মনে রাখা উচিত, সে দেশেও সংখ্যালঘুরা ভালো নেই। শিখ, খ্রিষ্টান, মুসলমান ও দলিত সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনা, মসজিদ, টেম্পল ও চার্চে হামলার ঘটনা ভারতে বাড়ছে। কাশ্মীরের মুসলমান ও মণিপুরের খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠীর ওপরে নানা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বিশ্বের নানা গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। ভারতের দেখানো পথ অনুযায়ী যদি বাংলাদেশ এসব ঘটনার আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেটা কি ভারতের জন্য কাঙ্ক্ষিত হবে?

ভারতের রাজনীতির ভোটের খেলায় বাংলাদেশ যেন দাবার ঘুঁটি না হয়। বরং আওয়ামী লীগ–নির্ভরতা ছেড়ে ভারতের বাংলাদেশ নীতি বাংলাদেশকেন্দ্রিক হয়ে উঠুক। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত্তি হোক পারস্পরিক আস্থা, বন্ধুত্ব ও সমতা। 

সাইমুম পারভেজ জার্মানির ডয়চে ভেলে একাডেমি ও বন রাইন-জিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক যোগাযোগবিষয়ক শিক্ষক