সিরিয়ার উইঘুর যোদ্ধারা যেভাবে চীনের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে

‘তাঁরা আগে পূর্ব তুর্কিস্তান ইসলামিক আন্দোলন নামে চীনের সঙ্গে লড়াই করত। কয়েক বছর আগে তাঁরা তাঁদের সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে রেখেছেন তুর্কিস্থান ইসলামিক পার্টি।’

তুরস্ক-সমর্থিত হায়াত তাহির আল-শামের (এইচটিএস) আক্রমণে সিরিয়ান আরব আর্মির দ্রুত পতন ঘটেছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এইচটিএসকে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই গোষ্ঠীটি বিদেশি যোদ্ধাদেরও টেনে আনতে পেরেছে।

বিদেশি যোদ্ধাদের মধ্যে সবার আগে আসবে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর যোদ্ধাদের নাম। তাঁরা একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের জন্য লড়াই করছেন। তাঁরা আগে পূর্ব তুর্কিস্তান ইসলামিক আন্দোলন নামে চীনের সঙ্গে লড়াই করত। কয়েক বছর আগে তাঁরা তাঁদের সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে রেখেছেন তুর্কিস্থান ইসলামিক পার্টি।

যে নামেই হোক না কেন, সশস্ত্র এই গোষ্ঠীটি সিরিয়ার ইদলিবে ২০১৭ সাল থেকেই সম্পৃক্ত রয়েছে। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, এই গোষ্ঠীটি একসময় আল-কায়েদার মতো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চীন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উইঘুর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল।

সে কারণে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ তাদের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা থেকে তাদেরকে বাদ দিয়েছিল। এর কারণ হিসেবে দেখিয়েছিল এই গোষ্ঠীটি নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা যে সত্য নয়, এবার তা জানা গেল।

সিরিয়া থেকে এই গোষ্ঠীটির সদস্যরা চীনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদের ডাক দিয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় হচ্ছে, তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি মধ্য এশিয়া থেকে সদস্য নিয়োগ করছে এবং তারা আফগানিস্তানে আবার সংগঠিত হতে পারে, যাতে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরে আক্রমণ চালাতে পারে।

এই করিডরটি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড মহাপরিকল্পনার পতাকাবাহী প্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কয়েক বছর ধরে এই করিডরটি বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মির (বিএলএ) আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে আসছে।

পাকিস্তান, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকাভুক্ত করেছে। আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে বিএলএ তাদের আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়েছে। তারা তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানকেও আশ্রয় দিয়েছে।

বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি এবং তেহরিক-ই-তালেবানকে এখন অপ্রাতিষ্ঠানিক মিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দুইয়ের উদ্দেশ্য হলো পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ক্ষতি করা। বিএলএ বেলুচিস্তানকে স্বাধীন করতে চায় এবং টিটিপি চায় একটি ধর্মভিত্তিক একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা।

চীনের সঙ্গে আফগান তালেবানের ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। সে কারণে তারা তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টিকে আফগানিস্তানে স্বাগত না–ও জানাতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আফগান তালেবানদের আফগানিস্তানের সব ভূখণ্ডের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেই। আইআইএস–কের অস্তিত্বে সেটা প্রমাণ করে। আগেও আইএসআইএস–কে তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টিকে আশ্রয় দিয়েছিল।

চীনের সঙ্গে আফগান তালেবানের ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। সে কারণে তারা তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টিকে আফগানিস্তানে স্বাগত না–ও জানাতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আফগান তালেবানদের আফগানিস্তানের সব ভূখণ্ডের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেই। আইআইএস–কের অস্তিত্বে সেটা প্রমাণ করে। আগেও আইএসআইএস–কে তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টিকে আশ্রয় দিয়েছিল।

ফলে এমন সম্ভাবনাও আছে যে তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি আফগানিস্তানে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারে। সেখান থেকে তারা চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরে আক্রমণ করতে পারে, যেমনটা এখন আফগানিস্তানে ঘাঁটি গাড়া বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি করছে।

বেলুচিস্তান লিবারেশন পার্টি চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরে হামলা করছে অতিজাতীয়তাবাদী উদ্দেশ্য থেকে। তাদের দাবি হলো এই মেগা প্রকল্পে বেলুচদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। বেলুচিস্তান থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ পাচারের উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি করা হচ্ছে।

অন্যদিকে তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি সুবিধা বুঝে সহজ লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ করতে পারে। এর মাধ্যমে তারা তাদের সংগঠনের অবস্থান সংহত করতে পারে।

পাকিস্তানের বাইরে মধ্য এশিয়াতেও তাদের প্রাসঙ্গিকতা আছে। কারণ হলো হায়াত তাহির আল-শামে বিদেশি যোদ্ধাদের মধ্যে উজবেকরাও রয়েছেন। মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী হলো উজবেক।

কাজাখস্তান ও চির অস্থিতিশীল কিরগিজস্তানেও উইঘুর জনগোষ্ঠী আছে। তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি তাদের সংগঠনে এ দেশ দুটি থেকেও সদস্য রিক্রুট করার উদ্যোগ নিতে পারে।

এই বিশ্বাসযোগ্য সম্ভাবনাগুলো দেখায় যে তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি শুধু চীনের জিনজিয়াংয়ের ওপর হুমকি তৈরি করবে না। সম্ভাবনাগুলো হায়াত তাহির আল-শামের সঙ্গে তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টির জোটকে পরোক্ষ সমর্থন দেওয়া তুরস্কের কৌশল নিয়ে প্রশ্নেরও জন্ম দেয়।

তুরস্ক নিজেকে অর্গানাইজেশন অব টার্কিশ স্টেটসের নেতা বলে মনে করে। এর মধ্যে রয়েছে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তানে ও উজবেকিস্তান। এসব দেশের অনেক নাগরিক সিরিয়ায় এইচটিএসের কাছ থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ পেয়েছে। সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করারও অভিজ্ঞতা তাদের তৈরি হয়েছে। অথচ এসব দেশের নাগরিকেরা যাতে এইচটিএসের সঙ্গে যুক্ত না হতে পারে, সেটা ঠেকাতে পারত তুরস্ক। কিন্তু সেটা তারা করেনি। এ অবস্থান তুর্কি অধ্যুষিত জনগোষ্ঠীর নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে তুরস্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা জিইউআর সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সহযোগিতা দিয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্ট–এর এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিরিয়াজুড়ে এইচটিএসের আক্রমণে জিইউআর ভূমিকা রেখেছে।

অতীতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান নিজেকে উইঘুরদের রাজনৈতিক সংকট থেকে মুক্ত করার একজন সফল নেতা হিসেবে উপস্থাপন করতেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বাস্তববাদী প্রয়োজন থেকে এই ধরনের কথাবার্তা বলা তিনি বন্ধ করেছিলেন।

তিনি যদি এখনই তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টির লাগাম না টেনে ধরতে পারেন, তাহলে এই গোষ্ঠীটিই তাঁর পররাষ্ট্রনীতির জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, এরদোয়ান এ ব্যাপারে কী করতে চলেছেন।

  • আন্ড্রু কোরেবকো আমেরিকান রাজনৈতিক বিশ্লেষক

    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত