যেন বঞ্চনার আরেক নাম রংপুর বিভাগ। দরিদ্র অঞ্চল বলে খ্যাত রংপুরের জন্য প্রতিবছর বাজেটে অন্যান্য খাতের সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে বিশেষ বরাদ্দের দাবি জানানো হলেও বাস্তবে ঘটে ভিন্নতা। গত অর্থবছরের বাজেটে রংপুর বিভাগের অর্থনৈতিক অঞ্চলে কোনো বরাদ্দ রাখা তো হয়ইনি, উল্টো সিটি করপোরেশনের বাজেট ছিল শূন্য।
স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণে এ অঞ্চল বারবার পিছিয়ে থাকছে। বৃহত্তর রংপুর বিভাগের আট জেলার ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের জন্য একমাত্র ভরসাস্থল রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালের রেডিওথেরাপি মেশিন ১০ বছর ধরে নষ্ট থাকায় রোগীরা রেডিওথেরাপি চিকিৎসা না পেয়ে অকালে মারা যাচ্ছেন।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক গবেষণায় দেখা যায়, রংপুরে বিভাগের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলা থেকে ক্যানসারের চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে স্তন ক্যানসারের রোগী ১৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ওভারি বা ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের রোগী ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ, গ্রুপ হিসেবে সবচেয়ে বেশি খাদ্যনালির ক্যানসারের রোগী ৩১ দশমিক ৯৪ শতাংশ ও শ্বাসতন্ত্রের ক্যানসারের রোগী ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
২০১৫ সালের এপ্রিল মাস থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি মেশিন নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। গত ১০ বছরে মেশিনটি চালু করার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। এ কারণে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীরা রেডিওথেরাপি চিকিৎসা পাচ্ছেন না।
রেডিওথেরাপি মেশিন নষ্ট থাকায় কীভাবে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীরা ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছেন, এর বাস্তব প্রমাণ রোকেয়া বেগম। গত বছর ৬০ বছর বয়সী রোকেয়া বেগম নীলফামারী থেকে জরায়ুমুখ ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগে আসেন। সেখানকার ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তাঁকে পরীক্ষা করে ও যাবতীয় রিপোর্ট পর্যালোচনা করে জানান, তাঁর জরায়ুমুখের ক্যানসার তৃতীয় পর্যায়ে চলে গেছে।
এ অবস্থায় তাঁকে দ্রুত রেডিওথেরাপি দিতে হবে। রোকেয়া বেগমের স্বামী দ্রুত রেডিওথেরাপি শুরু করার অনুরোধ জানান। কিন্তু রেডিওথেরাপি মেশিন নষ্ট থাকায় রংপুরে তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়নি। রেডিওথেরাপি নেওয়ার জন্য রোকেয়া বেগমকে ঢাকার জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রেফার করা হয়।
এরপর রোকেয়া বেগমের স্বামী এলাকার লোকজনের কাছে টাকা ধার করে ঢাকায় যান। সেখানে ভিড় বেশি থাকায় রেডিওথেরাপি দেওয়ার জন্য চার মাস পর সিরিয়াল দেওয়া হয়। রোকেয়া বেগমের স্বামী চিকিৎসকের কাছে জানতে চান, অন্য কোনো চিকিৎসা বা অন্য কোনো জায়গায় রেডিওথেরাপি দেওয়া যায় কি না। চিকিৎসক জানান, বেসরকারি পর্যায়ে দ্রুত রেডিওথেরাপি দেওয়া যায়, কিন্তু সেখানে একবার রেডিওথেরাপি দিতে লাগে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। রোকেয়া বেগমের স্বামীর পক্ষে এত টাকার ব্যয়ভার বহন করা অসম্ভব। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি নীলফামারীতে ফিরে যান, অপেক্ষায় থাকেন সিরিয়ালের। এর মধ্যে রোকেয়া বেগম আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন।
চার মাস অপেক্ষার পর সিরিয়াল আসে রেডিওথেরাপির। রেডিওথেরাপির জন্য রোকেয়া বেগম তখন উপযুক্ত কি না এবং ক্যানসারের পর্যায় নির্ণয় করার জন্য পরীক্ষা করেন চিকিৎসকেরা। পরীক্ষায় দেখা যায়, এই চার মাসে রোকেয়া বেগমের ক্যানসার তৃতীয় থেকে চতুর্থ পর্যায়ে চলে গেছে এবং এ পর্যায়ে রেডিওথেরাপি দেওয়া যায় না।
এরপর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল থেকে রোকেয়া বেগমকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগে কেমোথেরাপি দেওয়ার জন্য রেফার করা হয়। সঠিক সময়ে রেডিওথেরাপি না দেওয়ায় কিছুদিন পর মারা যান রোকেয়া বেগম। অথচ রোকেয়া বেগম হয়তো আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতেন, যদি রংপুরে একটি রেডিওথেরাপি মেশিন থাকত। তাহলে ক্যানসার নির্ণয় হওয়ার পরপরই তিনি রেডিওথেরাপি চিকিৎসা পেতেন এবং আজও পৃথিবীতে বুকভরে শ্বাস নিতে পারতেন।
বৃহত্তর রংপুরের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলার ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের জীবন বাঁচাতে জরুরি ভিত্তিতে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কমপক্ষে দুটি রেডিওথেরাপি মেশিন স্থাপন এবং সার্বক্ষণিক যেন সচল থাকে, সে ব্যবস্থা করা সময়ের দাবি।
ক্যানসারের চিকিৎসা জটিল হওয়ায় কারও ক্যানসার ধরা পড়ার পর রোগী ও রোগীর আত্মীয়স্বজন মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েন। ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য যেসব পরীক্ষা করা হয়, সেগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এরপর ক্যানসার চিকিৎসা, সেটাও বেশ ব্যয়বহুল। যেকোনো ক্যানসারের জন্য চিকিৎসার তিনটি পদ্ধতি আছে—অপারেশন, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি। রেডিওথেরাপি ক্যানসারের একটি অন্যতম চিকিৎসাপদ্ধতি। রেডিওথেরাপি এককভাবে অথবা অপারেশন বা কেমোথেরাপির সঙ্গে যুক্তভাবে ব্যবহার করা হয়। যেসব ক্যানসারের জন্য রেডিওথেরাপি চিকিৎসা জরুরি, সেগুলো হলো মুখের ক্যানসার, গলার ক্যানসার, স্তন ক্যানসার, ব্রেনের ক্যানসার, জরায়ু ও জারায়ুমুখের ক্যানসার, মলদ্বারের ক্যানসার, ফুসফুসের ক্যানসার ও ত্বকের ক্যানসার।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি মেশিন ১০ বছর ধরে অকেজো থাকায় ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীরা সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে এভাবেই রোকেয়া বেগমের মতো বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। রংপুর বিভাগের আট জেলার রোগীদের জন্য নিকটবর্তী হিসেবে বগুড়ায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরকারিভাবে একটি রেডিওথেরাপি মেশিন ছিল; কিন্তু দেড় বছর ধরে সেটিও বিকল হয়ে আছে। তাই বৃহত্তর রংপুরের ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের জন্য একমাত্র ভরসা হলো ঢাকার জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। কিন্তু সেখানে চার থেকে ছয় মাসের আগে সিরিয়াল পাওয়া যায় না। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি রেডিওথেরাপি মেশিন সচল থাকলেও সেখানে রাজশাহীর রোগী অনেক বেশি হওয়ায় বাইরের রোগীরা সুযোগ পান না।
সরকারি পর্যায়ে রেডিওথেরাপির জন্য গড় ব্যয় ৬ থেকে ২০ হাজার টাকা, অন্যদিকে একই রেডিওথেরাপি বেসরকারি পর্যায়ে ১ থেকে ৩ লাখ টাকা। এত উচ্চ ব্যয় ক্যানসারের অধিকাংশ রোগী বহন করতে পারেন না। তাই সরকারি হাসপাতালের সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষা অথবা ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া রংপুরের ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের অন্য কোনো উপায় নেই। বৃহত্তর রংপুরের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলার ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের জীবন বাঁচাতে জরুরি ভিত্তিতে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কমপক্ষে দুটি রেডিওথেরাপি মেশিন স্থাপন এবং সার্বক্ষণিক যেন সচল থাকে, সে ব্যবস্থা করা সময়ের দাবি।
ডা. রতীন্দ্র নাথ মণ্ডল, সহযোগী অধ্যাপক, প্রাইম মেডিকেল কলেজ, রংপুর।