বেলুচিস্তানের ভাড়াটে সশস্ত্র বাহিনীগুলো ওই অঞ্চলের সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে এই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। বেলুচিস্তান প্রদেশের নিরাপত্তানীতির এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বাধাহীন ও বেপরোয়া ক্ষমতাচর্চার সমালোচনা যাঁরা করেন, তাঁরাই এই বাহিনীর লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন।
সম্প্রতি মীর শফিক মেঙ্গলের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সেখানকার শীর্ষ বেলুচ জাতীয়তাবাদী নেতা ও বেলুচিস্তান ন্যাশনাল পাটির (বিএনপি) প্রধান সরদার আখতার জান মেঙ্গলের লোকদের সংঘর্ষ হয়েছে। পাকিস্তানের গণমাধ্যম এ ঘটনাকে মেঙ্গল উপজাতির দুই গোষ্ঠীর মধ্যকার সংঘর্ষ বলে বর্ণনা করেছে। বেলুচিস্তানে এখন যে বাস্তবতা, তাতে এটা বলা ভুল।
২০০৫ সাল থেকে পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশ বেলুচিস্তান বেশ কয়েকটি বেলুচ জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কবলে জর্জরিত। এই সব গোষ্ঠীকে মোকাবিলা করতে ভাড়াটে সশস্ত্র গোষ্ঠী তৈরি করা হয়েছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে বেলুচিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। সেখানে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ও সেনাবাহিনীর কাছে প্রান্তিক হওয়ার এবং অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক নিপীড়নের দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাস রয়েছে বেলুচিস্তানের। এসবের প্রতিক্রিয়ায় বেলুচ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিকাশ হয়েছে। তারা আরও স্বায়ত্তশাসন ও নিজেদের সম্পদের ওপর আরও নিয়ন্ত্রণ দাবি করে আসছেন।
বেলুচ নেতা নওয়াব আকবর খান বুগতি হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় সেখানে বেলুচিস্তানে বিদ্রোহ গতি পায়। এই বিদ্রোহীদের দমাতে অনেকগুলো ভাড়াটে সশস্ত্র গোষ্ঠী তৈরি করা হয়েছে।
এ সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেলুচিস্তানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে দিচ্ছে। সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, আন্দোলনকর্মীদের মধ্যে যাঁরা সেখানকার সহিংসতা ও বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মানবাধিকার বিষয়ে কথা বলতে সাহস দেখান, তাঁদের নানা ধরনের হেনস্তা, ভীতি প্রদর্শন, এমনকি শারীরিক আক্রমণের শিকার হতে হয়। এতে অনেকের মৃত্যুও হয়।
ভাড়াটে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ‘ডেথ স্কোয়াড’ বলে পরিচিত। বেলুচ ভিন্নমতাবলম্বীদের গণহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নির্যাতন ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য এই ভাড়াটে বাহিনীগুলোকে দায়ী করা হয়। রাষ্ট্রীয় আইনের বাইরে, অর্থাৎ বেআইনিভাবে এই বাহিনীগুলো পরিচালিত হয়। তাদের এ কর্মকাণ্ডের জন্য খুব কমই জবাবদিহি করতে হয়।
অস্ত্রের প্রাচুর্য এবং সেগুলোর সহজপ্রাপ্যতার কারণে বেলুচিস্তানে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর উত্থান সহজ হয়েছে। আফগানিস্তানের সঙ্গে বেলুচিস্তানের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে।
ফাঁকফোকরযুক্ত সীমান্তের কারণে বেলুচিস্তানে অস্ত্র ও গোলাবারুদ অবাধে প্রবেশ করে। ফলে বেলুচিস্তানের পশতুন ও বালুচ দুই অঞ্চলের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হাতে সহজেই অত্যাধুনিক অস্ত্র চলে আসে। এসব অস্ত্র সেখানে সহিংসতা উসকে দিচ্ছে এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি কঠিন করে তুলছে।
এসব ভাড়াটে বাহিনীর কারণে স্থানীয় জনসাধারণের জীবনযাত্রায় যে প্রভাব পড়ছে, সেটা উপেক্ষণীয় নয়। পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত ডেথ স্কোয়াড ও বেলুচ জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহীদের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে বেলুচিস্তানের সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে। দুই পক্ষ থেকেই নির্বিচার বলপ্রয়োগের ফলে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ হতাহত ও গুম হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।
ভাড়াটে বাহিনীগুলোর উপস্থিতির কারণে রাষ্ট্রের সঙ্গে স্থানীয়দের বিশ্বাসের জায়গাটা ফাটল ধরেছে। ফলে চলমান বঞ্চনাগুলোর সমাধান এবং সংঘাতের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে।
বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছেন বেলুচ বিদ্রোহীরা। পাকিস্তান বেলুচ জনগোষ্ঠী–অধ্যুষিত অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনে ডেথ স্কোয়াডখ্যাত ভাড়াটে সশস্ত্র গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে চলেছে। ভিন্নমতাবলম্বী বেলুচদের বিরুদ্ধে নানা উপায়ে সহিংসতা ঘটিয়ে চলেছে। এর মধ্যে অপহরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নির্যাতন, নিবর্তনমূলক গ্রেপ্তারের মতো ঘটনা রয়েছে।
বেলুচিস্তানে ডেথ স্কোয়াডের ভূমিকা এককথায় ভয়ংকর। বেলুচ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু বানায় তারা। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া ডেথ স্কোয়াডের মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনা গুরুতর উদ্বেগ জন্ম দিচ্ছে।
বেলুচিস্তানে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও বেলুচ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমনের মতো কৌশলগত কাজে এসব ভাড়াটে বাহিনীকে ব্যবহার করে পাকিস্তান সরকার।
আন্দোলনের মূল সংগঠকদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে তাদের সরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্র বেলুচ বিদ্রোহকে দুর্বল করতে চায়। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে অন্যদের যুক্ত হতে বাধা তৈরি করতেই এ কৌশল।
কিন্তু এ কৌশল উল্টো ফল নিয়ে আসছে। বেলুচ জনগোষ্ঠী ক্রমশই পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে এবং সেখানে সহিংসতা উসকে দিচ্ছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত ডেথ স্কোয়াডকে সম্পূর্ণ দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। তাদের জবাবদিহির মুখে পড়তে হচ্ছে না। কোনো কর্মকাণ্ডের জন্য আইনি পদক্ষেপের মুখোমুখি হতে হচ্ছে না।
এ সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেলুচিস্তানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে দিচ্ছে। সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, আন্দোলনকর্মীদের মধ্যে যাঁরা সেখানকার সহিংসতা ও বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মানবাধিকার বিষয়ে কথা বলতে সাহস দেখান, তাঁদের নানা ধরনের হেনস্তা, ভীতি প্রদর্শন, এমনকি শারীরিক আক্রমণের শিকার হতে হয়। এতে অনেকের মৃত্যুও হয়।
এটা সেলফ-সেন্সরশিপের একটা পরিবেশ তৈরি করছে, যেখানে ন্যায়ের পক্ষে কথা বলার জন্য কাউকে প্রতিশোধের মুখে পড়তে হবে কি না, সেই পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
তাহলে উপায় কী?
এই বিদ্রোহের অবসানের জন্য ফলপ্রসূ সংলাপ, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান, পুনরেকত্রীকরণের মতো উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কিংবা বেলুচিস্তানের প্রাদেশিক সরকার—কেউই এ বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নেয়নি। এ বিষয়ে তাদের সদিচ্ছা ও অঙ্গীকারের ঘাটতি রয়েছে।
পাকিস্তান রাষ্ট্রকে সুশাসন, আইনের শাসন, বেলুচিস্তানসহ দেশের সব জায়গার মানুষের মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। বিচারব্যবস্থা শক্তিশালী করা, সংবিধানের প্রতি মান্যতা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। বেলুচ জনতার আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বঞ্চনাগুলোর সমাধান করতে হবে।
বেলুচিস্তানের জনগণকে সরকারে আরও বেশি অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে তাদের অর্থবহ অবদান রাখার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া গেলে সংঘাতের মূল কারণ উপড়ে ফেলা সম্ভব।
রাহিম নাসার ইসলামাবাদভিত্তিক নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত