বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ, মোট জনসংখ্যার হিসাবে যা প্রায় এক-তৃতীয়াংশের মতো, তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর এ নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে বিস্তর আলোচনা হলেও সরকারের পক্ষ থেকে খুব বেশি বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। শুধু তা-ই নয়, এ ঘটনা নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণের ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে সংশয় তৈরি করেছে।
নাগরিকদের তথ্য ফাঁস হওয়ার ব্যাপারে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদের যে বক্তব্য পাওয়া গেছে, তাতে জানা যায়, কেউ আক্রমণ চালিয়ে এসব তথ্য হাতিয়ে নিয়েছে তা নয়, ওয়েবসাইটের কারিগরি ত্রুটিই এর কারণ এবং এই ত্রুটি যে সরকারের অজানা ছিল, তা-ও নয়। কিন্তু এই ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও সে বিষয়ে কেন নজর দেওয়া হয়নি—এর কোনো উত্তর নেই।
নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক এ কে এম হুমায়ুন কবীর সংবাদ সম্মেলনে কীভাবে এই ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, এর কোনো ধারণা দেননি। সরকারের সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা আইসিটি বিভাগের বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের প্রকল্প বিজিডি ই-গভ সার্ট সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, সেখানেও এ নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি।
এসব তথ্য সরকারের কাছ থেকে নিয়ে ১৭১টি প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে এবং বলা হচ্ছে, এদের কারও কাছ থেকেই এই ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণের নিরাপদ ব্যবস্থা ছিল কি না, সেটা আগে পরীক্ষা করা হয়েছে কি না, তা নিয়ে আগে কোনো ধরনের নিরাপত্তা সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা ছিল কি না, সে বিষয়ে কেউ কিছু বলছে না। অন্যদিকে এ কথাও বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, এখন সরকারের তথ্য সংরক্ষণ–কাঠামোর দুর্বলতাকে অন্যের কাঁধে চাপানোর চেষ্টা হচ্ছে কি না?
তথ্য ফাঁসের এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরও কিছু বিষয় জানা গেছে, যেগুলো এতটাই বিস্ময়কর ও উদ্বেগজনক যে তা প্রায় অবিশ্বাস্য বলেই মনে হয়। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান বিটক্র্যাক সাইবার সিকিউরিটি ইনফরমেশনের পরামর্শক ভিক্টর মার্কোপোলোস তথ্য ফাঁস হওয়ার বিষয়ে জানতে পারেন গত ২৭ জুন।
এরপর তিনি বাংলাদেশ সরকারকে এ বিষয়ে অবহিত করে ছয় জায়গায় ই-মেইল করেও এর কোনো উত্তর পাননি। যার অর্থ দাঁড়ায়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ ঘটনার তাৎপর্য বুঝতে অপরাগ ছিলেন কিংবা কী করণীয়, সে বিষয়ে তাঁদের ধারণা নেই। এর যেকোনো একটি আসলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যোগ্যতা-দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দেয়। এত দিন ধরে সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের’ কথাবার্তার ফল যদি এ-ই হয়—যে ধরনের দক্ষতা তৈরি হয়নি, অন্ততপক্ষে অন্য কেউ জানানোর পর কী করতে হবে, সেটি বুঝতে না পারেন—তবে নিশ্চয়ই তা নাগরিকদের উদ্বিগ্ন করে।
সরকারের অপব্যবহারের বিপদ তো খড়্গের মতো মাথার ওপর ঝুলেই আছে, তার ওপর এর গোপনীয়তা ও নিরাপত্তাও নেই। নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা করা এবং সাইবার স্পেসে তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলে যেসব আইন সরকার করেছে এবং করতে আগ্রহী, সেগুলোর উদ্দেশ্য নাগরিকদের সুরক্ষা নয়। রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে এসব আইন তৈরি করার দিকে সরকার যতটা আগ্রহী হয়েছে, ততটা নাগরিকদের স্বার্থ বিবেচনা করা হয়নি।
সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে যেকোনো ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হলে সে বিষয়ে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ কম। তদন্ত কমিটিগুলো শেষ পর্যন্ত কী প্রতিবেদন দেয়, তা-ও জানা যায় না।
ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হওয়া, বিশেষত এত বড় আকারে তথ্য ফাঁস হওয়ার কারণে নাগরিকেরা কত ধরনের বিপদে পড়তে পারেন, সেটি ইতিমধ্যেই বিভিন্নভাবে আলোচিত হয়েছে। এখন আপনার ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে সংঘটিত অপরাধের দায় আপনার কাঁধেই উঠবে, অন্যদিকে ব্যাংকে গচ্ছিত আপনার টাকা উধাও হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় নাগরিকদের সরকারের পক্ষ থেকে কীভাবে সাহায্য করা হবে, নাগরিকেরা কার শরণাপন্ন হবেন—এখন পর্যন্ত এ নিয়ে সরকারের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। নাগরিকেরা সরকারের কাছে ব্যক্তিগত তথ্য দিয়েছিলেন, কিন্তু তার সুরক্ষায় ব্যর্থ সরকারের যে এ বিষয়ে দায়িত্ব আছে, সেটাও কারও আচরণে মনে হচ্ছে না।
এ ঘটনা যেমন বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তিগত দুর্বলতা ও সরকারের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার ইঙ্গিত দেয়, তেমনি একটি রাজনৈতিক প্রশ্নকেও সামনে নিয়ে আসে। গত কয়েক বছরে নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার বদলে সরকারের সমালোচক ও বিরোধীদের বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য বিভিন্ন সময় গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, ক্ষমতাসীনেরা প্রকারান্তরে সেগুলোকে উৎসাহিতই করেছেন।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের কারও বিষয়ে সমালোচনা এবং তাঁদের বিষয়ে কোনো ধরনের বক্তব্যকে ওই সব ব্যক্তির মানহানি বলে বিবেচনা করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় মামলা হয়েছে। সরকার ও ক্ষমতাসীনদের আচরণে এমন মনে হয়েছে যে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষায়, সম্মান রক্ষায় তারা কোনো ধরনের আপস করতে মোটেই রাজি নয়। এ ধরনের অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আদালতের দ্বারস্থ হয়ে সব সময় প্রতিকার পেয়েছেন, এমনও নয়।
বাংলাদেশে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার জন্য কোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেই। দীর্ঘদিন ধরে ডেটা সুরক্ষার ব্যাপারে প্রশ্ন উঠছে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে তথ্য-উপাত্ত আইনের বিভিন্ন রকমের খসড়া করা হয়েছে। কিন্তু এই বছরের মার্চে ডেটা সুরক্ষা আইনের যে সংশোধিত খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানেও ব্যক্তিগত তথ্য বলতে কী বোঝায় এবং তার কী সুরক্ষা হবে, সেটার কোনো ব্যাখ্যা নেই। তার ওপর কারও ব্যক্তিগত অধিকার ক্ষুণ্ন হলে এর প্রতিকার চেয়ে আদালতে যাওয়ার কোনো সুযোগও প্রস্তাবিত আইনে রাখা হয়নি।
প্রস্তাবিত এই আইন নিয়ে গত আড়াই বছরের আলোচনায় যেসব বিষয়ে আপত্তি উঠছে, তার একটি অন্যতম সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থার কাছে সব ধরনের তথ্য থাকা নিয়ে। এ বিষয়ে আপত্তি করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘সরকারি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থার কাছে সবার সব তথ্য থাকলে তার সুরক্ষা হলো কী করে? এটাকে কতটা গোপন রাখা যাবে? দেশে যেখানে গণতন্ত্র সুদৃঢ় হয়নি, সেখানে সরকার চাইলেই এর অপব্যবহার করতে পারবে।’ (বিবিসি, ২৩ মার্চ ২০২৩)।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকারের অপব্যবহারের বিপদ তো খড়্গের মতো মাথার ওপর ঝুলেই আছে, তার ওপর এর গোপনীয়তা ও নিরাপত্তাও নেই। নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা করা এবং সাইবার স্পেসে তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলে যেসব আইন সরকার করেছে এবং করতে আগ্রহী, সেগুলোর উদ্দেশ্য নাগরিকদের সুরক্ষা নয়। রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে এসব আইন তৈরি করার দিকে সরকার যতটা আগ্রহী হয়েছে, ততটা নাগরিকদের স্বার্থ বিবেচনা করা হয়নি।
নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের ঘটনা দেশে উপাত্ত সুরক্ষার দুর্বলতাকে তুলে ধরেছে। নিঃসন্দেহে এর মধ্য দিয়ে প্রযুক্তিগতভাবে পরিকাঠামোগুলো কতটা ভঙ্গুর, সেটা দৃশ্যমান হয়েছে। কিন্তু এ ঘটনায় দায়িত্ব পালনে সরকারের ব্যর্থতাকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
কেবল প্রযুক্তির ওপর দায় চাপানোর চেষ্টার বিষয়ে সজাগ থাকা জরুরি। অন্যদিকে এই ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে যেনতেনভাবে উপাত্ত সুরক্ষা আইনের বর্তমান ত্রুটিপূর্ণ খসড়াকে যেন আইনে পরিণত করার চেষ্টা না হয়, সে ব্যাপারেও নাগরিকদের সতর্ক থাকতে হবে। নাগরিকদের অধিকার রক্ষার বিষয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা এ বিষয়ে সজাগ থাকবেন বলেই আশা করি।
আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট