গত সপ্তাহে প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত ‘মধ্যবিত্তের কাটছাঁটের জীবন ও ফুটন্ত পানিতে ব্যাঙ’ লেখাতে এই বছর কী কী সমস্যা আসতে পারে তা দেখিয়েছিলাম। এবার আসি কিছু সমাধান নিয়ে।
আমাদের প্রথম সমস্যা আমাদের রিজার্ভ কমছে। অনেক অর্থনীতিবিদ গৎবাঁধা অনেক কথা বলবেন। রেমিট্যান্স আনো, রপ্তানি বাড়াও, আমদানি কমাও—আমরা সবাই এই সমাধান জানি। কিন্তু দেশের ভেতর থেকেও আমাদের অনেক কিছু করার আছে। যার অনেক কিছু সরকারের হাতে, কিছু আমাদের হাতেও।
হুন্ডি বন্ধ করা
হুন্ডি বন্ধ না হওয়ার প্রধান কারণ টাকা পাচার বন্ধ না হওয়া। সরকার কি আজ পর্যন্ত হুন্ডি বন্ধ করার কোনো চেষ্টা করেছেন? নাকি ডলারের দাম কমিয়ে রেখে প্রকারান্তরে হুণ্ডিকেই সাহায্য করা হচ্ছে?
এখন আসি যারা টাকা পাচার করছে, তাদের ধরা কি খুব কঠিন? আরব আমিরাতে যারা বিনিয়োগ করে, বা কানাডাতে, যুক্তরাজ্যে যাদের বাড়ি আছে-তা পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়। তাহলে সরকার পারবে না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?
গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির ২০০৬-২০২০ পর্যন্ত হিসাবে বলছে ওই সময় দেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৮ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা এবং প্রতিবছর পাচার হয় প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা।
দেশের আটটি প্রতিষ্ঠান এই টাকা পাচার ঠেকানোর জন্য কাজ করছে। এতগুলো প্রতিষ্ঠান আসলে কী করছে, কেন তারা ব্যর্থ হচ্ছে, তা আমাদের ভেবে দেখা দরকার। টাকা পাচারই যদি ঠেকানো যা যায়, এত প্রতিষ্ঠান রেখে দেশের কী লাভ।
যত দিন হুন্ডিতে টাকা বেশি পাওয়া যাবে, মানুষকে আটকানো যাবে না। এখন সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি পাচারকারীদের সুযোগ করে দেবে নাকি সেই সুযোগ বন্ধ করে হুন্ডি ঠেকাবে।
অবৈধ বিদেশি বিতাড়ন
দেশে কত জন বিদেশি অবৈধভাবে কাজ করছে তার সঠিক হিসেব নাই। ২০২০ সালে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) তথ্য মতে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৭৭৯ জন। বাংলা ট্রিবিউন ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ এর তথ্য মতে দেশে থাকা মোট বিদেশি ৩০ লাখের মতো (রোহিঙ্গাসহ)। কিন্তু অবৈধভাবে কাজ করছে প্রায় ১০ লাখ বিদেশি। উন্নয়নমূলক কাজ বেড়েছে ফলে বিদেশি আসাও বেড়েছে এই তিন বছরে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট সামির সাত্তারের মতে, প্রতি বছর বিদেশিরা নিয়ে যাচ্ছে ১০ বিলিয়ন ডলারের মতো। (ইত্তেফাক ৯ জুলাই, ২০২৩)। এই অবৈধ বিদেশিদের বিতাড়িত করলেই কিন্তু প্রায় ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়ে যায়।
এখানে খুব অবাক করার বিষয় হচ্ছে ভারতে রেমিট্যান্স পাঠানোতে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। (সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোনেম, ২৮ মে ২০২২)। যদিও বৈধ পথে ২০২১-২২ অর্থবছরে বৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে রেমিট্যান্স অন্য দেশে যায় ১১ কোটি ৫০ লাখ ডলারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, গত অর্থবছরে ৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স গেছে ভারতে, যা দেশের বাইরে যাওয়া রেমিট্যান্সের মধ্যে সর্বোচ্চ। তাহলে দেখা যাচ্ছে অবৈধ পথে আরও কী পরিমাণ ডলার বের হয়ে যাচ্ছে।
বিজনেস ভিসা নিয়ে অনেক ভারতীয় এবং চীনা নাগরিক এই দেশে কাজ করে যাচ্ছে। এই সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে দেশ বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা ও সাশ্রয় করতে পারে। অবশ্য তার আগে প্রয়োজন নিজেদের তাদের স্থান নেওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করা। এবং এই ব্যাপারে সরকার এবং বেসরকারি খাত দুই পক্ষকেই সচেতন হতে হবে।
দেশের বৈদেশিক মূদ্রার সংকট ঠেকানোর এটা একটি বড় খাত। শুধু বাংলাদেশ না, অবৈধ বিদেশি এখন সারা বিশ্বেই একটা বড় আলোচনার বিষয়, আমরা কেন তাদের বাজার হয়ে থাকব?
চিকিৎসা খাতে উন্নয়ন
বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসার জন্য ভারতে যায় বছরে ২৪ লাখ ৭০ হাজার মেডিকেল টুরিস্ট বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাচ্ছেন। (জাগোনিউজটুয়েন্টিফোর ১১ আগস্ট, ২০২৩)। অন্যান্য দেশে যাচ্ছে আর ও ৫ লাখের মতো মানুষ। বিদেশে চিকিৎসা নিতে বছরে দেশের ৩০ হাজার কোটি টাকা টাকা বিদেশ চলে যাচ্ছে (কালের কণ্ঠ ৩০ আগস্ট, ২০২২)।
এখন সব জিনিসের দাম বেড়েছে, তাই এই টাকার পরিমাণ ও বাড়বে। আমাদের দেশেই বেশির ভাগ চিকিৎসা সম্ভব। তাহলে কেন এই খাতে আমরা বাইরে টাকা দিয়ে আসব? এর জন্য দেশপ্রেমের সঙ্গে সঙ্গে দরকার সরকারের ও উচিত চিকিৎসা সেবা উন্নত করা, এবং বেসরকারি চিকিৎসা খাতে খরচ কমানো।
সব চিকিৎসার একটা মূল্যসীমা ঠিক করে দেওয়া দরকার। সবার জন্য দেশেই চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারলে আমরা অনেক বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাতে পারি।
প্রতিদিনের ব্যবহার্য জিনিসপত্রে খরচ
২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারত, চীন ও পাকিস্তানসহ সার্কভুক্ত দেশসমূহের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ২৩ হাজার ৭৭ দশমিক ২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ভারতের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৮১ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ১৫ হাজার ৪৮৮ দশমিক ৮৪ মিলিয়ন ডলার। (ঢাকা পোস্ট ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩)
এ তো গেল বৈধ পথে বাণিজ্যের কথা। হ্যান্ড লাগেজ, চোরা চালানের মধ্যে আসা জিনিসগুলোর তো হিসেবই নাই। কলকাতাতে গিয়ে নিজেদের মাসের বাজার করে আসার লোকের ও অভাব নাই।
এখন আমরা যদি বিদেশি জিনিস বাদ দিয়ে নিজেদের উৎপাদিত দ্রব্য ব্যবহার করি, কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষা করতে পারি দেখেছেন?
বাংলাদেশের চ্যানেল বিদেশ থেকে কোনো আয় করতে না পারলেও ভারতীয় চ্যানেলের আয় হয় অন্তত ২০০ কোটি টাকা। (সময়ের আলো, ৬ অক্টোবর, ২০২১)।
এই জন্য আমাদের ব্যবসায়ীদের দ্রব্যমূল্যের দাম কমাতে হবে, গুণগত মান ঠিক রাখতে হবে, মানুষদের সচেতন হতে হবে। এই বাণিজ্য ঘাটতি যদি ৫০ ভাগ ও কমানো যায়, আমাদের রিজার্ভ এমনি বাড়তে থাকবে।
কৃষিখাতে স্বনির্ভরতা
এই দেশ বিশ্বে খাদ্য আমদানিতে তৃতীয়। মানা যায়? ভারত পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করলে আমাদের দাম বেড়ে যায়, ডিম ও এখন আমদানি হচ্ছে। কীভাবে ঢাকার জিনিসের থেকে কলকাতা বা রেঙ্গুনে জিনিসের দাম কম হয়?
সব জিনিসের এত দাম বাড়িয়ে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যেন আমদানিই সমাধান। কিন্তু আমাদের কৃষি মন্ত্রণালয় কিন্তু সব থেকে সফল। এই দেশে যদি কৃষকেরা সুবিধা পায়, কখনোই দুর্ভিক্ষ হবে না।
এখন দেশ কি সিন্ডিকেটের কাছে হেরে যাবে? আমরা উৎপাদন বড়িয়ে কি পর মুখাপেক্ষী হওয়া থেকে বের হতে পারি না? এই সমাধানও আমাদের হাতে। আমাদের অনেক কৃষিবিদ আছে, তারা সাহায্য করতেও চায়। আমরা যে পারি তার বড় প্রমাণ গরু উৎপাদনের ক্ষেত্রে স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়ে আমরা দেখিয়েছি।
আমি শিক্ষাখাত আর পর্যটন খাতের কথা খুব বেশি বলছি না। কেউ যদি একটু ভালো ভাবে কক্সবাজার যেতে চায়, তার খরচে ভারতে ট্যুর করে আসা সম্ভব। কেন এত খরচ? ব্যবসায়ীরা ভাববেন?
এত এত উন্নয়ন করে ও টুরিস্ট অঞ্চলে যেতে কেন এখনো কষ্ট করতে হয়? সেরকম শিক্ষা খাতে সংখ্যা বাড়িয়ে, দক্ষতা কমিয়ে ফেলা হয়েছে। বিদেশ থেকে পড়ে আসা ছাত্ররাই বরং দেখা যাবে পরে দেশের হাল ধরবে।
আমরা বিদেশের জন্য কত বড় বাজার করোনার সময়ে কলকাতা নিউমার্কেটের অলস বসে থাকা ব্যবসায়ীদের চেহারা একটু মনে করে দেখুন না।
আসলে আমরা নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা রাখি না। বাংলাদেশ ২০ কোটি লোকের বাজার, ভারতের প্রায় ৫ ভাগের এক ভাগ। এত বড় বাজার সুবিধা নিয়ে দর-কষাকষির সুযোগ আমরা কখনোই নিতে পারি না। আমরা কি এখনকার অর্থনৈতিক দুরবস্থায় নিজেদের স্বনির্ভর করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার দরকারি উদ্যোগ নিতে পারি না? নাকি আমাদের সবার দেশপ্রেম লোক দেখানোই?
সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলাম লেখক
[email protected]