২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে নিয়োগের ঘোষণা দিলেন, সে সময় ক্রেমলিন না বললেও রাশিয়ার সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধারণা হয়েছিল যে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ নয়, প্রকৃত যুদ্ধই শুরু হচ্ছে।
সফল পাল্টা আক্রমণে রাশিয়ান বাহিনীর কাছ থেকে বড় অংশের ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করে ইউক্রেন। এরপরই মস্কো ৩ লাখ সেনা নিয়োগের ঘোষণা দেয়। এ সংখ্যা রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে যুক্ত হতে সক্ষম, এমন লোকের মাত্র ১ শতাংশ।
এর আগে ১৯৪১ সালে রাশিয়াতে একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক সেনা নিয়োগ হয়েছিল। দেশটির সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগের নিয়মিত একটি পদ্ধতি চালু আছে।
সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগপ্রাপ্তদের সরাসরি রাশিয়ার বাইরে যুদ্ধে পাঠানো হয় না। এক বছর সেবা দেওয়ার পর তাঁদের মজুত বাহিনী হিসেবে রাখা হয় এবং সেখান থেকেই যুদ্ধের জন্য পাঠানো হয়।
কিন্তু বিশালাকার মজুত বাহিনী থাকা সত্ত্বেও এ মুহূর্তে ক্রেমলিন তাদের যুদ্ধে পাঠাতে পারছে না। কেননা, আগামী বছর মে মাসে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন। নতুন করে মজুত লোকবল থেকে তাঁদের যদি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ডাকা হয়, সেটা হবে ভীষণ অজনপ্রিয় একটি পদক্ষেপ।
একটা গুজব ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে রাশিয়ার বাহিনীতে নতুন আরেকটি বাধ্যতামূলক নিয়োগ আসন্ন। কিয়েভের দিক থেকে অপতথ্যের যে প্রচারণা, তারই ফলাফল হিসেবে এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে ইউক্রেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওলেক্সি রেজনিকভ ও সামরিক গোয়েন্দার প্রধান কারাইলো বুদানভ দাবি করেছিলেন, ২০২৩ সালের ৫ জানুয়ারির মধ্যে নতুন করে নিয়োগ শুরু হতে যাচ্ছে।
সমরবিদ, অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল এবং পশ্চিমা কর্মকর্তাদের মধ্যে উচ্চ প্রত্যাশা ছিল যে আজভ সাগর অভিমুখে ইউক্রেনীয় বাহিনীর পাল্টা আক্রমণ জয়-পরাজয় নিষ্পত্তিতে একটি বড় সফলতা নিয়ে আসবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সামরিক উপায়ে যুদ্ধ শেষ করার যে কৌশলনীতি ন্যাটো ও ইউক্রেন নিয়েছিল, সেটা পরাজিত হয়েছে। ন্যাটোর দেশগুলো ইউক্রেনকে তাদের পক্ষে যতটা সম্ভব, তার সবটা সামরিক রসদ দিয়েছে, তাদের বাহিনীকে দিয়েছে প্রশিক্ষণ। কিন্তু এখন তার ফলাফল কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
সেটা যখন সত্যি হলো না, তখন ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা বলতে শুরু করলেন, জানুয়ারি মাসের মধ্যে পাঁচ লাখ তরুণকে রাশিয়া সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেবে।
সেপ্টেম্বরে ইউক্রেনের আরেকটি সূত্র দাবি করে বসল, ১০ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার আঞ্চলিক নির্বাচনের পরদিন থেকে বাধ্যতামূলকভাবে সেনা নিয়োগ শুরু হবে। এবারও সে রকম কিছু ঘটল না।
রাশিয়ার সেনবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগ আসন্ন—ইউক্রেনীয়দের এই গুজব তাঁদের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের অংশ। কিন্তু বারবার করে তাঁরা বলছেন আর বাস্তবে সেটা ঘটছে না—এর অর্থ হলো, তাঁদের কথার ওপর আস্থা কমে যায়।
বাস্তবতা হলো, ইউক্রেনই এখন তাদের পাল্টা আক্রমণ অব্যাহত রাখার জন্য জন্য যে নতুন সেনা প্রয়োজন, তার নিয়োগ দিতে সমস্যায় পড়েছে।
মনোভাবের বদল হচ্ছে
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের পাল্টা আক্রমণের মতো এ বছরের বসন্ত ও গ্রীষ্মে পরিচালিত পাল্টা আক্রমণ অভিযানে পশ্চিমা বিশ্ব যা আশা করেছিল, সেটা অর্জন করতে পারেনি ইউক্রেন। প্রকৃতপক্ষে, বিরোধী মতোই সত্য এবং বাস্তববাদীরা এখন বলতে শুরু করেছেন, ইউক্রেনীয় বাহিনীর বড় সফলতার মতো কোনো অর্জন খুব শিগগির দেখা যাচ্ছে না।
মে মাসে আমি যখন রাশিয়া সফরে যাই, তার তুলনায় মস্কোর জনসাধারণের মনের ভাব এখন অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। ইউক্রেনীয় বাহিনী তখন নতুন করে পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে আর ভাগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন উন্মাদের মতো বলেই চলেছেন, রাশিয়ার সেনাবাহিনী পুরোপুরি মারা পড়বে। এই বাস্তবতায় মে মাসে মস্কোর আবহাওয়া ছিল থমথমে।
কিন্তু জুন মাসের শুরুতেই যখন লিওপার্ড ট্যাংকসহ ইউক্রেনীয় বাহিনীর সাঁজোয়া যান ধ্বংসের ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসতে শুরু করল, তখন সেই থমথমে ভাবটি কাটতে খুব বেশি সময় লাগল না।
আগস্ট মাসে আমি যখন ফিরে আসি, সে সময় ইউক্রেনের দিক থেকে আসা হুমকি পুরোপুরি পাল্টে গেছে। সেপ্টেম্বর মাসে এসে এখন ইউক্রেনপন্থী ব্লগাররাও বলছেন, পাল্টা আক্রমণ অভিযানের সফলতা নিয়ে উঁচু প্রত্যাশার জন্ম হলেও, এর কৌশলগত প্রভাব খুব সামান্য।
২০২৩ সালের মধ্যে পুতিন আরও ৩ লাখ স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগের কথা বলেছেন। তাঁদের অনেকেই এরই মধ্যে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা সূত্রই বলছে, আরও অনেকে যুক্ত হবেন বলে নিশ্চিত করেছেন। সুতরাং, একটি স্থিতিশীল বাহিনী ও তাদের ধারাবাহিক নিয়োগ যেখানে চলছে, সেখানে বাধ্যতামূলক নিয়োগের মতো এতটা অজনপ্রিয় পথে হাঁটার সম্ভাবনা ক্রেমলিনের কম।
রাশিয়াপন্থী ব্লগারদের অনুযোগ হলো, তাঁদের দেশ ‘পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে’ জড়িয়ে পড়বে না। কিন্তু যুদ্ধ যদি এ রকম পাল্টাপাল্টি আক্রমণের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে, তাহলে স্বাভাবিকতার প্রদর্শনই প্রকৃত শক্তি।
রাশিয়া এখন তাদের সামরিক উৎপাদন বাড়াচ্ছে। তাদের সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন। যুদ্ধের প্রথম দিকে যেগুলোর ঘাটতিতে তাঁরা চরমভাবে ভুগেছেন—অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও সেনাদের অভিজ্ঞতা—এই তিন ক্ষেত্রেই তাঁরা ২০২৪ সালে আরও ভালো অবস্থানে থেকে যুদ্ধ করতে পারবেন।
ইউক্রেনের ওপর চাপ
সমরবিদ, অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল এবং পশ্চিমা কর্মকর্তাদের মধ্যে উচ্চ প্রত্যাশা ছিল যে আজভ সাগর অভিমুখে ইউক্রেনীয় বাহিনীর পাল্টা আক্রমণ জয়-পরাজয় নিষ্পত্তিতে একটি বড় সফলতা নিয়ে আসবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সামরিক উপায়ে যুদ্ধ শেষ করার যে কৌশলনীতি ন্যাটো ও ইউক্রেন নিয়েছিল, সেটা পরাজিত হয়েছে। ন্যাটোর দেশগুলো ইউক্রেনকে তাদের পক্ষে যতটা সম্ভব, তার সবটা সামরিক রসদ দিয়েছে, তাদের বাহিনীকে দিয়েছে প্রশিক্ষণ। কিন্তু এখন তার ফলাফল কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
পরবর্তী সুযোগের জন্য ইউক্রেনের সেনাবাহিনীতে নতুন নিয়োগ দিতে হবে, এখানকার চেয়ে অগ্রসর অস্ত্র প্রয়োজন হবে। সব আলোচনায় রাশিয়ার সেনাবাহিনীর নিয়োগ নিয়ে হলেও ইউক্রেনই জনবলের ঘাটতিতে পড়েছে।
উপসংহার হচ্ছে, ইউক্রেন সামরিক ও অর্থনৈতিক—দুই দিক থেকেই বাইরের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। চলমান গতিতে যুদ্ধ চালিয়ে নিতেও তাদের কঠিন সমস্যার মুখে পড়তে হবে। মস্কো নয়, বরং কিয়েভই এখন বড় চাপে রয়েছে।
আলেক্সান্ডার তিতোভ কুইনস ইউনিভার্সিটি বেলফাস্ট–এর, আধুনিক ইউরোপিয়ান ইতিহাসের প্রভাষক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত