মূল্যস্ফীতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কেন চিন্তিত নয়

সুইডেনের রিকসব্যাংককে বিশ্বের প্রথম কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৬৬৮ সালে এর জন্ম। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের জন্ম আরও পরে—১৬৯৪ সালে। ফরাসি বিপ্লবের সময় অতি মূল্যস্ফীতি দেখা দিলে মুদ্রানীতি ব্যবস্থাপনার জন্য নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ১৮০০ সালে গঠন করেছিলেন ফ্রান্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর থেকে বিশ্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা রূপান্তর ঘটেছে, পাল্টেছে কাজের ধরন। তবে আধুনিক অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ আসলে নির্ধারিত হয়ে গেছে আশির দশকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির অধ্যায় শুরু ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে, যা অব্যাহত ছিল ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। এই সময়কালকে বলা হয় ‘দ্য গ্রেট ইনফ্লেশন’। রোনাল্ড রিগ্যান প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের চেয়ারম্যান পল ভলকার ওই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করেছিলেন অর্থনীতিকে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়িয়ে মুদ্রা সরবরাহ কমানো হয়েছিল ওই সময়। সুদের হার বাড়িয়ে বা কমিয়ে অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতির নাম ‘টেলর বিধি’।

আধুনিক অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল ভূমিকা ঠিক হয়েছিল তখন থেকেই। এরপর থেকেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কাজটি তারা স্বাধীনভাবেই করে আসছে। অনেক কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির একটা জায়গাও তৈরি করে নিয়েছে। এ মুহূর্তে কেউ ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের ওয়েবসাইটে গেলে দেখতে পাবেন, সেখানে বড় করে লেখা আছে, বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৯ শতাংশ, লক্ষ্যমাত্রা ২ শতাংশ। ব্যাংক অব কানাডার ওয়েবসাইটেও মূল্যস্ফীতির হারের কথা সবচেয়ে দৃশ্যমান জায়গায় উল্লেখ করা আছে, যা এখন ৭ শতাংশ। একইভাবে রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউজিল্যান্ডের সাইটে দেওয়া আছে মূল্যস্ফীতির হার এখন ৭ দশমিক ৩ শতাংশ।

ব্যাংক অব ইংল্যান্ড জবাবদিহির জায়গাকে আরেকটু সুনির্দিষ্ট করে নিয়েছে। ১৯৯৭ সালে তারা নিয়ম করেছে, মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে না থাকলে ব্যাংক অব গভর্নর ও অর্থমন্ত্রীর মধ্যে খোলা চিঠি বিনিময় হতে হবে। সে চিঠিতে গভর্নরকে ব্যর্থতার কারণ জানাতে হবে, বলতে হবে লক্ষ্য পূরণে নেওয়া পদক্ষেপের কথা। সর্বশেষ খোলা চিঠিটি লেখা হয়েছে গত ১৬ জুন। মুদ্রাস্ফীতি কেন লক্ষ্যমাত্রার বাইরে চলে গেল, তা জানতে চেয়ে প্রথম চিঠিটি দিয়েছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাক আর গভর্নর অ্যান্ড্রু বেইলিকে একই দিনে এর জবাব দিতে হয়েছে। যে কেউ ওয়েবসাইটে গিয়ে চিঠিগুলো পড়ে আসতে পারেন। নিয়ম অনুযায়ী পরের চিঠিটি লিখতে হবে তিন মাস পর অর্থাৎ চলতি মাসেই।

একটি ভালো ও কার্যকর মুদ্রানীতি প্রণয়নের জন্য এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোয় মনিটরি পলিসি কমিটি নামে একটা কাঠামো আছে। অনেক কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ কমিটিতে শীর্ষ কর্মকর্তারা ছাড়াও বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করে থাকে। যেমন ব্যাংক অব ইংল্যান্ড বা রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডের এ–সংক্রান্ত কমিটির নাম ফেডারেল ওপেন মার্কেট কমিটি। ফেডের প্রধানেরাই এ কমিটিতে থাকেন। কমিটি বছরে কয়বার বৈঠক করবে, কীভাবে মুদ্রানীতি ঠিক করবে, কোথায় এর জবাবদিহি করতে হবে—সবই লিখিতভাবে আছে।

সুদহার কম মানেই সস্তায় ঋণ দেওয়া। সস্তা ঋণ দেশকে ভালো বিনিয়োগ নয়; বরং উচ্চ খেলাপি ঋণই উপহার দিয়েছে। খেলাপি ঋণের বর্তমান পরিসংখ্যানই এর প্রমাণ। সস্তা ঋণ অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ বাড়াচ্ছে। এতে বাড়তি চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। আবার এর একটি অংশ পাচারও হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আসলে এ পথটাই বেছে নিয়েছে।

২.

একটা সময়ে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে বিনিময় হার ব্যবস্থাপনায় অনেক সময় দিতে হয়েছে। নমনীয় বিনিময় হার নীতি গ্রহণ করার পর বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ থেকে মুক্তি পেয়েছে। তাদের পূর্ণ মনোযোগ এখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দিকে। এ জন্য মূল্যস্ফীতি কত হতে পারে, এ প্রাক্কলন করার পরিবর্তে তারা লক্ষ্য (ইনফ্লেশন টার্গেটিং) নির্ধারণ করা শুরু করে। আইএমএফের অর্থনীতিবিদের তৈরি করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে সাফল্য পেতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা থাকতে হবে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি কমানোর পদ্ধতির ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মূলত মুদ্রানীতি প্রয়োগ, অর্থাৎ সুদহার বাড়িয়ে বা কমিয়ে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

মূল্যস্ফীতি টার্গেটিং বা লক্ষ্য নির্ধারণের কাজটি আশির দশকেই প্রথম শুরু করেছিল নিউজিল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে উন্নত দেশগুলো তাকে অনুসরণ করেছে। আর অগ্রসর ও উঠতি অর্থনীতির দেশগুলো এ কাজ করেছে ১৯৯৭ সালের মন্দার পর থেকে। বেশির ভাগ দেশেরই লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি ২ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে রাখা। ব্রাজিল, তুরস্ক, ফিলিপাইন, গুয়াতেমালা ও ইন্দোনেশিয়ার মতো কিছু দেশের লক্ষ্য ৪ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে। এ লক্ষ্য বছর বছর পরিবর্তন হয় না, এখন পর্যন্ত তা কেউ–ই করেনি।

৩.

বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার নির্ধারণের কাজটি বাংলাদেশ ব্যাংক করে না। দেশে ‘আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হারসংক্রান্ত সমন্বয় কাউন্সিল ও সম্পদ কমিটি’ নামে আমলানির্ভর একটা কাঠামো আছে। এ কমিটিই বাজেটের আগে বসে নতুন অর্থবছরের মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন সূচকের প্রাক্কলন ঠিক করে দেয়। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় তা উল্লেখ করেন। চলতি অর্থবছরের জন্য প্রাক্কলিত মূল্যস্ফীতি হলো ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ হলো ছয় মাস পরপর একটি মুদ্রানীতি প্রকাশ করা। কাজটি হয় দায়সারাভাবেই। মুদ্রানীতি একটা করতে হবে বলেই যেন করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি ‘মুদ্রানীতি বিভাগ’ আছে। একজন ডেপুটি গভর্নর এর প্রধান। তাঁরাই কাজটি করে থাকেন।

এখন বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান সমস্যার নাম মূল্যস্ফীতি। আইএমএফের প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা গত বুধবার বলেছেন, বিশ্বে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা না হলে দেশে দেশে বিক্ষুব্ধ মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে। ইউরোপের একাধিক দেশে ডানপন্থীদের উত্থান অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই ঘটছে বলে তিনি মনে করেন। এ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের ৭০টির বেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বাড়িয়েছে। কারণ, সবাই জানে মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি কষ্টে রাখে সাধারণ মানুষকেই। বিশ্লেষকেরাও বলেন, মূল্যস্ফীতির রাজনৈতিক মূল্যটাই সবচেয়ে বেশি। ইতিহাস বলছে, একটি রাজনৈতিক সরকারকে অজনপ্রিয় করে তোলে অর্থনীতির এ সূচক। এ কারণেই মূল্যস্ফীতি নিয়ে বিশ্বজুড়ে এত আলোচনা, এত উদ্যোগ।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে হাতে গোনা কয়েকটি দেশ এখনো সুদহার বাড়ায়নি। এর মধ্যে জাপান ও সুইজারল্যান্ডের নীতিই হলো শূন্য সুদহার। এ ছাড়া চীন এখনো ‘জিরো কোভিড পলিসি’ বজায় রেখেছে। তারা অর্থনীতিতে কম সক্রিয়। সুদহার কমিয়েছে তুরস্ক। যদিও দেশটির মূল্যস্ফীতি ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। সুদহার বাড়ায়নি বাংলাদেশও।

আরও পড়ুন

৪.

বাংলাদেশ কেন সুদহার বাড়াচ্ছে না? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কথাবার্তা থেকে ধারণা করা হচ্ছে, যেহেতু এবারের মূল্যস্ফীতি সরবরাহ সংকট থেকে হচ্ছে, তাই সুদহার বাড়িয়ে লাভ হবে না। বরং বিপদের এ সময়ে বিনিয়োগ দরকার। যদিও করোনা সংক্রমণ কমে যাওয়ার পর অর্থনীতির উত্তরণ পর্যায়ে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার সময়েও চাহিদা বাড়ছিল। সেটাই ছিল তখন মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকার প্রথম কারণ। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে মূল্যস্ফীতি ১ নম্বর সমস্যায় পরিণত হয়।

বাংলাদেশের দিকে তাকালে অবশ্য মনে হবে না মূল্যস্ফীতি নিয়ে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক খুব চিন্তিত। বরং ভর্তুকির টাকা কোথা থেকে আসবে, এ চিন্তায় জ্বালানি তেলের দাম ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কিন্তু এর প্রভাব মূল্যস্ফীতির ওপর কতটা, তা জানার বা জানানোর কোনো আগ্রহই নেই সরকারের। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ প্রায়, এখনো প্রকাশ করা হয়নি আগস্টের মূল্যস্ফীতির হার।

আরও পড়ুন

আসলে মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক করে না, তেমনি মুদ্রানীতি প্রয়োগ করার স্বাধীনতাও তার নেই। ঋণের সুদহার ঠিক করা হয়েছিল ব্যবসায়ীদের চাপে, তাঁদের খুশি করতে। নয়-ছয় শতাংশ সুদহার বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিক করেনি। ফলে তা বাড়ানোর এখতিয়ারও কার্যত তাদের নেই। সুদহার নির্ধারণ বাংলাদেশে এখন আর অর্থনৈতিক বিষয় নেই, বরং রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনের এক বা দেড় বছর আগে সাধারণ মানুষের কথা ভেবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ নাকি ব্যবসায়ীদের খুশি রাখা হবে, সেটি আসলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেরই বিষয়। অর্থনীতিতে রাজনীতি ঢুকলে সেটি যে অর্থনীতির জন্য ভালো নয়, তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। এ ছাড়া পৃথিবীতে কেউ–ই বিশ্বাস করেন না সুদহারই বিনিয়োগের একমাত্র নির্ধারক।

সুদহার কম মানেই সস্তায় ঋণ দেওয়া। সস্তা ঋণ দেশকে ভালো বিনিয়োগ নয়; বরং উচ্চ খেলাপি ঋণই উপহার দিয়েছে। খেলাপি ঋণের বর্তমান পরিসংখ্যানই এর প্রমাণ। সস্তা ঋণ অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ বাড়াচ্ছে। এতে বাড়তি চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। আবার এর একটি অংশ পাচারও হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আসলে এ পথটাই বেছে নিয়েছে। সুতরাং সব মিলিয়ে বলা যায়, মুখে যা–ই বলুক, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ দেশের প্রথম অগ্রাধিকার নয়। সাধারণ মানুষের দিক থেকে এটাই এখন সবচেয়ে ভয়ের কথা।

  • শওকত হোসেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন

    [email protected]