রাজনীতির গ্রিড বিপর্যয় ও গণতন্ত্রের মিস্ত্রিগণ

রাজনীতির জাতীয় গ্রিডে ধারাবাহিকভাবে যে বিপর্যয় ঘটে চলেছে, তা গত ৫১ বছরেও মেরামত করা গেল না

বিভিন্ন জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বৈদ্যুতিক শক্তিকে যে এক জায়গায় বা সঞ্চালন লাইনে যুক্ত করা হয়, তাকে গ্রিড বলা হয়। এই গ্রিড ফেল করলে বা বিপর্যস্ত হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। যেমনটি ঘটল ৪ অক্টোবর। জাতীয় গ্রিডের পূর্বাঞ্চলে (যমুনা নদীর এপার) বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দিলে ওই দিন বেলা ২টা ৫ মিনিট থেকে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও সিলেট অঞ্চলের বিস্তৃত এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। সন্ধ্যায় কোনো কোনো এলাকায় বিদ্যুৎ এলেও পরিস্থিতি রাত নয়টার আগে স্বাভাবিক হয়নি।

আরও পড়ুন

বিদ্যুৎহীন থাকা মানে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়া। বিদ্যুৎহীন থাকা মানে কলকারখানায় উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হওয়া। বিদ্যুৎহীন থাকা মানে পুরো এলাকায় ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হওয়া। বাংলাদেশে এবারই প্রথম যে বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিড ফেল করেছে, তা নয়। অতীতেও অনেকবার করেছে। মানুষ উদ্বেগ–উৎকণ্ঠায় থেকেছে। পত্রিকা ও টিভি অফিসে ঘন ঘন ফোন করে অনেকে জানতে চেয়েছেন, কখন বিদ্যুৎ আসবে। বাংলাদেশের বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিড মাঝেমধ্যে ফেল করলেও আবার মেরামত করা হয়। সচল হয়ে যায়।

কিন্তু রাজনীতির জাতীয় গ্রিডে ধারাবাহিকভাবে যে বিপর্যয় ঘটে চলেছে, তা গত ৫১ বছরেও মেরামত করা গেল না। যাঁদের হাতে মেরামতের দায়িত্ব, অর্থাৎ জাতীয় রাজনীতির মিস্ত্রিরা গ্রিডটি ইচ্ছা করেই মেরামত করছেন না। বিষয়টি এমন নয় যে তাঁরা মেরামত করতে জানেন না। রাজনীতির মিস্ত্রিরা যে মেরামত করতে জানেন, তার প্রমাণ তাঁরা বিরোধী দলে থাকতে দেন।

কীভাবে রাজনীতির জাতীয় গ্রিড ঠিক হবে, কীভাবে সচল করা যাবে, তার সুপরামর্শ দেন। কিন্তু তাঁরাই ক্ষমতায় গিয়ে ভুলে যান। রাজনীতির এই মিস্ত্রিরাও জানেন, গ্রিড বিপর্যস্ত হলে দেশ কী ভয়াবহ ক্ষতির মুখোমুখি হয়। বিদ্যুতের গ্রিড ফেল করলে কয়েক ঘণ্টা দেশ অন্ধকারে থাকে। আর রাজনীতির গ্রিড অচল থাকলে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর দেশ অন্ধকারে থাকে। সেই অন্ধকার হলো গণতন্ত্রহীনতার অন্ধকার। মানবাধিকারহীনতার অন্ধকার। নাগরিক স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ার অন্ধকার।

আরও পড়ুন

আমাদের রাজনীতির মিস্ত্রিদের চরিত্র বড় অদ্ভুত। ক্ষমতার বাইরে থাকতে তাঁরা রাজনীতির গ্রিডটি সচল রাখার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। আর ক্ষমতায় গেলে গ্রিডটি কীভাবে অচল রাখা যায়, তার ফন্দিফিকির করতে থাকেন। আবার ক্ষমতার বাইরে না যাওয়া পর্যন্ত তাঁদের চৈতন্যোদয় হয় না।

স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও রাজনীতির গ্রিড মেরামত করা যায়নি। আমরা গণতন্ত্রকে রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ করেছিলাম। সংবিধান ঘোষণা দিয়েছিল, জনগণই ক্ষমতার মালিক। এখন রাষ্ট্র পরিচালনায় সেই জনগণের কোনো ভূমিকা নেই। যাঁরা ভোট নিয়ে ক্ষমতায় আসেন আর ভোট ছাড়া আসেন, তাঁরা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো রাষ্ট্র চালান। গণতন্ত্রের নতুন নতুন ব্যাখ্যা দেন।

বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন করেছেন। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও সেই গণতন্ত্র ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র হলো কানার হস্তিদর্শনের মতো। রাজনীতির কুশলী মিস্ত্রিরা কখনো হাতির পা দেখিয়ে, কখনো মাথা বা লেজ দেখিয়ে বলেন, এটাই গণতন্ত্র। কিন্তু তাঁরা কখনোই পুরো হাতি দেখান না।

সেনাশাসকদের আমরা বিরোধিতা করেছি কেন? বিরোধিতা করেছি, তাঁরা গায়ের জোরে ক্ষমতায় এসেছেন। ক্ষমতায় আসার সময় তাঁরা আমাদের কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই এবং দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা কায়েম করে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার বাসনা ব্যক্ত করেন। অতীত সরকারের গালমন্দ করেন। তারপর কিছুদিন না যেতেই নতুন দল করেন। আর নতুন দলের সামনের কাতারে তাঁরাই থাকেন, যাঁরা কিছুদিন আগেও দুর্নীতির দায়ে জেল খেটেছেন বা বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের যে সাবেক মন্ত্রীরা বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সেবা করেছেন, তাঁরা কেউ কালিমামুক্ত ছিলেন না।

নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক শাসক ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিলেও তার অপচ্ছায়া রাজনীতিতে পুরোপুরি রয়ে গেছে। রাজনীতির জাতীয় গ্রিডটি এখন বিপর্যস্ত। এই গ্রিড শক্ত করার একটা উপায় ছিল সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর। যেই নির্বাচনে জাতিধর্ম–নির্বিশেষে মানুষ নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবেন। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে শুনতে হবে না, আপনার ভোট দেওয়া হয়ে গেছে কিংবা আগের রাতে বাড়িতে গিয়ে কেউ বলবেন না, ‘চাচা আপনি তো অমুক মার্কায়ই ভোটটা দেবেন। কষ্ট করে আপনাকে যেতে হবে না। আমার দলের লোকেরাই দিয়ে দেবে।’

বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন করেছেন। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও সেই গণতন্ত্র ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র হলো কানার হস্তিদর্শনের মতো। রাজনীতির কুশলী মিস্ত্রিরা কখনো হাতির পা দেখিয়ে, কখনো মাথা বা লেজ দেখিয়ে বলেন, এটাই গণতন্ত্র। কিন্তু তাঁরা কখনোই পুরো হাতি দেখান না।

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ নব্বইয়ের দশকে ছাত্ররাজনীতির হানাহানি দেখে খেদের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘ছাত্ররা যদি সারাক্ষণ মারামারি করে, তাহলে পড়াশোনা করবে কখন?’ বিচারপতির কথাটিই একটু ঘুরিয়ে বলতে চাই, ভোট নিয়েই যদি আমাদের রাজনীতির মিস্ত্রিরা সারাক্ষণ ঝগড়া–বিবাদ করেন, হানাহানিতে লিপ্ত থাকেন, তাহলে তাঁরা জনগণের জন্য কাজ করবেন কখন?

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

    [email protected]