ডেমোক্র্যাটেরা এখন কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে

কমলা হ্যারিসের পরাজয়ের পর হতাশায় ভেঙে পড়া এক ডেমোক্র্যাট সমর্থকছবি: এএফপি

ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের ধাক্কা যখন ধীরে ধীরে বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে, তখন বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদেরা এই অভিঘাতের অর্থ নিয়ে ভাবছেন। ভবিষ্যতে বৈশ্বিক রাজনীতির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কত দূর গড়াবে, তা নিয়ে তাঁরা ভাবছেন। ট্রাম্পের মতো একজন বিভেদ সৃষ্টিকারী ও ‘অযোগ্য’ প্রার্থী কীভাবে আবারও জিতলেন, তা বোঝা এখন ডেমোক্র্যাটদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

কারণ, প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, ডেমোক্র্যাটরা কি অতিরিক্ত বামঘেঁষা হয়ে গেছে এবং সে কারণে তারা কি সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যবিত্ত আমেরিকানদের সমর্থন হারিয়েছে? নাকি বিল ক্লিনটন-পরবর্তী ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্টরা যে মধ্যপন্থী নব্য-উদারবাদ অনুসরণ করেছেন, তা ব্যর্থ হয়েছে এবং এই ব্যর্থতার কারণেই আমেরিকানদের মধ্যে পরিবর্তনের চাহিদা তৈরি হয়েছে?

আমার মতে, এর জবাব স্পষ্ট, ৪০ বছরের নব্য-উদারবাদ যুক্তরাষ্ট্রকে নজিরবিহীন বৈষম্য, মধ্যম আয়ের স্তরে স্থবিরতা (নিচের স্তরে আরও খারাপ অবস্থা) এবং গড় আয়ুষ্কালের পতন (বিশেষ করে ‘হতাশাজনিত মৃত্যু’ বাড়ার মাধ্যমে) উপহার দিয়েছে।

নির্বাচনের আগে বাইডেন প্রশাসন দেখাচ্ছিল, বিশেষত জি-৭ ভুক্ত অন্য দেশের তুলনায় মার্কিন অর্থনীতি শক্তিশালী অবস্থায় আছে। কিন্তু ভোটারের মন জয়ের জন্য এটি যথেষ্ট ছিল না। আমেরিকানরা ভুলে যাননি, ডেমোক্র্যাটরা (ক্লিনটন আমলে) আর্থিক খাতকে মুক্ত করে দিয়েছিল। যখন বৈশ্বিক মহামন্দায় চাকরি হারানো কর্মী ও বাড়ির মালিকেরা এর খেসারত দিয়েছেন, তখন ডেমোক্র্যাটরা (বারাক ওবামার আমলে) ব্যাংকগুলোর উদ্ধার প্রকল্পে সহায়তা করেছিল। তাতে অবশ্য জনগণের ভাগ্যের বিশেষ পরিবর্তন হয়নি।

ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে একমাত্র প্রকৃত পার্থক্য হলো, এই দুই শিবিরের মধ্যে শুধু ডেমোক্র্যাটরা দাবি করেছিল যে তারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কষ্ট অনুভব করে। তবে শেষ পর্যন্ত দুঃখজনকভাবে আমেরিকানরা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন।

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ এবং তাঁর ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণা স্পষ্ট করে দিয়েছে, সাধারণ আমেরিকানদের প্রয়োজনীয় নীতি বাস্তবায়নের কোনো ইচ্ছাই তাঁর নেই। ট্রাম্প মূলত ধনী ব্যক্তিদের ও বড় করপোরেশনগুলোর জন্য কর ছাড় দেওয়ার পক্ষে। পাশাপাশি তিনি ওবামাকেয়ার (অ্যাফরডেবল কেয়ার অ্যাক্ট) বন্ধ করতে চান এবং আমদানি পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করতে চান। এই শুল্ক আরোপ মূলত আমেরিকান ভোক্তা ও ব্যবসার ওপর একধরনের বাড়তি কর চাপিয়ে দেবে।

এ ছাড়া এই কর আরোপের ব্যবস্থা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করতে পারে। কারণ, এই ব্যবস্থার কারণে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় অর্থ ঢালা ধনীরা বিশেষ সুবিধা পাবেন। ট্রাম্পের বাড়তি আমদানি কর আরোপের প্রতিক্রিয়ায় অন্যান্য দেশও শুল্ক আরোপ করতে পারে। এটি আমেরিকানদের কর্মসংস্থানের ক্ষতি করবে। সব মিলিয়ে ট্রাম্পের নীতিগুলো সাধারণ মানুষের চেয়ে ধনী ও ক্ষমতাশালীদের সুবিধা দিতেই বেশি কার্যকর হবে।

ট্রাম্প বিশাল বাজেট ঘাটতি তৈরি করবেন। এটি উচ্চ সুদের হার ও আমেরিকার ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ কমিয়ে দেবে। যদি ট্রাম্প ও কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্যরা ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট (যার মধ্যে প্রেসক্রিপশন করা ওষুধের দাম কমানোর ব্যবস্থা রয়েছে) ও ওবামাকেয়ার বাতিল করে, তাহলে আমেরিকানদের চিকিৎসার খরচ আরও বেড়ে যাবে। এটি নব্য-উদারবাদের চেয়েও খারাপ। কারণ, নব্য–উদারবাদ অন্তত প্রতিযোগিতামূলক ও অবিকৃত বাজারের কথা বলত। অন্যদিকে ‘ট্রাম্পোনমিকস’ হলো একটি ভ্রান্ত পুঁজিবাদ, যা ক্ষমতাবানদের দ্বারা ও ক্ষমতাবানদের জন্য পরিচালিত হয়। সেখানে অর্থই সর্বোচ্চ প্রাধান্য পায়।

আমেরিকানরা তাঁদের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আস্থা হারিয়েছেন। সরকার জনগণের জন্য কাজ করে, এই বিশ্বাস তাঁরা হারিয়েছেন। এটি গত ৪৫ বছরের রিপাবলিকান (এবং নব্য–উদারবাদী ডেমোক্রেটিক) প্রচারণার ফল। এই পরিস্থিতি বোঝাতে রোনাল্ড রিগ্যানের সেই বিখ্যাত উক্তির উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে, ‘ইংরেজি ভাষায় সবচেয়ে ভয়ানক ৯টি শব্দ হলো: I’m from the government and I’m here to help (আমি সরকার থেকে এসেছি এবং আমি সাহায্য করতে এসেছি)।

ট্রাম্পের বিজয়ে সাংস্কৃতিক সংঘাত বা ‘কালচার ওয়্যারস’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাঁর প্রচারণা সফলভাবে এই ধারণা ছড়িয়েছে যে বেশির ভাগ আমেরিকান যখন কোনোরকমে টিকে থাকার জন্য লড়াই করছেন, ঠিক সে সময় ডেমোক্র্যাটরা লিঙ্গ, বর্ণ ও অন্যান্য সামাজিক ইস্যুতে অতিরিক্ত মনোযোগ দিচ্ছে। অনেক ভোটার মনে করেন, ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক স্তর পরিবর্তনের গতি উল্টে দেবেন, তা না পারলে সেই গতিকে অন্তত ধীর করে দেবেন। তাঁরা তাঁর প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন এই বিশ্বাসে যে তিনি আমেরিকানদের ঐতিহ্যগত সামাজিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করবেন।

ট্রাম্প অন্যান্য জাতীয়তাবাদীর মতো আমেরিকার সমস্যার জন্য অবৈধ অভিবাসন বা ‘অন্যায়’ বাণিজ্যের মতো বাইরের কারণগুলোকে দায়ী করেন। এটি যদিও সত্যি যে এই বিষয়গুলো ভালোভাবে পরিচালিত হয়নি; তবে ট্রাম্পের প্রস্তাবিত সমাধানের পন্থা দিন শেষে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও বিশ্বের জন্য ক্ষতিকর হবে।

ট্রাম্পের সমর্থক ভোটাররা এই বিষয় কতটা বুঝেছেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে মনে হয় তাঁদের বেশির ভাগই ট্রাম্পের রাজনৈতিক নাটকের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। তাঁরা নিজেদের অসন্তোষের বার্তা দিতে চেয়েছিলেন ও ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁরা সেই বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন।

এর মধ্যে ডেমোক্র্যাটদের জন্য একটা পরিষ্কার বার্তা রয়েছে। সেটি হলো ডেমোক্র্যাটদের পুরোনো নীতি ত্যাগ করে ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ও লিন্ডন বি জনসনের সময়ের মতো জনবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে হবে। তাদের এমন একটি সমাজের ধারণা দিতে হবে, যেখানে
সবাইকে শিক্ষা ও সুযোগ দেওয়া হবে। যেখানে ব্যবসায়ীরা মানুষকে শোষণ না করে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে ভালো পণ্য তৈরি করবেন।

আমাদের বুঝতে হবে আমরা শিল্পের যুগ পেরিয়ে এখন এমন এক অর্থনীতিতে প্রবেশ করেছি, যেখানে সেবা, জ্ঞান, উদ্ভাবন ও জনপরিষেবার গুরুত্ব বেশি। নতুন অর্থনীতি মানে নতুন নিয়ম ও সরকারের নতুন ভূমিকা-ডেমোক্র্যাটদের এই সত্য উপলব্ধি করতে হবে।

  • জোসেফ ই স্টিগলিৎস কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ

  • স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ