বিংশ শতাব্দীর একই সঙ্গে নিন্দিত ও নন্দিত রাজনীতিবিদ মিখাইল গর্বাচেভ ৯১ বছর বয়সে গত ৩০ আগস্ট চলে গেলেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন বা পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক বলয় ভেঙে পড়ার বিষয়ে অনেকেই তাঁকে দায়ী করে থাকেন। আবার অনেকেই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর রক্তক্ষয়ী পতনের পূর্ব মুহূর্তে নিয়মতান্ত্রিক পথে সংস্কারের জন্য গর্বাচেভের সংস্কার রাজনীতির প্রশংসা করেন। বিগত ৩০ বছর তাঁর রাজনীতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে এবং তাঁর মৃত্যুর পরও তা চলতে থাকবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানির পুনর্মিলন বা ঐক্যবদ্ধ জার্মানিও গর্বাচেভের রাজনীতির ফসল। তাঁর রাজনীতি পূর্ব ইউরোপের সমাজতন্ত্র শিবিরের স্বৈরাচারী রাজনীতির লৌহকপাট ভেঙে দিয়েছিল। সমাজতন্ত্রের নামে, সাম্যবাদের নামে ক্ষমতায় থাকা বড় বড় কমরেডদের জনসম্পৃক্ততাহীন হালুয়া–রুটি খাওয়া রাজনীতিতে তিনি বাধ সেধেছিলেন।
গর্বাচেভ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর রাজনীতিকদের তাঁদের রাজনীতিকে জনবান্ধব করতে আহবান জানিয়েছিলেন। অনেকেই তাঁকে পশ্চিমা পুঁজিবাদী রাজনীতির চর বা পশ্চিমা রাজনীতির কৌশলের কাছে সঁপে দেওয়া রাজনীতিক বলে জ্ঞান করেন। কিন্তু সত্য ইতিহাস তা বলে না। পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলো যদি সাম্যবাদের মূল বক্তব্য গৃহ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চাকরি, মানবাধিকারসহ মানুষের মৌলিক চাহিদা বজায় রেখে মুক্ত রাজনীতি বহাল রাখতে পারে, তাহলে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো কেন তা পারল না? অবশ্য এখানে শুধু পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর তুলনা করা হচ্ছে। যুদ্ধবাজ ইঙ্গো-মার্কিন রাজনীতির কথা নয়।
২০১৮ সালে সমাজতন্ত্র দর্শনের অন্যতম পথিকৃৎ কার্ল মার্ক্সের ২০০তম জয়ন্তীর প্রাক্কালে তাঁর জন্মশহর ট্রিয়ার্সে জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে তৎকালীন ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জঁ ক্লদ ইয়ুঙ্কার সবাইকে সতর্ক করে বলেছিলেন, কমিউনিজমের নামে তাঁর অনুসারীদের অনাচারের জন্য কোনোভাবেই কার্ল মার্ক্সকে দায়ী করা যাবে না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত লাল ফৌজের রণকৌশল ও বীরত্ব সর্বজনবিদিত। কিন্তু ১৯৩৯ সালে অ্যাডলফ হিটলার আর স্তালিনের মধ্য পোল্যান্ড ভাগাভাগি করে নেওয়ার অনৈতিক চুক্তির বিষয় এবং উভয় দেশের মধ্য অনাক্রমণ চুক্তিটি ঐতিহাসিক সত্য। আবার বার্লিন বিজয়ের তিন বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক বার্লিনকে পূর্ব ও পশ্চিম অংশে বিভক্তকরণ এবং বার্লিনের পশ্চিম অংশকে ১৯৪৮ সালের জুন মাস থেকে প্রায় এক বছর অবরুদ্ধ করে খাদ্য, পানীয় ও জ্বালানি বন্ধ করে দেওয়ার অমানবিক সিদ্ধান্ত জোসেফ স্তালিনের নির্দেশেই হয়েছিল।
সে সময় যুক্তরাজ্য ও মার্কিন বিমান অবরুদ্ধ পশ্চিম বার্লিনবাসীকে বিমানে করে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পৌঁছে দিয়েছিল। জোসেফ স্তালিনের এসব অবিশ্বাসী আচরণের কারণে মূলত ১৯৪৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ ৯টি দেশ মিলে ন্যাটো সামরিক জোট তৈরি করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপ তৈরি করেছিল ওয়ারশ সামরিক জোট। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পর ওয়ারশ জোট ভেঙে পড়ে। তবে এত দিন পরও কার স্বার্থে ন্যাটো জোট বা তা বিস্তৃতির কেন প্রয়োজন হচ্ছে, তা নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ার মানুষ প্রশ্ন তুলছেন। ইউক্রেনে যুদ্ধ লাগার পর থেকে ন্যাটো জোটের প্রয়োজন ও বিস্তৃতির প্রশ্ন নিয়ে খোলামেলা সমালোচনা হচ্ছে।
গর্বাচেভ ১৯৮৯ সালের ৭ অক্টোবর পূর্ব জার্মানির ৪০তম বার্ষিকী উদ্যাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পূর্ব বার্লিনে গিয়েছিলেন। তত দিনে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক ধ্যান–ধারণার বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক অসন্তোষ শুরু হয়েছে। পূর্ব ইউরোপ ও পূর্ব জার্মানির রাজনীতি নিয়ে অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি হতাশ হয়েছিলেন। রাজধানী পূর্ব বার্লিনের বিখ্যাত সড়ক উন্টার ডেন লিন্ডেনের এক রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান তিনি বলেছিলেন, ‘যারা সমাজ থেকে শিক্ষা নিয়ে তাঁদের রাজনীতিতে সংস্কার সাধন করেন, তাতে সমস্যার কিছু নেই, বিষয়টি স্বাভাবিক ঘটনা। তবে সেটা অনুধাবন করতে না পারলে, বিপদ তাঁদের জন্য অপেক্ষা করবে না।’ সে সময় গর্বাচেভ নিজ দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নে বিদ্যমান সমাজতন্ত্রের আমূল পুনর্গঠনে সংস্কার নীতি শুরু করেছিলেন।
পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর দেশগুলোয় পুঁজিবাদ বজায় রেখেও যে জনগণের জন্য কল্যাণমুখী রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার ও মুক্তচিন্তার বিকাশ সম্ভব, তা পশ্চিম ইউরোপে বিদ্যমান থাকলেও পূর্ব ইউরোপে সে সময় এটা ছিল অলীক কল্পনা।
প্রায় চার দশক ধরে পূর্ব জার্মানির মানুষ ছিল সমাজতান্ত্রিক নিয়মনীতির কড়া শাসনে আবদ্ধ। তা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে ১৯৮৯ সালে দেশ ত্যাগ করে ৫ হাজার মানুষ হাঙ্গেরি আর অস্ট্রিয়ায় গিয়ে শরণার্থী হয়েছিল। দীর্ঘ সময় পূর্ব জার্মানি মার্ক্সবাদী সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চালিত হলেও দেশটির জনগণের কোনো গণতান্ত্রিক অধিকার, বাক্স্বাধীনতা এবং অনেক সামাজিক অধিকার ছিল না। সে সময় লাইপজিগসহ অনেক শহরে হাজার হাজার মানুষ ক্ষমতাসীন এরিখ হোনিকার সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করেন। ১৯৮৯ সালের ৯ অক্টোবর বার্লিন প্রাচীরের পতন ঘটে এবং পূর্ব জার্মানির ক্ষমতাসীন নেতারা একে একে পদত্যাগ করেন।
তিনি কখনোই পূর্ব ইউরোপ, পূর্ব জার্মানি বা সোভিয়েত ইউনিয়নের মুক্তিদাতা হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখাতে চাননি। মিখাইল গর্বাচেভের উদ্দেশ্য ছিল জনগণের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও গণতন্ত্রকে বাঁচানো, কবর দেওয়া নয়।
সে সময় ১৯৯০ সালের ৩০ জানুয়ারি মিখাইল গর্বাচেভই প্রথম দুই জার্মানিকে একত্রীকরণের ব্যাপারে বক্তব্য দেন। ইউরোপের দেশগুলোসহ আমেরিকাও এ ব্যাপারে প্রথমে গররাজি ছিল। আশঙ্কা ছিল, ঐক্যবদ্ধ জার্মানি আবার ইউরোপীয় মহাশক্তি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে জার্মানির গণতান্ত্রিক রাজনীতিকেরা এই ব্যাপার সন্দিহান প্রতিবেশী রাষ্ট্র ও আমেরিকাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে বৃহৎ জার্মানি ইউরোপীয় তথা বিশ্ব ঐক্য ও শান্তির পথে কাজ করে যাবে।
এ ব্যাপারে ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী চার মিত্রশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, আমেরিকা ও ইংল্যান্ড তাদের সম্মতি জানানোর পর ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর দুই জার্মানি একত্রকরণের প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়।
পূর্ব আর পশ্চিমের মধ্য স্নায়ুযুদ্ধ কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য এবং দুই জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করার কারণে পশ্চিমে তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর নিজ দেশে শেষ পর্যন্ত তাঁকে তুচ্ছ করা হয়। তিনি কখনোই পূর্ব ইউরোপ, পূর্ব জার্মানি বা সোভিয়েত ইউনিয়নের মুক্তিদাতা হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখাতে চাননি। মিখাইল গর্বাচেভের উদ্দেশ্য ছিল জনগণের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও গণতন্ত্রকে বাঁচানো, কবর দেওয়া নয়।
সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
[email protected]