মিয়ানমারে আসল কিংমেকার কে হবে?

আরাকান আর্মি এখন মিয়ানমারের জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ করছে।ফাইল ছবি : এএফপি

২০০১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচি দিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ধীরে ধীরে সেটাই সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ পায়, সেটি এখন চার বছর শেষ করছে। এরপর থেকে মিয়ানমারের সংঘাতের দৃশ্যপট নাটকীয়ভাবে বদলে যাচ্ছে। অভ্যুত্থান নির্মাতা স্টেট অ্যাডমিনিস্টেশন কাউন্সিল (এসএসি) বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী ও প্রতিরোধী বাহিনীর কাছে ভূখণ্ড হারিয়ে চলেছে।

মিয়ানমারের বেসামরিক ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্মেন্ট (এনইউজি) সম্প্রতি তাদেরে সামরিক অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা দাবি করেছে, পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফএস) এবং তাদের মিত্র জাতিগত রেভল্যুশনারি অর্গানাইজেশনস (ইআরওএস) ২০২৪ সাল শেষে মিয়ানমারের প্রায় অর্ধেকটার বেশি এলাকা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে।

এনইউজি বলেছে, মিয়ানমারের শহরগুলোর মধ্যে ৪৪ শতাংশ শহরের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ এখন তাদের (এনইউজি ও মিত্রদের) হাতে। আরও ২৪ শতাংশ শহরে প্রতিরোধী যোদ্ধাদের সঙ্গে জান্তা বাহিনীর তুমুল লড়াই চলছে।

ন্যায্যভাবে বললে, এনইউজি যে ভূখণ্ড নিজেদের দখলে নেওয়ার কথা বলছে, তার বেশির ভাগ জাতিগত বিপ্লবী সংগঠনগুলোর হাতে। যদিও জাতিগত বিপ্লবী সংগঠনগুলো বিশাল ভূখণ্ড নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, কিন্তু তাদের অনেকে মূলত তাদের জাতিগত সমস্যা সমাধানের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। বিশেষ করে তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে স্বায়ত্তশাসন।

কিন্তু এখানে আরও বড় প্রশ্নটি রয়েছে। প্রতিরোধী গোষ্ঠীগুলো কি কেন্দ্রীয় সরকার পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে? তারা কি তাদের ঐতিহ্যগতভাবে সংকীর্ণ জাতিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারবে? সংক্ষেপে, মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক বিনির্মাণে কিংমেকার হওয়ার সাহস কে দেখাতে পারবে?

আরাকান আর্মি (এএ), তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক আলায়েন্স আর্মির (এমএনডিএএ)—সমন্বয়ে গঠিক ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স তাদের প্রতিরোধ আন্দোলনকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যায়, ২০২৩ সালের শেষ দিকে অপারেশন-১০২৭ নামে সর্বাত্মক আক্রমণ অভিযানের মধ্য দিয়ে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে চীন হস্তক্ষেপ করার আগপর্যন্ত ১৬টি শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

মিয়ানমারের জনগণের জন্য এখনো আশা জিইয়ে রয়েছে। শক্তিশালী জাতিগত বিপ্লবী সংগঠনগুলোর অনেক নেতা বলছেন, জান্তা সরকারকে উৎখাত না করা পর্যন্ত তারা লড়াই জারি রাখবে। কিন্তু তাদের কে সত্যিকারের কিংমেকার হওয়ার সাহস করবে? এর উত্তর জানার জন্য আমাদের ২০২৫ সালের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

২০২৪ সালের জুন মাসে, তারা আবার যুদ্ধ শুরু করে এবং ল্যাশিও শহর ও মান্দালয় অঞ্চলের বেশ কয়েকটি উপশহরসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গার নিয়ন্ত্রণ তারা নিয়ে নেয়। চীনের চাপের কারণে টিএনএলএ ও এমএনডিএএ এখন লড়াই করলেও মূলত এই জোটের মধ্যে আরাকান আর্মিই একমাত্র সর্বাত্মক আক্রমণে আছে।

আরাকান আর্মি এখন মিয়ানমারের জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ করছে। রাখাইনে ও দক্ষিণ চিন রাজ্যের বিশাল অংশ এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। আরাকান আর্মির সামরিক সাফল্য মিয়ানমারের জনগণ দ্বারা ব্যাপকভাবে সমর্থিত।

উত্তর দিকে কাচিন ইনডিপেডেনস আর্মিও (কেআইএ) খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তারা পিপলস ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস-এর বিভিন্ন গোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং এনইউজির রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে কেআইএ খুব কার্যকরভাবে চীনের সঙ্গে তাদের সীমান্ত অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে চলেছে। তারা এখন কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভামো শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে লড়াই করছে।

মিয়ানমারের দক্ষিণ অঞ্চলে প্রতিকূলকতার মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ) এবং মন জনগোষ্ঠীর বিপ্লবী বাহিনী সক্রিয়ভাবে লড়াই করে যাচ্ছে। থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্তের বড় অংশটির নিয়ন্ত্রণ তারা প্রতিষ্ঠা করেছে।

এসব অগ্রগতি মিয়ানমারের সংঘাতের জটিল গতিপথকে নির্দেশ করে। বেশ কিছু জাতিগত গোষ্ঠী মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মিয়ানমারের রাজনৈতিক পটভূমি পরিবর্তনে তাদের অব্যাহত প্রভাব ও নতুন নতুন অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

ইতিহাসের শিক্ষা

মিয়ানমারের ইতিহাস আবর্তিত হয়েছে সংখ্যাগুরু বামারদের কেন্দ্র করে। আবার বামার রাজত্বের ঘটনাবলিতে জাতিগতভাবে সংখ্যালঘুরাও উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছে। উদাহরণ হিসেবে পিনিয়া রাজবংশের তিন শান ভাইয়ের কথা বলা যায়। তারা মিয়ানমারের মধ্য অঞ্চল শাসন করেছে। আরাকান রাজা মিন বিন, টাংগো রাজার সঙ্গে জোট করে হান্তারওয়াদী রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। এ ঘটনাটি ষোড়শ শতাব্দীতে বার্মিজ সাম্রাজ্যের গতিপথ পরিবর্তন করে দিয়েছিল।  

মিয়ানমারের সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলো যে দেশটির ইতিহাস পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে, এই উদাহরণগুলো তারই দৃষ্টান্ত। এ রকম দৃষ্টান্তের অভাব নেই।
মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পর কেএনইউর সেনারা রাজধানী ইয়াঙ্গুনের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের কাছাকাছি চলে আসছিল। এখন জাতিগত বিপ্লবী সংগঠনগুলো দেশটির অর্ধেকের বেশি জায়গার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। দিন যত গড়াচ্ছে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চল ততই বাড়ছে। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এটা নজিরবিহীন।

এমন একটা অনুকূল পরিবেশে আজকের মিয়ানমারে কোন জাতিগত বিপ্লবী সংগঠন কিংমেকার হতে পারবে? মিয়ানমারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যাঞ্চলে কারা যুদ্ধ করতে আগ্রহী হবে? অবশ্যই তাদের অন্য জাতিগত মিত্র এবং পিপলস ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসকে সঙ্গে নিয়ে সেটা করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে বামারদের অবিশ্বাসটা গভীর। এর মূল ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত। এখনো সেটা উল্লেখযোগ্যভাবে রয়ে গেছে।

এ ছাড়া জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ঘাটতিও আছে। আরও বৃহত্তর আক্রমণের জন্য ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় এটি বাধা তৈরি করে। কোনো সমন্বিত রাজনৈতিক ঐক্য না থাকায় অনেক রাজনৈতিক ইস্যুই অমীমাংসিত রয়ে গেছে, যেটা চলমান উত্তেজনাকে আরও উসকে দিচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আসা চাপ পরিস্থিতিকে নতুন মাত্রায় জটিল করে তুলছে।

কিন্তু মিয়ানমারের জনগণের জন্য এখনো আশা জিইয়ে রয়েছে। শক্তিশালী জাতিগত বিপ্লবী সংগঠনগুলোর অনেক নেতা বলছেন, জান্তা সরকারকে উৎখাত না করা পর্যন্ত তারা লড়াই জারি রাখবে। কিন্তু তাদের কে সত্যিকারের কিংমেকার হওয়ার সাহস করবে? এর উত্তর জানার জন্য আমাদের ২০২৫ সালের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

  • ডেসমন্ড আন্তর্জাতিক শান্তিপ্রক্রিয়া ও উত্তরণ পর্যবেক্ষণ করেন এমন একজন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক
    দ্য ইরাবতী থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত