জেনারেল মুহাম্মদ রেজা জাহেদি ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে এক হামলায় নিহত হন। এর দুই সপ্তাহ পর ইসরায়েল এখন উদ্বেগের সঙ্গে পরবর্তী পদক্ষেপের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কবার্তা থেকে এটা নিশ্চিত যে ইরানি হামলা আসছে এবং সেটি এই লেখা লিখতে বসার সময় থেকে তা প্রকাশিত হওয়ার মধ্যবর্তী যেকোনো সময়ে। [ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি) জানিয়েছে, স্থানীয় সময় গতকাল শনিবার ইসরায়েলের ভূখণ্ড লক্ষ্য করে কয়েক ডজন ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে তারা। ‘ট্রু প্রোমিজ’ নামে অভিযানের আওতায় এসব ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে।]
সিরিয়ার রাজধানীতে সুনির্দিষ্ট হত্যাকাণ্ড চালানোর সক্ষমতা প্রদর্শন করে অসাধারণ গোয়েন্দা শক্তিমত্তা ও অসাধারণ নিখুঁত অস্ত্র চালনার দক্ষতার বাহবা কুড়ানোর কয়েক দিনের মধ্যেই এর দাম চুকানোর দিকে যেতে হচ্ছে। আর এবার দামটা হয়তো বেশ চড়াই হবে।
কেননা, ইসরায়েল যে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তার পেছনে যতই যৌক্তিকতা দাঁড় করানো হোক না কেন, এবার যে দাম দিতে হবে, তা এই হত্যাকাণ্ডের মূল্য ছাড়িয়ে যাবে। আর অতীতে ঘটানো এ রকম সব হত্যাকাণ্ডের মতো এ হত্যাকাণ্ডও ছিল অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন এবং এবার সম্ভবত বিপজ্জনক।
জাহেদি একজন সামরিক ব্যক্তি ছিলেন। তাঁকে এবং এর আগে যাঁদের এভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাঁদের হত্যা করার মাধ্যমে প্রতিপক্ষের তথা ইরানের সামরিক সক্ষমতাকে খাটো ও হ্রাস করার বার্তা দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে এমন কোনো একজন সামরিক কর্মকর্তা কি আছেন, যাঁকে হত্যা করা হলে ইসরায়েলের সামরিক সক্ষমতা বেশ খর্ব হবে? উত্তর হলো, না, কখনোই না।
আমরা কেন সব সময় এমনটা বিশ্বাস করে আসছি যে হামাস, হিজবুল্লাহ বা ইরানে এমন কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা আছেন, যাঁদের সরিয়ে দিতে পারলেই আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা বেড়ে যাবে? জাহেদিকে ইসরায়েল হত্যা করেছে এ জন্য যে তাঁকে হত্যা করার সুযোগ প্রসারিত হয়েছিল। আর যখন এমন সুযোগ আসে, তখন উচ্চপর্যায়ের কেউ আরেকটি অসাধারণ জেমস বন্ড ধাঁচের অভিযান পরিচালনা করার মধুর উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। কিন্তু এরপর কী হবে?
কেউ যেন আবার এটা না বলে যে আর কোনো উপায় ছিল না। উপায় অবশ্যই ছিল—কোনো হত্যাকাণ্ড না ঘটানো। যদি এটা প্রয়োজনীয় হয়ে থাকে, যদি এটা অনুমোদনযোগ্য হয় এবং যদি এটা সম্ভবও হয়, তাহলেও না। যে ব্যক্তি হত্যাকারীদের পাঠিয়েছিলেন, তিনি ইসরায়েলকে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর ঝুঁকিতে ফেলেছেন।
সত্যি কথা হলো, এর আগে এসব ক্ষেত্রে যে পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে কিছু ঘটেনি, তা–ই আমাদের জন্য যথেষ্ট ভালো হয়েছে। হ্যাঁ, আমরা কখনোই এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য মূল্য দিইনি। কয়েক বছর ধরে ইসরায়েল ক্রমাগতভাবে ইরানকে প্ররোচিত করে যাচ্ছে এবং তা লেবানন, সিরিয়া, এমনকি ইরানের মাটিতেও। এটা মনে করা অবশ্যই বোকামি হবে যে ইসরায়েল যে দড়ি ধরে টানছে, তা কখনোই ছিঁড়ে পড়বে না। সেই সময় বোধ হয় এসেও পড়েছে।
অ্যামোস হারেলের মতো পরিমিতবোধসম্পন্ন সামরিক বিশ্লেষক গত শুক্রবার হারেৎসে লিখেছেন যে জাহেদি এবং গাজায় ইসমাইল হানিয়ার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে যথেষ্ট বিচার-বিবেচনা না করে। হারেল জানাচ্ছেন, সংশ্লিষ্ট ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তারা এসব কাজের পূর্বাপর আলোচনা করেননি। এটা মনে করা রীতিমতো মূর্খতা যে ইরান কখনোই এসব প্ররোচনার প্রতিক্রিয়া জানাবে না।
সিরিয়ায় একজন কুদস (ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের বৈদেশিক শাখা) কমান্ডারকে হত্যার সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে প্রথমে আলাপ বা তর্ক না করে যে কিনা এ রকম একটি বিপজ্জনক অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত দিতে পারে, সে নিজেও একজন বিপজ্জনক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন লোক, যার কর্মকাণ্ডের জন্য আমাদের সবাইকে মূল্য দিতে হবে। হারেল বলছেন, দামেস্কে হত্যাকাণ্ডটি পরিচালিত হয়েছে সামরিক চাপে। যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সুনির্দিষ্টভাবে বললে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, এই অভিযান অনুমোদন করেছেন, তিনি অবশ্যই এর জন্য পুরোপুরি দায়ী এবং পরিণতির দায়ভারও তাঁরই।
এটা স্পস্ট ভাষায় ও উচ্চকণ্ঠে বলতে হবে, যদি ইরানের সঙ্গে চলতি সপ্তাহে যুদ্ধ বেধে যায় অথবা ইরান যদি ইসরায়েলে ভয়াবহ হামলা চালায়, তাহলে তার দায়দায়িত্ব অবশ্যই তাদের ঘাড়ে বর্তাবে, যারা দামেস্কের হত্যাকাণ্ড অনুমোদন করেছে।
গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এটা ছিল সুনির্দিষ্টভাবে ইরানিদের হত্যার দ্বিতীয় ঘটনা। ইরান যেখানে চিন্তিত, সেটা হলো প্রজ্ঞার জায়গায়। এখানে নৈতিকতা বা ন্যায়বিচারের কোনো বিষয় নেই। যখন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী গাজায় ক্রমাগত রক্ত ঝরিয়ে অনেকটাই ধুঁকছে, লেবাননের সঙ্গে ইসরায়েলের সীমান্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে এবং পশ্চিম তীর আবারও হুমকি হয়ে উঠেছে, তখন ইরানকে প্ররোচিত করা এমন এক বিপজ্জনক কাজ, যা উপেক্ষা করা যায় না। দামেস্কে হামলার দিন থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে, যখন থেকে ইসরায়েলিরা একে অন্যকে দেখেও না দেখার ভান করছে এবং এ ঘটনার প্রতিবেদনগুলো নিয়ে আবোল-তাবোল বকে যাচ্ছে।
বিপদটা আরও পরিষ্কার হয়ে গেছে, যখন একটি ইরানি হামলা অনিবার্য। তা ছাড়া এটা বিশ্বাস করাও কঠিন যে এরপর ইসরায়েল সংযম দেখাবে ও যুক্তিসংগত আচরণ করবে। ইরানি হামলার পরপরই ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালাবে, যার মধ্য দিয়ে আমরা এমন এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ব, যেখানে প্রতিপক্ষ হলো ইসরায়েলের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সবচেয়ে বিপজ্জনক শত্রু।
যারা দামেস্কে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পরিকল্পনা করেছিল, যারা এটা অনুমোদন করেছিল, আর যারা এটা ঘটিয়েছিল, তাহলে তারা সবাই কি এটাই চেয়েছিল? ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধানো কি সত্যি আমাদের এখন প্রয়োজন?
কেউ যেন আবার এটা না বলে যে আর কোনো উপায় ছিল না। উপায় অবশ্যই ছিল—কোনো হত্যাকাণ্ড না ঘটানো। যদি এটা প্রয়োজনীয় হয়ে থাকে, যদি এটা অনুমোদনযোগ্য হয় এবং যদি এটা সম্ভবও হয়, তাহলেও না। যে ব্যক্তি হত্যাকারীদের পাঠিয়েছিলেন, তিনি ইসরায়েলকে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর ঝুঁকিতে ফেলেছেন।
গিডিয়ন লেভি একজন ইসরায়েলি সাংবাদিক।
হারেৎস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ আসজাদুল কিবরিয়া।