আমাদের ছোটবেলায় আমরা খবরের কাগজে দেখতাম, মাধ্যমিক পরীক্ষায় কিংবা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্ব অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের ছবি বের হতো, খবর বের হতো। এদের বলা হতো স্ট্যান্ড করা।এখন সংবাদমাধ্যমগুলো, বিশেষ করে অনলাইনে, প্রতিযোগিতা দিয়ে ছাপা হচ্ছে বিসিএস পরীক্ষায় ভালো করা ব্যক্তিদের খবর, সাক্ষাৎকার, কাহিনি।
অন্যদিকে সমালোচনাও শুরু হয়েছে, বিসিএস পরীক্ষায় কেউ ভালো করলেই তাঁর খবর সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করতে হবে কেন? বিসিএস কবে থেকে সমাজের জন্য ‘আদর্শ’ হয়ে উঠল? বিসিএস সমাজে ‘আদর্শ’ হয়ে উঠেছে কি না, জানি না, ‘আকর্ষণীয়’ ও ‘আদরণীয়’ যে হয়ে উঠেছে, তার প্রমাণ তো দেখতেই পাচ্ছি। ২০২৩ সালে ৪৫তম বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি পর্যায়ে অংশ নেন ২ লাখ ৬৮ হাজার ১১৯ জন। ৪৫তম বিসিএসের মাধ্যমে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। অবশ্য ফরম পূরণ করেছিলেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার।
এই পরীক্ষার্থীরা বিসিএস পরীক্ষার জন্য দিবারাত্রি হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন। বিসিএস গাইড পড়তে পড়তে তাঁরা রক্ত পানি করে ফেলেন। যত পরিশ্রমই করুন না কেন, ২ লাখ ৬৮ হাজারের মধ্যে কেবল ২ হাজার ৩০৯+১ হাজার ২২ জনই কৃতকার্য হতে পারবেন। বাকি ২ লাখ ৬৫ হাজারই ব্যর্থ হবেন। পদ যেখানে ৩ হাজার, প্রার্থী যেখানে ৩ লাখ, সাফল্যের সম্ভাবনা সেখানে মাত্র ১%, ৯৯ জনই সেখানে ব্যর্থ হতে বাধ্য।
৯৯ জনই ব্যর্থ হবেন যেখানে, সেখানে এই মরিয়া প্রচেষ্টা কেন?
এক নম্বর কারণ, দেশে বেকারত্বের হার খুব বেশি। যুবকদের হাতে কাজ নেই। পরিস্থিতি কত ভয়াবহ হলে আমাদের যুবকেরা রবারের নৌকায় উঠে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ পৌঁছানোর চেষ্টা করেন এবং অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দেন! এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য একের পর এক সুযোগ, ক্ষমতা, সম্মান দেওয়ার বিষয়টি। তাঁদের বেতন দেওয়া হয়েছে বাড়িয়ে।
এখন বিসিএস হয়ে পড়েছে তরুণ-তরুণীদের স্বপ্নের সিঁড়ি। যাঁরা সফল হচ্ছেন, তাঁদের অভিনন্দন। কিন্তু যে ৯৯ শতাংশ নিশ্চিতভাবে কৃতকার্য হবেনই না, তা তাঁরা যতই বিসিএস গাইড মুখস্থ করুন না কেন, যতই সারা রাত লাইব্রেরিতে জেগে পড়া মুখস্থ করুন না কেন, তাঁদের আমরা কী বলব, তাঁদের জন্য আমরা কী করব? এইখানেই ওই প্রশ্নটা আসে যে, গণমাধ্যমগুলো যদি বিসিএসে উত্তীর্ণদেরই সমাজের হিরো হিসেবে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা দেয়, বাকি ৯৯ শতাংশের ওপরে তার প্রতিক্রিয়াটা কী হবে?
২২ আগস্ট ২০২৩ প্রথম আলো অনলাইনে সুবাইল বিন আলম ‘সরকারি চাকরিতে “বেশি সুবিধা” দিয়ে কেন এই বিভাজন?’ শিরোনামে একটা কলাম লিখেছেন। তাতে দেখতে পাচ্ছি, সরকারি কর্মকর্তাদের দেওয়া হচ্ছে আর্থিক সুবিধা, বছরে ৫% প্রণোদনা, মামলা-মোকদ্দমায় দায়মুক্তি, যেমন সরকারি চাকরিজীবীদের গ্রেপ্তারের জন্য নিতে হবে পূর্বানুমতি, ‘সরল মনে করা ভুল’ হিসেবে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রজেক্টের আইনে। দেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত পদোন্নতির সুযোগ, তাঁদের দেওয়া গাড়ির দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, আয়করে নানা রকমের ছাড়, পেনশন সুবিধা। তবে এগুলো বাহ্য। আসলে বিসিএস কর্মকর্তাদের দেওয়া হয়েছে প্রভূত ক্ষমতা। এবং তাঁদের আয়ের রয়েছে আশ্চর্য রকমের সুযোগ।
তা সত্ত্বেও বলব, সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন আসলে বেশি নয়। রাষ্ট্রপতির বেতনই ১ লাখ ২০ হাজার। বাকিদের বেতন এর চেয়ে কম। ১৯৯৪ সালে বিসিএস ক্যাডারের শুরুর বেতন ছিল ৪৪০০ টাকার মতো। এই আয়ে কোটি টাকার ফ্ল্যাট হওয়ার কথা নয়।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান (সাবেক সচিব এবং কলাম লেখক) প্রথম আলোয় ৩ জুন ২০২১ লিখেছিলেন: ‘সচিব এবং উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান, বারিধারা, উত্তরা, পূর্বাচল, লালমাটিয়া, ডিওএইচএসে অট্টালিকা, প্লট, ফ্ল্যাট থাকে। বাগানবাড়ি থাকে। গরু-মহিষের বাথান, চিংড়িঘের, রিসোর্ট, ইন্ডাস্ট্রিসহ নানা কিছু থাকে। আবার অনেকের নিউইয়র্ক, টরন্টো, দুবাই, সিঙ্গাপুর, হিউস্টনে অ্যাপার্টমেন্ট, বাড়ি, মলের মালিকানা থাকে।’
এই লেখা থেকে বাস্তবতা আমরা খানিকটা আন্দাজ করতে পারি। যা-ই হোক না কেন, এখন বিসিএস হয়ে পড়েছে তরুণ-তরুণীদের স্বপ্নের সিঁড়ি। যাঁরা সফল হচ্ছেন, তাঁদের অভিনন্দন। কিন্তু যে ৯৯ শতাংশ নিশ্চিতভাবে কৃতকার্য হবেনই না, তা তাঁরা যতই বিসিএস গাইড মুখস্থ করুন না কেন, যতই সারা রাত লাইব্রেরিতে জেগে পড়া মুখস্থ করুন না কেন, তাঁদের আমরা কী বলব, তাঁদের জন্য আমরা কী করব?
এইখানেই ওই প্রশ্নটা আসে যে, গণমাধ্যমগুলো যদি বিসিএসে উত্তীর্ণদেরই সমাজের হিরো হিসেবে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা দেয়, বাকি ৯৯ শতাংশের ওপরে তার প্রতিক্রিয়াটা কী হবে?
১৮৫৮ সালে প্রথম আইসিএস চালু হয় ব্রিটিশ ভারতে। তখন নাম ছিল ইম্পেরিয়াল সিভিল সার্ভিস। পরে নামকরণ করা হয় ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৩ সালে প্রথম ভারতীয় হিসেবে আইসিএস পাস করেন। রবীন্দ্রনাথ নিজে আইসিএস পরীক্ষা দেবেন বলে বয়সের সনদের জন্য আবেদন করেছিলেন।
তিনি লেখেন, তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য ইংল্যান্ড যাচ্ছেন, বিধি অনুযায়ী এ জন্য বয়স প্রমাণের প্রত্যয়ন লাগবে। এ ব্যাপারে যেন তাঁকে একটি প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়। বয়সের প্রমাণ হিসেবে তিনি কোষ্ঠী জমা দেবেন। এ জন্য তাঁকে যখনই যেতে বলা হবে, তিনি যাবেন। [ভুঁইয়া ইকবাল, প্রথম আলো ঈদসংখ্যা ২০১৮]
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আইসিএস পরীক্ষায় বসলে এবং পাস করলে এবং চাকরি করলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াত, কল্পনা করাও মুশকিল! যদিও আমরা অনেক আইসিএস, সিএসপি এবং বিসিএস কর্মকর্তা পেয়েছি, যাঁদের নাম করতে আমাদের মুখোজ্জ্বল হয়! দেশের জন্য, সমাজের জন্য তাঁদের অবদান আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করব।
কিন্তু ধরা যাক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আইসিএস অফিসার হিসেবে সাফল্য অর্জন করলেন। তাহলে ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার কে পাবেন? তখন ১৯৬০-এর দশকে ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’ বলে ঢাকার রাজপথ কাঁপানোর প্রেরণা আমরা কতটা পেতাম!
১৯৫০ বা ১৯৬০-এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকারীরা শিক্ষকতা করতেন, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যেতেন, অনেকেই ফিরে আসতেন। ওই সময় শিক্ষকতা ছেড়ে কেউ সিএসপি হলে তা নিয়ে সমাজে শোরগোল উঠত। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একটা কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে: ‘দেশে কোন বিজ্ঞানী নেই, গবেষক নেই, দার্শনিক নেই। আছে কেবল প্রশাসক।’
এর পেছনে আছে একটা মৌলিক সমস্যা। তা হলো, প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ, এই মৌলিক প্রত্যয় থেকে আমরা সরে এসেছি। কথাটা প্রশাসক হওয়ার কথা নয়। প্রশাসক তিনি, যিনি শাসন করেন। আসলে তাঁরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, জনগণের সেবক। সেই জনগণ, যাঁরা প্রজাতন্ত্রের মালিক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমি সরকারি কর্মচারীদের বলব, মনে রেখো, এটা স্বাধীন দেশ। ব্রিটিশ কলোনি নয়। পাকিস্তান কলোনি নয়। তোমরা ওদের টাকায় বেতন নাও।...
‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনে দেয় ওই গরিব কৃষক। আপনার মাইনে দেয় ওই গরিব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন। ওদের ইজ্জত করে কথা বলুন। ওরাই প্রকৃত মালিক। ওদের টাকায়ই আপনাদের সংসার চলে।’
এ কথার ভিত্তিতে যদি প্রশাসন চলত, প্রশাসন না বলে যদি বলতে পারতাম সেবাযন্ত্র, তাহলে বহু সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। আমরা তো সেবক দেখি না, শুধু মালিক দেখি।
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক