বিশ্লেষণ
সীমান্তঘেঁষা মেঘালয়ের গ্রামগুলোতে যে কারণে উত্তেজনা
বিজেপি সরকার ২০১৯ সালে তৈরি সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) কার্যকরের ঘোষণা দেওয়ার পরপরই ভারতে অস্থিরতা শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা মেঘালয়ের গ্রামগুলোতে সিএএ নিয়ে কেন এই অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে লিখেছেন আলতাফ পারভেজ।
এসব অনেকেরই জানা, ইতিহাসে অন্তত দুবার মেঘালয় ও বাংলা একই ভৌগোলিক-রাজনৈতিক সীমানাভুক্ত ছিল। শেষবার সেটা ১৯০৫ থেকে ১৯১২ পর্যন্ত, ঢাকা যখন প্রদেশের প্রধান শহর আর শিলং গ্রীষ্মকালীন রাজধানী। ১৯০৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ববাংলা এবং মেঘালয়সহ আসামের আইনসভার প্রথম অধিবেশন বসেছিল শীতকালীন রাজধানী ঢাকাতেই।
এক শতাব্দী আগের সেসব ইতিহাস ব্যাপক পাল্টে গেছে। প্রতিবেশী হয়েও মেঘালয়ের সঙ্গে বাংলার সাংস্কৃতিক যোগাযোগ এখন সামান্য। সে কারণেই হয়তো আমরা খেয়াল করছি না বাংলাদেশ-সংলগ্ন মেঘালয়ের গ্রামগুলো এ মুহূর্তে বেশ অশান্ত। বিজেপি সরকার ২০১৯ সালে তৈরি সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ বা ক্যা-১৯) কার্যকরের ঘোষণা দেওয়ার পরপরই মেঘালয়ে অস্থিরতা শুরু হয়ে গেছে। যে অস্থিরতায় থেমে থেমে নাম আসছে বাংলারও।
বদলে যাওয়া সময়ের কফিনে ‘ক্যা-১৯’-এর পেরেক
রাজ্য হিসেবে মেঘালয়ের জন্ম বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের এক মাস পরে। আসামের খাসি, জয়ন্তিয়া ও গারোদের পাহাড়ি অঞ্চল কেটে মেঘালয় গড়ে উঠেছিল। আয়তনের হিসাবে এটা ভারতের ২৪তম রাজ্য।
নতুন এই রাজ্য গঠনকালে ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে স্থানীয় বাঙালিরাও তুমুল অভিনন্দন জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। যেমনটি তখন তিনি প্রশংসিত হচ্ছিলেন বাংলাদেশের জন্মে সহায়তা-সমর্থন দিয়ে। তবে বাঙালিসহ ‘হিল ট্রাইব’ নয় এমন সবার সেই উচ্ছ্বাস এখন আর নেই।
ছোট্ট এই পাহাড়ি জনপদ ইদানীং প্রায়ই আঞ্চলিক খবর হয়ে ওঠে তার আন্তজাতি-সংঘাতের কারণে। বিশেষ করে বাংলাভাষী বিদ্বেষের সূত্রে। ‘ক্যা-১৯’ সম্প্রতি সেই বিদ্বেষের মনস্তত্ত্ব আরও উসকে দিয়েছে। গত ২৭ মার্চ এখানকার বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন ইচ্ছামতি এলাকায় কোনো কারণ ছাড়াই বাংলাভাষী অভিযোগে দুজন মানুষ খুন হলেন এবং স্থানীয়দের দাবি মতে অন্য দুজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো।
বাংলাভাষী ভেবে খুন করা হলেও নিহত ব্যক্তিদের একজন ছিল স্থানীয় এক সংখ্যালঘু ট্রাইবের সদস্য। কোনো ধরনের উসকানি ছাড়াই খাসি তরুণেরা এটা ঘটায় তাদের ভাষায় ‘ক্যা-১৯’ নামে পরিচিত নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে।
২০২০ সালেও এই এলাকায় এ রকম সাম্প্রদায়িক অত্যাচার-নিপীড়ন হয়। ‘ক্যা-১৯’ সামনে রেখে সে সময়ের মতো আবারও মেঘালয়সহ পুরো উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাভাষী বিদ্বেষের আবহ ধূমায়িত হয়ে উঠেছে। আসন্ন নির্বাচনকালে এবং নির্বাচনের পরে এ নিয়ে বাড়তি উত্তেজনার আলামতও আছে।
উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলোতে এ মুহূর্তে প্রায় দেড় কোটি বাংলাভাষী আছেন। আর কয়দিন পরেই বাংলা নববর্ষ উদ্যাপিত হবে। ঢাকা, কলকাতা, শিলচর, আগরতলায় চলছে তার তুমুল প্রস্তুতি। বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩০ কোটি বাংলাভাষী এখন। কিন্তু নতুন করে বাংলা বর্ষবরণের প্রস্তুতিতে থাকা এই বিশ্ব-বাঙালি সমাজ উত্তর-পূর্ব ভারতীয় বাংলাভাষীদের চলতি সংকটের কথা কতটা জানেন? তাঁদের কথা কতটা ভাবছেন?
যেখানে বাংলাভাষীরা ‘ডকার’
মেঘালয়ের জনসংখ্যায় বাংলাভাষী ৭-৮ শতাংশের বেশি নয়। শিলংয়েও অল্পসংখ্যক বাঙালি আছেন এখনো। শিলংকে ঔপনিবেশিক অভিজাতেরা আদর করে বলতেন ‘প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড’। ১৮৬৬ সালের ২৮ এপ্রিল ব্রিটিশ অফিসাররা কিছু জমি লিজ নিয়ে এই স্কটল্যান্ডের গোড়াপত্তন করেন।
বাংলা নববর্ষের দুই সপ্তাহ পরই শিলংয়ের জন্মদিন। প্রতিষ্ঠার আট বছর পর উদীয়মান এই শহর আসামের রাজধানী হয়। শিলংয়ে থাকা নিয়ে ‘সিলেটি’ অভিজাতদের বিশেষ গৌরব ছিল এককালে। কিন্তু ১৯৭৯ সালের কার্তিকের অমাবস্যায় এক বড় দাঙ্গায় ঐতিহাসিক সেই বন্ধন টুটতে শুরু করে। তার আগের বছর সেখানে গড়ে ওঠে খাসি স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (কেএসইউ)। জাতিগত প্রশ্নে তাদের অবস্থান খুবই কঠোর।
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় তখন চলছিল অসমিয়াদের ‘বাংলাদেশি খেদা’ আন্দোলন। তাতে উৎসাহিত হয়ে শিলং থেকে মেঘালয়ের প্রান্তিক অঞ্চলেও বাঙালিবিদ্বেষের ঢেউ ছড়াতে পেরেছে কেএসইউ। তাদের কারণেই ১৯৮৭ সালে বছরজুড়ে কারফিউ জারি রাখতে হয় শিলংয়ে। পুরো রাজ্যের জনগণকে ‘ট্রাইবাল বনাম নন-ট্রাইবাল’ মেরুকরণে রেখে একদিকে একচেটিয়া প্রভাবশালী থাকতে চাইছে খাসিয়ারা। রাজনৈতিক এই মেরুকরণের ছাপ পড়েছে সমাজজীবনেও।
বাংলাভাষী হলেই মেঘালয়ে যে কাউকে ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহ করা বেশ সাধারণ ব্যাপার এখন। যদিও এখানকার খুব কম বাংলাভাষীর ভাবনাচিন্তায় ঢাকা বা বাংলাদেশ উপস্থিত। সিলেট, ছাতক, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ ইত্যাদি জায়গার সঙ্গে তাদের যোগসূত্র একান্তই ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে।
উত্তর-পূর্ব ভারতের অনেক শহর-উপশহরে বাংলাভাষীরা আছেন ব্রিটিশ শাসনামলের শুরু থেকে। অনেকে আছেন আগে থেকেও। শিলংয়ে যে ‘মুসলিম ইউনিয়ন’ আছে তার প্রতিষ্ঠা ঢাকায় মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠারও আগে। এখন যদিও তারা সংখ্যায় সামান্যই। এ রকম হিন্দু-মুসলমান বাংলাভাষী সবাই এখন বিভেদবাদী রাজনীতির সূত্রে সাধারণভাবে ‘অপর’।
মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে দেখা গেছে, বাংলাভাষীদের ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলেও একজন খাসিয়াকে সামনে রেখে করতে হয়। অর্থাৎ অনেকটাই ট্রাইবালদের ওপর নির্ভর করতে হয় তাঁদের। খাসিরা বাংলাভাষীদের এখানে বলে ‘ডকার। এটা একটি গালি। আশপাশের জনপদের ট্রাইবাল-ননট্রাইবাল সম্পর্কের উল্টো চিত্র হয়তো এটা। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো এলাকা যে আজও সমমর্যাদার জাতিগত সম্পর্কের ব্যাকরণে আসতে পারল না তার হতাশাজনক এক নজির মেঘালয়ের এই চিত্র।
লাইন-প্রথার দাবি বনাম বাংলাদেশের দেওয়া যোগাযোগসুবিধা
‘ক্যা’ ঘোষণার পর মেঘালয়ে বাঙালিদের সংকট বাড়ার পেছনে আরএসএস পরিবারের বেশ অংশগ্রহণ আছে। এখানকার বাঙালিদের ভেতর হিন্দুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। ভোটের রাজনীতির কারণে আরএসএস পরিবার হিন্দুবান্ধব অবস্থান নিয়ে ‘ক্যা-১৯’-এর বাস্তবায়ন চাইছে। এই চাওয়ার ভেতরেও আছে বিশাল ফাঁকফোকর।
উত্তর-পূর্ব ভারতীয় ট্রাইবাল এলাকাগুলোতে ভারতীয় সংবিধানের ‘ষষ্ঠ শিডিউলের’ কারণে ‘ক্যা-১৯’ বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে অনেকের ধারণা। সংবিধানের ওই ‘তফসিল’ ট্রাইবাল এলাকাকে কিছু বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে—যা দিয়ে ‘ক্যা-১৯’ ঠেকানো যায়। কিন্তু তারপরও আরএসএসের আগ বাড়ানো ক্যা-প্রীতি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অনেক এলাকার মতো মেঘালয়েও প্রধান জনগোষ্ঠী হিসেবে ট্রাইবাল সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছে।
খাসিদের কিছু সংগঠন সুযোগ পেলেই বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে জ্বালাও-পোড়াওয়ে নামতে উৎসাহী। ক্যা-১৯ ভালোভাবেই সে রকম একটি অজুহাত তৈরি করেছে। ২৭ মার্চ যে দুজন বাঙালি মারা গেলেন, তারা উভয়ে ধর্মে হিন্দু। ফলে বিজেপি একে হিন্দুবিরোধী সন্ত্রাস হিসেবে অভিহিত করে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছে।
এসব রাজনৈতিক বিরোধিতার ভেতর দিয়ে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ এবং মেঘালয়-সন্নিহিত অন্যান্য রাজ্যে হিন্দুবান্ধব দল হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চায়। এটা একই সঙ্গে তার খ্রিষ্টানবিরোধী পুরোনো রাজনীতির জন্যও বেশ কাজে লাগছে। মেঘালয়ে ধর্মীয় বিচারে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক খ্রিষ্টান। মেঘালয়-মিজোরাম-নাগাল্যান্ড-অরুণাচল নিয়ে খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠতার যে বলয়, তার মোকাবিলায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলজুড়ে হিন্দুভোট বাড়াতে চায় বিজেপি।
অভিযোগ উঠেছে ‘ক্যা’ ওই ভোটের রাজনীতির অংশ। কিন্তু খাসি সংগঠনগুলো কোনোভাবে বাংলাভাষী মানুষদের সহনাগরিক হিসেবে মানতে নারাজ। তাদের দাবি, মেঘালয়জুড়ে ‘ইনার লাইন পারমিট’ (আইএলপি) প্রথা চালু করতে হবে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা এই রাজ্যে বাংলাভাষী মানুষদের ‘অপর’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁদের চলাচল ও সম্পদের মালিকানায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায়।
‘লাইন’-প্রথার ধারণা এই অঞ্চলে গত শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে শুরু। ১৯৪৭ সালের আগে মওলানা ভাসানী অনেক বছর আসামে চরম বর্ণবাদী এই প্রথার বিরুদ্ধে বাঙালি চাষিদের হয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিলেন। মওলানার পর এ নিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর কমে গেছে। ট্রাইবাল সংগঠনগুলো ইনার লাইন প্রথার মাধ্যমে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অনেক রাজ্যে বাংলাভাষীদের কোণঠাসা অবস্থায় রেখেছে। আসামের অসমিয়া সমাজেও এ রকম দাবি আছে। খাসিরাও তাদের পুরো রাজ্যে সেটি চায়।
এমনিতে মেঘালয়ের প্রায় পুরোটাই ভারতীয় সংবিধানের ষষ্ঠ শিডিউলে পড়েছে। তবে মাঝেমধে৵ কিছু এলাকা এর বাইরেও আছে। যেমন শিলংয়ের সামান্য কিছু এলাকা ভারতীয় সংবিধানের ষষ্ঠ শিডিউলের বাইরে—যাকে আগে ‘ইউরোপিয়ান ওয়ার্ড’ বলা হতো। শিলংয়ের সবচেয়ে অভিজাত ঐতিহাসিক এলাকা এটা। ব্রিটিশ প্রশাসনের সহায়তা করতে এককালে এখানে অনেক বাংলাভাষীর ঠাঁই হয়েছিল।
খাসিদের ধারণা ‘ক্যা-১৯’ হলে বাঙালিদের এ রকম পরম্পরা চলতে থাকবে। এলাকাগুলোতে বাঙালি হিন্দুর সংখ্যা বাড়বে। প্রভাবশালী ট্রাইবাল রাজনীতিবিদেরা সেটিও বন্ধ করতে ২০১৯-এর ডিসেম্বরে রাজ্যজুড়ে লাইনপ্রথা কায়েমের আইন করে নিয়েছেন স্থানীয় বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে।
এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় আইএলপির বাস্তবায়নকে প্রধান ইস্যু করা হয়েছে এখানে। এর বাস্তবায়ন হলে অবস্থা যা দাঁড়াবে—বাইরের কাউকে মেঘালয়ে যেতে এবং কাজ করতে অনেক ধরনের প্রশাসনিক অনুমতি নিতে হতে পারে, এমনকি তারা অন্য জায়গার ভারতীয় নাগরিক হলেও।
মেঘালয়ের বিধানসভায় যে মাসে আইএলপির পক্ষে সিদ্ধান্ত হয় ২০১৯ সালের ওই মাসেই বিজেপি কেন্দ্রে ‘ক্যা’ আইন পাস করেছিল। যা এখন বাস্তবায়নের পথে ‘বাংলাদেশ-পাকিস্তান-আফগানিস্তান থেকে যাওয়া ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার’ অমুসলিমদের ভারতে নাগরিক হওয়ার সুযোগ দেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে । স্বভাবত মেঘালয়ে লাইনপ্রথা ও ‘ক্যা-১৯’ একরূপ সাংঘর্ষিক। যদিও কোনটি এখনও পুরোদস্তুর বাস্তবায়িত হয়নি। তবে এসব নিয়ে আসন্ন ভোটের আগে খাসি-জয়ন্তিয়া-গারো হিলে রাজনীতি বেশ উত্তপ্ত। আর এ রকম রাজনীতিতে কারণে-অকারণে আসছে বাংলাদেশের নাম।
বাংলাদেশ যখন উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলোকে ট্রানজিট ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের মতো একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ নানান অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে ঠিক একই সময়ে সেখানে ক্রমাগত বাংলাভাষীদের মনস্তাত্ত্বিক চাপে রাখা হচ্ছে। থেমে নেই বিভিন্ন সংগঠনের তরফ থেকে বাংলাদেশ-ভীতি-ছড়ানোর পুরোনো অভ্যাসও। যারা ট্রাইবাল নয়—গড়পড়তা এ রকম সবাই মেঘালয়ে এখন ‘ডকার’। আর ডকারদের তালিকায় ১ নম্বরে আছে বাংলাভাষীরা।
খাসিসহ স্থানীয় ট্রাইবালরা মনে করছে বাঙালিরা অন্যান্য রাজ্যে নাগরিকত্ব পেলেও মেঘালয়ে চলে আসবে। এখানে এসে তারা ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে ট্রাইবালদের ওপর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পাবে। মেঘালয়ের মতো উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য ট্রাইবাল এলাকাতেও এ রকম ভয় আছে। এই ভয়ের উৎসও আবার বিভিন্ন গোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের ‘অবৈধ-বাংলাদেশি’ বিরোধী প্রচারণা। অর্থাৎ একই উৎস থেকে দেশান্তরি বাংলাভাষী হিন্দুদের নাগরিকত্ব দিতে চাওয়া হচ্ছে এবং তাদের নিয়ে ভীতিও ছড়ানো হচ্ছে। নাগরিকত্ব দেওয়ার কাজটি যতটা রাজনৈতিক লক্ষ্যে, পরের কাজটি ততটাই সাংস্কৃতিক প্রকল্প আকারে আছে।
এসব নিয়ে বাংলাদেশের এখনো কোন দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়া নেই। সীমান্তের অনেকগুলো পয়েন্ট দিয়ে মেঘালয় বাংলাদেশে খনিজের বেচাবিক্রি চালাচ্ছে। সিমেন্ট শিল্পের জন্য বিপুল চুনাপাথর আসে। প্রথাগত এলসির মাধ্যমেও অনেক বন্দর দিয়ে ব্যবসা হচ্ছে। খনিজ এবং পর্যটন ছাড়া মেঘালয়ের বড় অঙ্কের অর্থ আয়ের বিশেষ কিছু নেই।
কিন্তু বাণিজ্যিক লেনদেনের ১১টি পয়েন্টের (দুটি সীমান্ত হাট+৯টি স্থলবন্দর) উপাত্তে গবেষকেরা দেখেছেন, বাংলাদেশের তুলনায় মেঘালয়ই রপ্তানিতে এগিয়ে। হয়তো মেঘালয়ের বাইরে অন্য রাজ্যের অনেক পণ্যও এই পথে আসে। এর পাশাপাশি জয়ন্তিয়া হিলের ডাউকি দিয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর মানুষ মেঘালয়ে বেড়াতে যান। সেখানে বৃষ্টির জন্য বিখ্যাত মৌসিনরাম, চেরাপুঞ্জি, স্বচ্ছ পানির বিখ্যাত নদী উমগট এবং পরিচ্ছন্নতার জন্য খ্যাতি পাওয়া মাওলিনং গ্রাম বাংলাদেশিদের কাছে জনপ্রিয় গন্তব্য।
বাংলাদেশে খনিজ বেচে এবং সেখানকার পর্যটকদের থেকে মেঘালয় বেশ আয় করে। শিলংয়ের শিক্ষাসুবিধাও বাংলাদেশি ধনী পরিবারগুলোর কাছে বেচার ইচ্ছা তাদের। কিন্তু রাজ্যের স্থানীয় রাজনীতি বাংলাদেশ ও বাংলাভাষী-বিরোধিতা কোনোমতেই কমাতে চাইছে না বলে দেখা যাচ্ছে। অন্তত ২৭ মার্চের জোড়া খুন পরোক্ষে সেটিই জানিয়ে গেল।
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিষয়ক গবেষক