অর্থনীতিতে মনোযোগের সংকট সরকারের

সেনাপতির মনোযোগের অভাব পরাজয়ের পূর্বশর্ত। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরুর আগে পাণ্ডবপক্ষের বিচলিত অর্জুনকে এ কথাই বলেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। ক্ষমতা গ্রহণের আড়াই মাস পর মনে হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারও যেন ভুলে গেছে যে তাদের শাসন অনন্তকালের নয়। তাদের প্রথম কাজ হচ্ছে বিপন্ন অর্থনীতিকে রক্ষা করা। কারণ, তারা বছর দুয়েক এই সিংহাসনে থাকবে। রাষ্ট্র সংস্কারের স্বার্থে প্রায় দুবছর ক্ষমতায় থাকাটা তাদের জন্য প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়।

এই সরকার পূর্বেকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো যদি মাত্র মাস তিনেক অবস্থান করত, তাহলে অর্থনীতি নিয়ে অত চিন্তা না করলেও হতো। কিন্তু দুবছর অর্থনীতি বেহাল অবস্থায় রাখা সম্ভব নয়। তাই অর্থনীতিতে জরুরি মনোযোগ আবশ্যক। 

অর্থনীতিকে ন্যূনতম সুস্থ অবস্থায় টিকিয়ে রেখে এর পাশাপাশি যথাসম্ভব রাষ্ট্র সংস্কার করে মানবাধিকারের নিশ্চয়তা এনে অন্তর্ভুক্তিমূলক নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা এই সরকারের কাজ। একটা গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার সূত্রপাত করা উপদেষ্টাদের পবিত্র দায়িত্ব।

গত সরকারের অযোগ্যতম অর্থমন্ত্রী যেভাবে খেলাপি ঋণের নতুন সংজ্ঞা দিয়েছেন, সেই আদলে ইতিহাসের নতুন ব্যাখ্যার দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর অর্পিত হয়নি। এসবের পেছনে নানামুখী বিতর্ক সৃষ্টি করে সময় পার করলে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে না পড়া পর্যন্ত অর্থনীতি বিনিয়োগ আস্থায় গতিশীল হবে বলে মনে হয় না। 

যে অর্থনীতি এখন শতকরা ৮ থেকে ১০ প্রবৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করতে পারত, তার কপালে কিনা এই অর্থবছরে জুটবে শতকরা ৪ ভাগ প্রবৃদ্ধির সান্ত্বনা পুরস্কার! বিশ্বব্যাংক সে রকম পূর্বাভাসই দিয়েছে। এই একটি বার্তাই অন্তর্বর্তী সরকারকে সচেতন করার জন্য যথেষ্ট। তার চেয়েও বড় বার্তা মূল্যস্ফীতির নিরন্তর দহন। অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন যে মূল্যস্ফীতি আগের চেয়ে শতকরা ১ ভাগ কমেছে। কিন্তু তাতে মানুষের কষ্ট কমেছে কি না, সেটিই দেখার বিষয়। যাঁরা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও শাকসবজি কিনতে বাজারে যান, তাঁদের প্রতিক্রিয়া ভালো নয়। কেউ বলছেন, আগেই ভালো ছিল। 

আইন উপদেষ্টা নিত্যপণ্যের উচ্চ মূল্যের জন্য জনতার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। ভালো লক্ষণ। কিন্তু তাঁর সব সহকর্মীকে এ বিষয়ে আরও মনোযোগী হতে হবে। আগের সরকারের একজন পরিকল্পনামন্ত্রী মনমতো তথ্য বানাতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের হার কম দেখিয়ে বাড়িয়ে দিতেন প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের অঙ্ক। তাঁর এই হাতযশের গুণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী পরের মেয়াদে তাঁকে অর্থমন্ত্রীও বানিয়ে দিয়েছিলেন। লুণ্ঠনের সহায়তা কর্মেও তাঁর নামডাক ছিল বিস্তর। তিনি বানোয়াট তথ্যে দেশকে প্রায় ‘উন্নত’ বানিয়ে ফেলেছিলেন। তবে সাধারণ মানুষ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া অঙ্কের ধার ধারে না। তারা বোঝে যে তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। আয়বৈষম্য বাড়ছে। 

মূল্যস্ফীতি উঁচু রয়েই যাচ্ছে। কারণ, মানুষ তারল্য নিজের কাছে ধরে রাখতে চায়। তাই ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হিড়িক। ‘দরবেশ’ ও ‘আউলিয়াদের’ পাল্লায় পড়ে কমপক্ষে ১০টি ব্যাংক নড়বড়ে কিংবা মতান্তরে মুমূর্ষু। তাই ওই সব ব্যাংক থেকে টাকা তুলে রাখতে চায় আমানতকারীরা। ঢেউ প্রভাব বা ‘রিপল ইফেক্ট’-এর কারণে অন্য ব্যাংকগুলোও গ্রাহকদের অনাস্থার শিকার হয়েছে। তারাও সমাজে অপ্রয়োজনীয় তারল্য বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতিকে চড়া করে রেখেছে। 

প্রায় তিন বছর মূল্যস্ফীতির অত্যাচার অব্যাহত রয়েছে। অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। তৎপর রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও। তিনি কয়েক দফা সুদের হার বাড়িয়েছেন, যা ঋণ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়েছে। তবে বিনিয়োগ কমে যাবে বৈকি। ষাটটির মধ্যে অর্ধেকের বেশি ব্যাংকে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়ে গেছে, যা বিনিয়োগে মন্দক্ষুধার নির্দেশক।

মূল্যস্ফীতি উঁচু রয়েই যাচ্ছে। কারণ, মানুষ তারল্য নিজের কাছে ধরে রাখতে চায়। তাই ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হিড়িক। ‘দরবেশ’ ও ‘আউলিয়াদের’ পাল্লায় পড়ে কমপক্ষে ১০টি ব্যাংক নড়বড়ে কিংবা মতান্তরে মুমূর্ষু। তাই ওই সব ব্যাংক থেকে টাকা তুলে রাখতে চায় আমানতকারীরা। ঢেউ প্রভাব বা ‘রিপল ইফেক্ট’-এর কারণে অন্য ব্যাংকগুলোও গ্রাহকদের অনাস্থার শিকার হয়েছে। তারাও সমাজে অপ্রয়োজনীয় তারল্য বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতিকে চড়া করে রেখেছে। 

উপদেষ্টারা সম্মিলিতভাবে এই জায়গায় কাজ করতে পারেন। পোর্টফোলিও কার কোনটি, তাতে কিছু যায় আসে না। যেমন তথ্য উপদেষ্টার কাজ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ নয়। কিন্তু আন্তরিক মনোযোগ থাকলে তিনিও মিডিয়াকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন, তাঁরা যেন বিভিন্ন স্থানে নানা প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারমূল্য তুলে ধরেন। অর্থনীতির জন্য তথ্য এক শক্তিশালী পণ্য, যা ন্যায্যমূল্য, দামের সমতা ও সুষ্ঠু বণ্টনকর্মে সহায়তা জোগায়। তাই অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, সংবাদপত্র স্বাধীন থাকলে দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না।

অন্যদিকে সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টারও মূল্যস্ফীতি দমনে ভূমিকা বিশাল। বর্তমান মূল্যস্ফীতির পেছনে একটা বড় কারণ সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি।

শোনা যায়, ১৫ বছরের অভুক্ত চাঁদাবাজেরা ৫ আগস্টের বিকেল থেকেই দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। কলুষিত রাজনীতির জগতে বাস করে আমরা তাঁদের স্বাগত জানাতে বাধ্য। কিন্তু আপত্তি এই যে নব্য চাঁদাবাজদের ‘রেট’ আগেরগুলোর চেয়ে অনেক উচ্চ। কারণ, নবাগতরা ১৫ বছরের মূল্যস্ফীতির চক্রবৃদ্ধি হার হিসাব করে নতুন ‘পে-স্কেল’ ঠিক করেছেন। 

চাঁদাবাজদের আরেক গোপনীয়তার নিয়ম হচ্ছে, সংখ্যালঘুরা বেশি চাঁদা দেবেন, কিন্তু তাঁরা তা প্রকাশ করতে পারবেন না। পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি এখন সর্বকালের সর্বোচ্চ। কারণ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বর্তমানে ইতিহাসের দুর্বলতম বিভাগ। এর কোথাও কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। এই বিভাগের আন্তরিক মনোযোগ ছাড়া উচ্চ মূল্যের তীব্রতা কমানো সম্ভব নয়।

বাণিজ্য, স্বরাষ্ট্র, তথ্য, যোগাযোগ, রেল ও নৌপরিবহন, স্থানীয় সরকার, জ্বালানি, বিচার, আইন ও অর্থ বিভাগগুলোর অখণ্ড মনোযোগই পারে মূল্যস্ফীতি কমাতে। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখন অনেকটাই প্রাতিষ্ঠানিক, অর্থনৈতিক নয়। 

মুদ্রানীতিগত বিষয়গুলো ইতিমধ্যে আমলে এনে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বিশ্ববাজারের ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম ২০২২ সালের মে মাসে ১২৪ ডলারে উঠে গেলেও ২০২৪-এর এই অক্টোবরে ৭০ ডলারে নেমে এসেছে। বিশ্বের সব পণ্যের সূচক মূল্য ২০২২-এ এই দিনে ২৩০-এ উঠেছিল। সেটি আজ নামতে নামতে ১৬৪-এ ঠেকেছে। পণ্য ও তেলের এতটা অনুকূল বিশ্ববাজার গত চার বছরেও ছিল না। সমস্যা বাংলাদেশের ভেতরে এবং সরকারের ভেতরে।

এসব জরুরি বিষয় বাদ দিয়ে সরকার কোন দিবস বাদ দেবে, ‘জাতির জনক’ খেতাব সরালে কী কী উপকার হবে, ৫৬ বছর আগে কোন নেতার কী ভূমিকা ছিল—এসব ইতিহাস সংস্কারে মনোযোগ দিয়েছেন। এগুলোর বিতর্কে বাগ্মিতার ঝাঁজ থাকলেও নেই অর্থনীতির কোনো কাজ। 

এই পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ পলিথিন নিষিদ্ধকরণ। এই কাজের দ্বিমুখী তাৎপর্য রয়েছে। প্রথমত, এতগুলো ‘জনদরদি’ সরকার বাংলাদেশ পেয়েছে, কিন্তু কেউ এ কাজটিকে গুরুত্ব দেয়নি। কারণ, পলিথিন ফ্যাক্টরির মালিক কখনো কোনো না কোনো রাজনৈতিক ‘দল’ করেছে অথবা ‘লীগ’ করেছে। তাতেই সাত খুন মাফ। তাদের মধ্যে কেউ যদি ঋণখেলাপি হয় তাহলে সে নির্বাচনে ‘নমিনেশন’ পেয়েছে। অর্থাৎ কোনো রাজনৈতিক দল যা করবে না, সেগুলো অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এই সরকার সম্পন্ন করুক, এটিই প্রত্যাশা। পরিবেশ উপদেষ্টা সে রকম একটি তিক্ত বিষয় হাতে নিয়েছেন। 

দ্বিতীয় তাৎপর্য হলো এক দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা। রাজনীতিকেরা খুব অল্পই এসব দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করেন। তাই তাঁরা পুলিশের সংস্কার ঘটালেও গোয়েন্দা বিভাগের সংস্কারে হাত দেন না। কারণ, ক্ষমতায় গেলে গোয়েন্দাদের দলীয় কাজে ব্যবহার করা যায়। ঢাকার যানজট ও বায়ুদূষণ পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ। বাসমালিকেরা ‘মুড়ির টিন’ দাবড়িয়ে কোটি টাকার মুনাফা করেন। যাত্রীরা নিরুপায় ও অসহায়। 

পোশাক কারখানায় মধ্যাহ্নে মালিকপক্ষ খাবার জোগান দিলে স্বাস্থ্য ও উৎপাদনশীলতা বাড়ে কি না, এসব বিষয়ের মীমাংসামূলক সংস্কার এই সরকার করলে জাতি দীর্ঘ মেয়াদে উপকার পাবে। কারণ, এই কাজগুলো রাজনীতিকেরা করতে আগ্রহী হবেন না। চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট নির্মূল করা শুধু স্বরাষ্ট্রবিষয়ক কাজ নয়, এতে অর্থনীতির উপকার অনেক বেশি। এই সরকার সেদিকে অখণ্ড মনোযোগ আনবে, এটিই প্রত্যাশা। 

 ● ড. বিরূপাক্ষ পাল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ড-এ অর্থনীতির অধ্যাপক