যে কারণে সি চিন পিংকে নজিরবিহীন সংবর্ধনা দিল সৌদি

বাইডেন ও ট্রাম্পকে যেভাবে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল, সে তুলনায় সি চিন পিংকে অনেক বেশি জাঁকজমকপূর্ণভাবে স্বাগত জানানো হয়েছে।
ছবি : রয়টার্স

সৌদি আরবে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সদ্য সমাপ্ত তিন দিনের সফর নানা জল্পনা-কল্পনার সূত্রপাত করেছে। তাঁর এই সফরের সম্ভাব্য ফলাফল মূল্যায়ন করার সময় অবশ্যই বর্তমান পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখতে হবে।

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের অস্থিরতার মধ্যে সি চিন পিংয়ের এই সফর বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল রপ্তানিকারক (সৌদি আরব) ও সবচেয়ে বড় তেল আমদানিকারক (চীন) দেশের মধ্যে ২৯ হাজার ৬ শ কোটি ডলারের ৩৪টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এসব চুক্তির আওতায় চীন সৌদি আরবকে তথ্য প্রযুক্তি, ক্লাউড সার্ভিস (বিপুল পরিসরের অনলাইনভিত্তিক কেনা বেচার ব্যবস্থা), পরিবহন, অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদি খাতে সহায়তা দেবে; তার বদলে সৌদি আরব চীনের নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করবে।

এই চুক্তির অধীনে সৌদি আরবে চীন হুয়াওয়ের একটি ক্লাউড-কম্পিউটিং অঞ্চল ও একটি বিদ্যুৎচালিত যান কারখানা তৈরি করবে এবং সৌদি আরবের ‘ভবিষ্যতের শহর’খ্যাত তথ্য-প্রযুক্তিবহুল নিওম শহরে হাইড্রোজেন ব্যাটারি সরবরাহ করবে। এ সময় বাদশাহ সালমান এবং প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং একটি বিশদ কৌশলগত অংশীদারি চুক্তিতে সই করেন। ওই চুক্তিতে বলা হয়েছে, দুই দেশের সম্পর্কের কৌশলগত দিকনির্দেশনা ঠিক করতে দুই বছর পর পর দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বৈঠক হবে। সৌদি-আমেরিকান সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে সি চিন পিংয়ের এই সফরকে একটি পরিস্থিতি পাল্টে দেওয়া ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

সি চিন পিংকে এই নজিরবিহীন রাজকীয় সম্মান দেওয়া ও উপসাগরীয় নেতাদের সঙ্গে আগের চেয়ে বেশি সদ্ভাব গড়ে তোলার পেছনে মোহাম্মাদ বিন সালমানের অর্থনৈতিক উদ্দেশের পাশাপাশি রাজনৈতিক উদ্দশ্যও আছে বলে মনে হয়। সম্ভবত মোহাম্মাদ বিন সালমান আঞ্চলিক নেতা হিসাবে চীনের স্বীকৃতি চান। চিন পিংকে এত জমকালো সংবর্ধনা দেওয়ার পেছনে এটি কাজ করেছে বলে ধারণা করাই যায়।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত জুলাই মাসে সৌদি আরব সফর করার সময় ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমানের সঙ্গে যখন সাক্ষাৎ করেন, তখন বাইডেনকে উষ্ণ মেজাজে দেখা যায়নি। সে সময় তাঁর মুখে হাসি ছিল না। তিনি নিরুত্তাপ অভিব্যক্তিতে মোহাম্মাদ বিন সালমানের সঙ্গে করোনাকালীন ফিস্ট বাম্পিং (করমর্দনের বদলে পরস্পরের মুষ্টিবদ্ধ হাতে হাতে ছোঁয়ানো) করেছিলেন। টেলিভিশনে প্রচারিত সেই দৃশ্যের সঙ্গে সি চিন পিংয়ের সফরের তুলনা করা হচ্ছে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০১৭ সালের সফরের সঙ্গেও সির সফরের তুলনা করা হচ্ছে। বাইডেন ও ট্রাম্পকে যেভাবে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল, সে তুলনায় সি চিন পিংকে অনেক বেশি জাঁকজমকপূর্ণভাবে স্বাগত জানানো হয়েছে। এটিকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

অথচ দুই দশক আগে পর্যন্ত চীনা নেতারা রিয়াদে অবাঞ্ছিত ছিলেন। তবে দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের রূপান্তর ঘটায় সে অবস্থা বদলে গেছে। গত বছর সৌদি আরবের এক হাজার ৮০০ কোটি ডলার মূল্যের তেল, অর্থাৎ সৌদির ওই বছরের মোট রপ্তানি করা তেলের ১৮ শতাংশ তেল চীনে রপ্তানি করা হয়েছিল। মহামারিজনিত অর্থনৈতিক মন্দার মুখেও ২০২১ সালে চীনের কাছে সৌদি আরব ৮ হাজার ৭৩০ কোটি ডলারের তেল রপ্তানি করেছে যা তার আগের বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি।

প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বিমানটি সৌদি আকাশসীমায় প্রবেশ করার পর সেটিকে চারটি রয়্যাল সৌদি এয়ার ফোর্স ফাইটার জেট প্রহরার ঢংয়ে বরণ করে এবং সির বিমানটি কিং খালিদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করার সময় ছয়টি অ্যারোবেটিক জেট বিমান থেকে বাতাসে সবুজ ধোঁয়ার বর্ণাঢ্য দাগ টেনে তাকে স্বাগত জানায়।

বিমানবন্দরের টারমাকে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং রিয়াদের গভর্নরের নেতৃত্বে সিকে লাল গালিচা সংবর্ধনা জানানো হয়। এরপর তোপধ্বনি দিয়ে স্বাগত জানানোর পর সির গাড়িকে আরবিয় ঘোড়ায় চড়ে থাকা সৌদি রয়্যাল গার্ডরা চীনা ও সৌদি পতাকা উঁচিয়ে আল ইয়ামামাহ প্রাসাদে নিয়ে যান। সেখানে মোহাম্মাদ বিন সালমান তাঁকে স্বাগত জানান। এরপর ঐতিহ্যবাহী তরবারি নাচ এবং জমকালো অভ্যর্থনাসহ নজিরবিহীন আড়ম্বরপূর্ণ নানা আয়োজনে প্রেসিডেন্ট সিকে সম্মান দেখানো হয়।

এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, আরব দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র সৌদি আরবই জি-২০ ভুক্ত দেশ। সৌদি আরব এই অঞ্চলের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। আরব লীগভুক্ত দেশগুলোর মোট জিডিপির ২৭ শতাংশই সৌদির।

একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, প্রতিরক্ষা ব্যয়ের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চীন এবং তৃতীয় অবস্থানে থাকা সৌদি আরব তাদের সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা সহযোগিতার দিকেও দৃষ্টি দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবের প্রধান ‘নিরাপত্তা জামিনদার’ ও অস্ত্র সরবরাহকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি রাজপরিবারের সম্পর্কে অবনতি হয়েছে এবং সেটি চীন-সৌদির প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সম্ভাবনাকে শক্তিশালী করেছে।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সৌদি আরবকে পাশ কাটিয়ে ইরানের সঙ্গে চুক্তি করার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের অস্বস্তিকর সম্পর্ক ঘনীভূত হয়েছিল। ২০১৫ সালের ওই চুক্তিতে ওয়াশিংটন তার ইউরোপিয়ান মিত্রদের নিয়ে চুক্তিটি করলেও সৌদিসহ আরব দেশগুলোকে তাতে রাখেনি। ওই চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে আরব দেশগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এর আগে ২০০৮ সালের শেল-গ্যাস বিপ্লব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে উপসাগরীয় তেলের ওপর কম নির্ভরশীল করে তোলে। এতে রিয়াদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের টানাপোড়েন শুরু হয়। অতি সম্প্রতি আফগানিস্তান থেকে মার্কিন উপস্থিতি প্রত্যাহার এবং ইউক্রেনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ তাদের সম্পর্ককে আরও তিক্ত করেছে। ইদীনিং মার্কিন নেতাদের আরব নেতাদের মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে সোচ্চার হতে দেখা যাচ্ছে যা আরব নেতাদের রাশিয়া ও চীনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

আরও পড়ুন

চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রাখার কারণে ক্ষমতাসীন বাইডেন প্রশাসন বিভিন্ন আরব দেশকে হুমকি দিয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। কিন্তু কার সঙ্গে কার অংশীদারি কতটুকু থাকবে তা পারস্পরিক স্বার্থরক্ষার বিষয়ই বাতলে দেয়। চীন যত তেল আমদানি করে তার এক-চতুর্থাংশেরও বেশি আসে সৌদি আরব থেকে। সে দিক থেকে সৌদির সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা চীনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তবে সি চিন পিংকে এই নজিরবিহীন রাজকীয় সম্মান দেওয়া ও উপসাগরীয় নেতাদের সঙ্গে আগের চেয়ে বেশি সদ্ভাব গড়ে তোলার পেছনে মোহাম্মাদ বিন সালমানের অর্থনৈতিক উদ্দেশের পাশাপাশি রাজনৈতিক উদ্দশ্যও আছে বলে মনে হয়। সম্ভবত মোহাম্মাদ বিন সালমান আঞ্চলিক নেতা হিসাবে চীনের স্বীকৃতি চান। চিন পিংকে এত জমকালো সংবর্ধনা দেওয়ার পেছনে এটি কাজ করেছে বলে ধারণা করাই যায়।

  • এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
    শরণ সিং ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং প্রফেসর এবং জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি, নিউ দিল্লির স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ, কূটনীতি এবং নিরস্ত্রীকরণের অধ্যাপক।