কালো বিড়াল দুনিয়ার খুব কম সংস্কৃতিতেই আদরণীয়। আমাদের সমাজে তো কালো বিড়াল দেখা মানেই যাত্রাভঙ্গ। বাংলাদেশ রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে কালো বিড়াল অশুভর প্রতীক হিসেবে রীতিমতো কুখ্যাতিই পেয়েছে। দায়িত্ব নিয়ে সাবেক একজন রেলমন্ত্রী এ মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা দূর করতে চেয়ে রেলের কালো বিড়াল খুঁজে বের করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই কালো বিড়ালের খপ্পরে পড়েছিলেন। আশা দেওয়ার, ভরসা দেওয়ার কেউ নেই বলেই হয়তো কেউ আর রেলের কালো বিড়াল খোঁজার চেষ্টা করেননি।
সম্প্রতি রেলের অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে একাই প্রতিবাদে নেমেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনি। থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী তাই কিনা তাঁর প্রতিবাদ কর্মসূচিও কিছুটা নাটুকে। এক হাতে প্ল্যাকার্ড, অন্য হাতে একটি শিকলের এক প্রান্ত ধরা। শিকলের অন্য প্রান্ত আরেকজনের গলায় জড়ানো।
মাটিতে লুটিয়ে পড়া ব্যক্তিটি দুর্নীতিগ্রস্ত রেলওয়ের প্রতীক। রেলওয়েকে শিকলমুক্ত, মানে দুর্নীতিমুক্ত করার পণ নিয়ে প্রতিদিন কমলাপুর রেলস্টেশনে অহিংস অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন রনি। রেলের কর্মী ও পুলিশের হাতে হেনস্তারও শিকার হয়েছেন তিনি। কিন্তু তাতে দমে যাননি। তাঁর এ কর্মসূচি ১২ দিন পেরিয়েছে, অনেকেই এসে জানিয়েছেন সংহতি।
রেলওয়ে কি ঔপনিবেশিক সেই ‘সম্পদ সৃষ্টি ও পাচারের বৃত্ত’ থেকে বের হতে পারবে না? রনির একার আন্দোলন রেলের কালো বিড়ালদের জেঁকে বসা আদুরে ঘুমে কি কোনো আঁচড় কাটতে পারবে? রনিকে অভিনন্দন। কেননা, আমাদের সব মেনে নেওয়ার আর সবকিছুকেই স্বাভাবিক ভেবে নেওয়ার বৃত্তের বাইরে বিকল্প যে আছে, সে বিষয়ই মনে করিয়ে দিলেন তিনি।
রনির ভাষ্য, গত ১৩ জুন রেলওয়ের ওয়েবসাইট থেকে ঢাকা-রাজশাহী রুটের ট্রেনের টিকিট কাটতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন তিনি। তাঁর মোবাইল অ্যাপ থেকে টাকা কেটে নেওয়া হয় ঠিকই, কিন্তু তিনি টিকিট পাননি। এর প্রতিকার চেয়ে রেল কর্তৃপক্ষ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করেও সুরাহা পাননি।
পদে পদে হয়রানির শিকার হয়েই তিনি ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’ নীতিতে ঈদের আগে ৭ জুলাই আন্দোলন শুরু করেন। ট্রেনের যাত্রীদের অধিকার রক্ষার জন্য বেশ কয়েকটি দাবি তিনি জানিয়েছেন। এগুলো হলো অনলাইনে টিকিট কেনায় হয়রানি বন্ধ করে তদন্ত করতে হবে, হয়রানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, টিকিট কালোবাজারি বন্ধ করতে হবে, অনলাইন-অফলাইনে টিকিট কেনার ক্ষেত্রে সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে, ট্রেনের সংখ্যা বাড়িয়ে রেলের অবকাঠামো উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে, ট্রেনের টিকিট পরীক্ষক, তত্ত্বাবধায়কসহ অন্য দায়িত্বশীলদের কর্মকাণ্ড সার্বক্ষণিক মনিটর করতে হবে, শক্তিশালী তথ্য সরবরাহব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে রেলসেবার মান বাড়াতে হবে এবং ট্রেনে ন্যায্য দামে খাবার, বিনা মূল্যে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন-ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশে রেলওয়ে যেন অদ্ভুতুড়ে সব কালো বিড়ালের ঘরবসতি। অধিকাংশ ট্রেনেই উপচে পড়া ভিড়। টিকিটের জন্য নিত্য হাহাকার। অথচ রেল বছরের পর বছর বড়সড় লোকসানের বৃত্ত থেকে বের হয় না। রেলপথ মন্ত্রণালয় বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেনগুলো পরিচালনা করতে লোকসান গুনেছে ১ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। আগের বছরগুলোর চিত্রও কমবেশি একই।
ট্রেনের টিকিট নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই; বিশেষ করে ঈদের টিকিটের। চাহিদা বিপুল। কিন্তু টিকিট পাওয়া যায় না। রেলের ডিজিটাল রূপান্তরের অংশ হিসেবে ৫০ শতাংশ টিকিট বিক্রি হয় অনলাইনে। কিন্তু অনলাইনে টিকিট পেয়েছে—এ রকম ব্যক্তির সন্ধান মেলা ভার।
গত এপ্রিল মাসে র্যাব অভিযান চালিয়ে ট্রেনের টিকিটের জন্য অ্যাপ নির্মাণ ও পরিচালনা প্রতিষ্ঠানের এক সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারকে গ্রেপ্তার করে। তিনি সিস্টেম মানে কারসাজি করে ট্রেনের টিকিট কেটে নিতেন।
পরে বেশি দামে দালালদের দিয়ে কালোবাজারে টিকিট বিক্রি করতেন। অনলাইনে ‘টিকিট ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর এ রকম সুযোগ যেখানে, সেখানে কালোবাজারিদের হাতে টিকিট যাওয়ার সুযোগ তো থাকবেই।
বাংলাদেশের ট্রেনে নাকি ভ্রমণ করে গেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং–উন! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ রকম টিকিটের ছবি দিয়ে অনেকে প্রতিবাদ করেছেন, অনেকে ট্রল করেছেন। অভিযোগ আছে, যে কারও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ব্যবহার করে অন্য যে কেউ যেকোনো নামে টিকিট কেটে ফেলতে পারেন।
কার্ল মার্ক্স ভারতীয় উপমহাদেশে রেলের যাত্রাকে দেখেছিলেন গ্রামভিত্তিক সমাজ ভেঙে পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থা বিকাশের সুযোগ হিসেবে। উনিশ শতকের রেল যোগাযোগব্যবস্থা উপমহাদেশে এককথায় বিপ্লব এনেছিল। ব্রিটিশ ভারতে রেল যোগাযোগ শুরুর আট বছরের মধ্যে পূর্ববঙ্গে রেললাইন চলে এসেছিল কলকাতা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত।
কয়েক বছরের মধ্যে সেটা পদ্মার পাড় গোয়ালন্দ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছিল। এটাও সত্য, রেললাইন স্থাপনের পেছনে বড় একটা উদ্দেশ্য ছিল পূর্ববঙ্গে উৎপাদিত কৃষিপণ্য, পাট, মাছ যাতে সহজে ও দ্রুত রাজধানী কলকাতায় পৌঁছে দেওয়া যায় এবং সেখান থেকে উদ্বৃত্ত সম্পদ যাতে ব্রিটেনে পাচার করা যায়।
রেলওয়ে কি ঔপনিবেশিক সেই ‘সম্পদ সৃষ্টি ও পাচারের বৃত্ত’ থেকে বের হতে পারবে না? রনির একার আন্দোলন রেলের কালো বিড়ালদের জেঁকে বসা আদুরে ঘুমে কি কোনো আঁচড় কাটতে পারবে? রনিকে অভিনন্দন। কেননা, আমাদের সব মেনে নেওয়ার আর সবকিছুকেই স্বাভাবিক ভেবে নেওয়ার বৃত্তের বাইরে বিকল্প যে আছে, সে বিষয়ই মনে করিয়ে দিলেন তিনি।
একা শুরু করেছিলেন রনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম ও জামালপুর রেলস্টেশনে রেলের অনিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেছেন। ভুক্তভোগী যখন অসংখ্য, তখন কে জানে কখন জমে থাকা বরফ গলতে শুরু করে।
মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক