আমাদের দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় প্রতিটি নির্বাচনের জন্য একজন রিটার্নিং কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। দীর্ঘকালের ধারাবাহিকতায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক (ডিসি) তাঁর জেলার সব নির্বাচনী এলাকার জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তা হয়ে থাকেন।
আবার ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বড় বড় বিভাগীয় শহরে নির্বাচনী এলাকাগুলোয় রিটার্নিং কর্মকর্তা থাকেন বিভাগীয় কমিশনাররা। জাতীয় সংসদের শূন্য আসনে উপনির্বাচনসহ সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের করা হয় রিটার্নিং কর্মকর্তা।
ইদানীং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শুধু কমিশনের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করার জন্য একটি প্রস্তাব এসেছে। এর সমর্থনে বলা হয়, ডিসিরা সরকারের ঘনিষ্ঠ বলয় থেকে কাজ করেন বিধায় তাঁদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করা নিরপেক্ষ নির্বাচনের অন্তরায়।
অন্যদিকে, কমিশনের কর্মকর্তারা স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের আওতায় থেকে সে দায়িত্ব অধিকতর নিরপেক্ষতার সঙ্গে পালন করতে পারবেন। বক্তব্যের ভাষ্যে জোর আছে। আমরা চাই নিরপেক্ষ নির্বাচন। সুতরাং, সেখানে কাউকে রিটার্নিং কর্মকর্তা করে সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় সৃষ্টি হোক—এমনটা চাই না।
আর নির্বাচনসংক্রান্ত আইনেও এ বিষয়ে কমিশনের হাত খোলা রাখা আছে। তবে তাদের দেখতে হয় নির্বাচন নামক একটি বহুপ্রাতিষ্ঠানিক মেলযজ্ঞে কোন কর্মকর্তা সফলভাবে নেতৃত্ব দিতে সফল হবেন, সে বিষয়। এখানে পুলিশ, সামরিক বাহিনী ছাড়াও সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, এমনকি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা ও শিক্ষকেরা প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পোলিং কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন।
রিটার্নিং কর্মকর্তার ক্ষমতার উৎস সংশ্লিষ্ট নির্বাচনসংক্রান্ত আইন, পরিচালনা বিধিমালা ও আচরণ বিধিমালা। তবে এগুলো সুষ্ঠু প্রয়োগের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও স্বীয় পর্যাপ্ত জনবল অবকাঠামোর প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করা যায় না। এসব বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘকাল বর্তমান ব্যবস্থা চলমান।
সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাধীন সত্তা দিয়েছে। এ অবস্থায় এ ধরনের তদন্ত কমিশন তার কর্মকর্তা–কর্মচারীদের ওপর কেন চাপাল বা চলতে দিল, এটা আমাদের বোধগম্য নয়
এমনটা স্থায়ী রূপ নিয়েছে ভারতে। উল্লেখ্য, সে দেশে শ তিনেক জনবলের একটি কমিশনকেই তারা যথেষ্ট মনে করছে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কর্মকর্তাদের দিয়ে কমিশন কাজ করিয়ে নেয়। আর আমরা এর মধ্যেই নির্বাচন কমিশনের জনবলকাঠামো সাত হাজারের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছি। আরও সম্প্রসারণের প্রস্তাব আছে।
এটা সত্যি, ডিসিরা সরকারের খুব কাছের লোক বলে পরিচিতি রয়েছে। এটা এক বিচারে তার দুর্বলতা মনে হলেও নির্বাচনবান্ধব সরকারের ক্ষেত্রে শক্তির উৎসও বটে। গত বেশ কয়েক বছরে আমাদের সরকারি কাঠামোয় সীমাহীন দলীয়করণ এর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আবার ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এ দেশে অনুষ্ঠিত চারটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাঠপর্যায়ের নেতৃত্বে ছিলেন ডিসিরাই। তেমনি ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে একতরফা একটি নির্বাচনেও তাঁরাই ছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। সে নির্বাচনের পর জনপ্রতিরোধে সংবিধানে সংশোধন এনে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়।
গঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। মাত্র ১৯ জন ডিসিকে মাঠ থেকে প্রত্যাহার করে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁরা সবাই মিলে ১৯৯৬ সালের জুনের সফল নির্বাচনটির ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্ব দেন। সমস্যাটা ছিল, ক্ষমতায় থাকা দলীয় সরকার যেকোনো মূল্যে টিকে থাকতে চেয়েছিল। তাই নির্বাচনটি একতরফা হয়ে যায়।
আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে অংশগ্রহণমূলক নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার ব্যবস্থাও করে মূলত ডিসিদের মাধ্যমেই। সুতরাং ডিসিরা দলের লোক হয়ে গেছেন—এ যুক্তিতে তাঁদের রিটার্নিং কর্মকর্তা না রাখার প্রস্তাবটি ধোপে টেকে না। নির্বাচন পরিচালনায় প্রশাসনের পাশাপাশি পুলিশের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। তাদের মধ্যে দলীয়করণের হার আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার আবশ্যকতা নেই। ২০১৮ সালের নির্বাচনকে ব্যাপকভাবে মধ্যরাতের নির্বাচন বলা হয়।
সেই মধ্যরাতে ভোটের বাক্স ভর্তি করার দায়িত্বে কারা ছিল, এটাও অনেকের জানা। তাই বলে তো এ ধরনের সংস্থাকে নির্বাচনের দায়িত্ব থেকে বাদ দেওয়া যাবে না। অন্যদিকে, মাত্র কদিন আগে হালের নির্বাচন কমিশনের সব কর্মকর্তাসহ তাঁদের পরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা একটি গোয়েন্দা সংস্থা যাচাই করেছে বলে গণমাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি। এর কোনো ব্যাখ্যা বা প্রতিবাদ কমিশনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি।
সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাধীন সত্তা দিয়েছে। এ অবস্থায় এ ধরনের তদন্ত কমিশন তার কর্মকর্তা–কর্মচারীদের ওপর কেন চাপাল বা চলতে দিল, এটা আমাদের বোধগম্য নয়। শুধু এবার নয়; ২০১২ থেকে এ পর্যন্ত যেসব কমিশন গঠিত হয়েছে, সেগুলো মোটাদাগে জনগণের আস্থা অর্জনে সফল হয়নি। অবশ্য বলতে হবে, ২০১২ সালের গঠিত কমিশন এক দফায় বেশ কিছু সিটি করপোরেশন নির্বাচন সফলভাবে করেছিল।
রিটার্নিং কর্মকর্তারাও ছিলেন তাদের কর্মকর্তা। অবশ্য সে ক্ষেত্রে তখনকার সরকারব্যবস্থা অনুকূলে ছিল, এটা নিশ্চিত। কেননা, এরপরই সবকিছু পাল্টে যায়। সেসব নির্বাচনে ডিসিদের মতো একই ভূমিকায় ছিলেন কমিশনের কর্মকর্তারা।
তাহলে কমিশন যখন প্রশ্নবিদ্ধ, তখন এর কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করবেন—এ প্রত্যাশা আমরা কীভাবে করব? উল্লেখ্য, রাজনৈতিক দলগুলোর বিবাদ মিটিয়ে দেওয়া কমিশনের সরাসরি কাজ না হলেও এর গতিপ্রকৃতি প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা থাকা দরকার। তা না হলে নির্বাচনব্যবস্থাই নিষ্ফল হয়ে যাবে।
রাজনৈতিক সমঝোতা প্রসঙ্গেও আলোচনা প্রয়োজন। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার একটি পরীক্ষিত ব্যবস্থা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ বাতিল করে দেয়। অবশ্য আদালতের একটি বিভক্ত আদেশ সংবিধান সংশোধন করতে তাদের সহায়ক হয়েছে। তবে সে আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য কোনো আবেদন করা হয়নি। ফলে ক্ষমতায় থেকেই দলটি এখন নির্বাচন করে চলেছে।
তারপরও যদি এসব নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেত, তাহলে এমন কথা আসত না। ২০১৪ সালের নির্বাচনে মূলধারার বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। অর্ধেকের বেশি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। বলা হয়, বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে এমনটা হতো না। সে পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের সঙ্গে ব্যাপক আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে ২০১৮ সালের নির্বাচনে সবাই এসেছিল। এর ফলাফলকে যদি জনগণের রায় বলা হয়, তাহলে বলার কিছু থাকে না।
প্রকৃতপক্ষে বৃহত্তর জনগণের উপরিউক্ত দুটি নির্বাচনের সঙ্গে তেমন কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। শেষোক্তটিতে বিরোধী দলের যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন, তাঁদের নির্বাচনী প্রচারও চালাতে দেয়নি সরকারি দল ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। অজ্ঞাত মামলায় গ্রেপ্তার হন বিরোধী দলের কয়েক হাজার কর্মী–সমর্থক অথবা পালিয়ে যান এলাকা থেকে। তাই এসব প্রার্থী এজেন্ট দেওয়ার মতো কর্মীও খুঁজে পাননি। অনেক ক্ষেত্রে নিজেরাও ছিলেন এলাকাছাড়া।
প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাসীন দলটি তাদের সময়ে চোখধাঁধানো উন্নয়নমূলক কাজ করে চলছে। এর প্রশংসা করতে হয়। বিপরীতে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটতে দিচ্ছে না তারা। যেটুকু ছিল, তা–ও তলানিমুখী। প্রায় সব প্রতিষ্ঠানকে করে ফেলা হয়েছে অনেকটা সরকারের আজ্ঞাবহ। সংবিধান বা আইনে অনেকের স্বাধীন সত্তা থাকলেও বাস্তবে তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই দেশ পরিচালনার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাঁরা সংশ্লিষ্ট, তাঁরা তাঁদের অবস্থানকে দীর্ঘতর করার জন্য ক্ষমতাসীন দলকে লাগামহীন সমর্থন দিচ্ছেন।
এ অবস্থা চলতে থাকুক—এমনটা কাম্য হতে পারে না। প্রশাসনযন্ত্র ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় যে দলীয়করণ, তা ভাঙতে হলে নির্বাচনকালীন সরকারের বিকল্প নেই। এর রূপরেখা তৈরি করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকেই। কথায় কথায় সংবিধান দেখিয়ে দিলে হবে না।
জনগণের অভিপ্রায়ে অতীতেও সংবিধান থমকে গিয়ে নতুন ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। আমাদের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে অকার্যকর বলা যাবে না। জাতীয় নির্বাচনের সময় সহায়তার জন্য সামরিক বাহিনীও মোতায়েন থাকে। অতীতে তারা অনুকূল পরিবেশে ব্যাপক সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। সে পরিবেশ আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। উপযুক্ত পরিবেশ না ফিরলে শুধু রিটার্নিং কর্মকর্তা পরিবর্তনের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়।
আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব