খবরে প্রকাশ যে রাশিয়ার ভেতরে বেলগ্রদ অঞ্চলে ইউক্রেনপন্থী অথবা পুতিনবিরোধী সেনাদের সঙ্গে রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর লড়াই হয়েছে। বেলগ্রদ অঞ্চলটি ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী, সেখানে রাশিয়ান ও ইউক্রেনীয় দুই জনগোষ্ঠীই বসবাস করে। একটা খবর ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে বেলগ্রদে পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারের যে মজুত রাশিয়া গড়ে তুলেছিল, সেটা জরুরি ভিত্তিতে সরিয়ে নিয়েছে।
এখন পর্যন্ত এ ঘটনার পূর্ণাঙ্গ কোনো চিত্র পাওয়া যায়নি। কিন্তু এই লড়াইয়ে ফ্রিডম অব রাশিয়া লিজিয়ন (এলএসআর) এবং অন্যান্য গোষ্ঠী যেমন রাশিয়ান ভলেন্টিয়ার কমান্ড (আরডিকে) জড়িত থাকার খবর পাওয়া গেছে। গত ২২ মে রাশিয়ার সীমান্তে অবস্থিত কোজিনকা গ্রামে হামলার মধ্য দিয়ে লড়াই শুরু হয়। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর ওই অঞ্চলে ইউক্রেন পক্ষের ও ইউক্রেনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বিচ্ছিন্নভাবে লড়াই চালিয়ে আসছে।
এই হামলা ঘিরে নানা ধরনের জল্পনা শুরু হয়েছে। দুই পক্ষ থেকেই অনেক বেশি অপতথ্য আসছে। এর অর্থ হচ্ছে, এখন এই ঘটনার পুরোপুরি সত্যতা যাচাই অসম্ভব একটি ব্যাপার।
এখন পর্যন্ত হামলার যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে বলা চলে এটি খুব ছোটখাটো হামলা। ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ারের (আইএসডব্লিউ) তথ্যমতে, ‘দুটি ট্যাংক, এক গাড়ি সশস্ত্র যোদ্ধা এবং নয়টি সাঁজোয়া যান’ এই হামলায় অংশ নেয়। কিন্তু এই হামলার তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো এটি রাশিয়ার মাটিতে ঘটেছে। সশস্ত্র হামলাকারীদের পরিচয় কী, সে বিষয়টি সরিয়ে রাখলেও এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে শুধু ভৌগোলিক কারণেও এই হামলা যুদ্ধের উত্তেজনা বাড়াবে।
কারা এই হামলায় জড়িত
ফ্রিডম অব রাশিয়া লিজিয়ন (এলএসআর) রাশিয়ান নাগরিকদের নিয়ে প্রতিষ্ঠিত। এ সংগঠনে যেমন নির্বাসিত ভিন্নমতাবলম্বীরা রয়েছেন, একইভাবে স্বেচ্ছাসেবকেরাও রয়েছেন। এই হামলার সঙ্গে ইউক্রেন’স ইন্টারন্যাশনাল লিজিয়নের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী জড়িত বলেও মনে করা হচ্ছে। স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় যেমন আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে আলাদা ব্রিগেড গঠন করা হয়েছিল, ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও তাদের প্রতিরোধযুদ্ধের সমর্থনে নানা দেশ থেকে স্বেচ্ছাসেবকেরা এসেছেন। তাদেরকে নিয়েই ইউক্রেন’স ইন্টারন্যাশনাল লিজিয়ন বা আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গঠন করা হয়েছে।
একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ইন্টারন্যাশনাল লিজিয়ন বা আন্তর্জাতিক ব্রিগেড ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর আনুষ্ঠানিক কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত। যদি এই হামলায় এলএসআর জড়িত থাকে, তাহলে এটি দলছুটদের অভিযান নয়, বরং রাশিয়ার মাটিতে ঢুকে ইউক্রেনের হামলা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
আইএসডব্লিউ প্রতিদিনের ভিত্তিতে যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আসছে। সংস্থাটি কোজিনকা গ্রামে হামলার খবরটি নিশ্চিত করলেও বেলগ্রদের গ্রেভরন অঞ্চলে পরের হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেনি।
এদিকে এলএসআর টেলিগ্রাম চ্যানেল একটি পোস্ট দিয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের অনুবাদ থেকে জানা যায়, পোস্টে বলা হয়েছে, ‘রাশিয়া ফেডারেশনের নাগরিকেরা নিরাপদ এবং রাশিয়ান ফেডারেশন শক্তিশালী এ ধরনের যে মিথ চালু আছে, সেটি আবারও ভেঙে পড়ল।’
এলএসআর টেলিগ্রামে যে বার্তা দিয়েছে, সেখানে তারা স্বীকার করেছে, রাশিয়ান ভলেন্টিয়ার কমান্ড (আরডিকে) এই হামলার সঙ্গে জড়িত। আরডিকে রাশিয়ান জাতিয়তাবাদীদের আধা সামরিক বাহিনী বলা যায়। এই দলটির নেতা ডেনিশ কাচুস্তিনের যুক্তি হলো, রাশিয়া পুরোপুরি ভুল পথে চলছে।
অনুসন্ধানী সাংবাদিক মাইকেল কলবোর্নের অনুন্ধানে বেরিয়ে এসেছিল, আরডিকে গ্রপটি ইউক্রেনের মাটিতে জন্ম। এর বেশির ভাগ সদস্য পুতিনবিরোধী অতি ডান উগ্রপন্থী রাশিয়ান। যদিও এই দলটির সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি না, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই।
এর আগে ৩ মার্চ ব্রায়াস্ক অঞ্চলে অনুপ্রবেশের যে ঘটনাটি ঘটেছিল, তার তুলনায় ২২ মের হামলাটি অনেক বড় ও সুসংগঠিত। এই হামলাটি রাশিয়ান ভূখণ্ডের বেশ ভেতরে এবং বেশিসংখ্যক সেনা ও সামরিক রসদ নিয়ে সংঘটিত হয়েছে।
মানে কী দাঁড়াল
রাশিয়া, ইউক্রেন এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলো এই হামলাকে কীভাবে দেখছে, সেটাই এ ঘটনা বিশ্লেষণের মূল বিষয়। মস্কো এই হামলাকে ইউক্রেনীয় সন্ত্রাসীদের হামলা বলে চালিয়ে দিতে প্রবলভাবে উৎসাহী।
ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা সংস্থা গারের মুখপত্র আনড্রিল ইউসোভ গোঁয়ার গোবিন্দের মতো বলেছেন, বেলগ্রদে হামলার সঙ্গে ইউক্রেনের বিন্দুবিসর্গ পরিমাণও সংশ্লিষ্টতা নেই। ইউক্রেনের গণমাধ্যম প্রাভদাকে তিনি বলছেন, এই হামলায় স্থানীয় পুতিনবিরোধীরা যুক্ত ছিল।
কিন্তু এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি যেটুকু জানা যাচ্ছে, তাতে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে আনাষ্ঠুনিকভাবে সংশ্লিষ্ট পুতিনবিরোধী রাশিয়ান যোদ্ধারা রাশিয়ার মাটিতে সংঘটিত হামলায় অংশ নিয়েছে। যদি এটা সত্যি হয়, তাহলে এ ঘটনাটি নিশ্চিতভাবেই যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ার একটি মোড় হিসাবে বিবেচিত হবে।
যদিও এই হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে ইউক্রেন, কিন্তু ট্যাংক, সাঁজোয়া যান এবং অন্যান্য যেসব অস্ত্র নিয়ে হামলা চালানো হয়েছে, তাতে এটা প্রমাণ করা কঠিন যে ইউক্রেন কিংবা ইউক্রেনের প্রতি সমব্যথী কোনো দেশ এ হামলার জন্য সামরিক রসদ জোগায়নি।
যাহোক, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা টুইট করেছেন, ‘আপনারা জানেন যে রাশিয়ার যেকোনো সামরিক দোকানে ট্যাংক কিনতে পাওয়া যায়, আর আন্ডারগ্রাউন্ড গেরিলা দলটি রাশিয়ান নাগরিকেরাই গড়ে তুলেছে।’
এখন প্রশ্ন হলো, কিয়েভ কি রাশিয়ার মাটিতে গিয়ে হামলা চালাল? সেটা যদি সত্য হয়, তাহলে এই হামলার পরিণতি কী? আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, যে হামলায় তাৎপর্যপূর্ণ কোনো অর্জন নেই, বরং ভ্লাদিমির পুতিনের ক্ষমতাকে সুসংহত করবে, সেই হামলার কী অর্থ?
গাভিন ই এল হল স্কটল্যান্ডের স্টার্থক্লাইড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার টিচিং ফেলো
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত