ন্যাটোকে ধাপ্পা দেওয়ার এরদোয়ানের কৌশল

রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান
ছবি : এএফপি

লিথুনিয়ার ভিলনিয়াসে এবারে ন্যাটো সম্মেলনের প্রাক্কালে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান পশ্চিমা সামরিক জোটে সুইডেনের সদস্যপদ দেওয়ার বিরোধিতা থেকে সরে আসেন। কয়েক মাসের রাজনৈতিক কূটকৌশল ও হুমকির পর তিনি বুঝতে পেরেছেন তাঁর হাতে যে ‘অস্ত্র’ রয়েছে, সেটা তুলনামূলকভাবে দুর্বল। একমাত্র হাঙ্গেরি ছাড়া, ন্যাটোর বাকি সদস্যরা এরদোয়ানের এই নাটকে বিরক্ত।

নির্বাচন সামনে রেখে এরদোয়ান ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের সদস্যপদ নিয়ে আপত্তি জানান। পরে সুইডেনের ক্ষেত্রে আপত্তিটা ধরে রাখেন। তুরস্কে তথ্যপ্রবাহের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন এরদোয়ান এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে পশ্চিমের বিরুদ্ধে আগ্রাসী মনোভাব প্রদর্শন করেন।

কিন্তু এরদোয়ান চান বিশ্বরাজনীতিতে আরও বড় ভূমিকা পালন করতে। এরদোয়ান ভাবেন, তিনি নিজ হাতে বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। তিনি বিশ্বাস করেন, অন্যরা তাঁর সঙ্গে আলোচনার জন্য বসলে তাতে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে।

এরদোয়ানের কর্তৃত্ববাদী শাসনের হাত থেকে রক্ষা পেতে বিরোধী মতের অনেকে তুরস্ক থেকে সুইডেনে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন। এরদোয়ানের অভিযোগ হলো, সুইডেন ‘সন্ত্রাসীদের’ আশ্রয় দিচ্ছে। সমস্যা হলো এরদোয়ানের শাসনের বিরোধিতা যাঁরা করেন, সবাই তাঁর কাছে সন্ত্রাসী। অর্থনীতি থেকে শুরু করে মানবাধিকার, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা—সব ক্ষেত্রেই তিনি তুরস্কে একধরনের দুর্বল ব্যবস্থা চালু করেছেন।

একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ছাড়া বিদেশে আশ্রয় নেওয়া তুরস্কের নাগরিকদের ফেরত পাঠানোর আবেদনের আইনগত ভিত্তি আছে কি না, সেটা নিরূপণ করা অসম্ভব। এমনকি সুইডেনের বর্তমান পার্লামেন্টের একজন আইনপ্রণেতাকে (ইরানি বংশোদ্ভূত কুর্দি) তাদের কাছে সমর্পণের দাবি জানিয়েছে আঙ্কারা। সুইডেন কেন, কোনো গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষেই তুরস্ক যে দাবি জানিয়েছে তার বেশির ভাগটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সুইডেন শুধু একজন মাদক বিক্রেতাকে তুরস্কে ফেরত পাঠাতে সম্মত হয়েছে এবং কুর্দিদের কাছে যাতে অর্থ সহজে না পৌঁছায়, সে জন্য নিয়মবিধি কঠোর করেছে।

কিন্তু এরদোয়ান এটা বুঝতে পারেন না যে অপরাধীদের প্রত্যর্পণে ক্ষেত্রে তুরস্কের পক্ষ থেকে তারা সুইডেনকে যে অনুরোধ করেছে, সেটা একটা প্রতারণাপূর্ণ অবস্থান। কেননা সুইডেনের পক্ষ থেকে আঙ্কারাকে বেশ কয়েকবার অনুরোধ করা হয়েছে, যাতে পলাতক আসামি, মাদক বিক্রেতা, সন্দেহভাজন খুনি যাঁরা তুরস্কে আশ্রয় খুঁজছেন, তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। কিন্তু তুরস্ক সেটা করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে।

এরদোয়ান এর মধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে গ্রীষ্মকালীন অধিবেশন শেষে আগামী অক্টোবর মাসে পার্লামেন্টে সুইডেনের যোগদানের বিষয়টি উত্থাপন করা হবে। এর অর্থ হলো জোটের কাছে আরও দাবি কিংবা অভিযোগ জানানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় পাচ্ছেন তিনি। ন্যাটোতে সুইডেনের যোগদান নিয়ে বিতর্কের অবসান হয়তো হবে, কিন্তু এরদোয়ানের বিপজ্জনক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

তুরস্ক সব সময় ন্যাটোর জন্য সমস্যাজনক ছিল না। ক্ষমতার প্রথম দিকে এরদোয়ান একজন প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। তিনি তাঁর দেশে একটি মধ্যপন্থী ও উদারব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। একই সঙ্গে তিনি জোট ও সমমনা প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মধ্য দিয়ে তিনি একসময় জনতুষ্টিবাদী-কর্তৃত্ববাদী নেতায় পরিণত হন। ভিন্নমতের ওপর খড়্গহস্ত হন। চাটুকার বেষ্টিত এরদোয়ান এখন এই শাসনপদ্ধতিতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।

এরদোয়ানের সামনে মূল সমস্যা হলো তঁাকে বিশাল অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এর বেশির ভাগই তাঁর সৃষ্ট। তিনি এমন সব গোঁড়া নীতি নিয়েছেন, যার ফলে মূল্যস্ফীতি আকাশ ছুঁয়েছে। বিপর্যয় এড়াতে তুরস্কের এখন অর্থনৈতিক সহায়তা প্রয়োজন। সেটা পশ্চিমা দেশগুলোই তাকে দিতে পারে।

ন্যাটোয় সুইডেনের সদস্যপদের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছানোর আগে এরদোয়ান এটাকে তাঁর বাজির চাল হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) তুরস্কের প্রবেশের ব্যাপারে আলোচনা থেমে গেছে, সেটা যেন আবার চালু করা হয়।

আরও পড়ুন

এরদোয়ান ভালো করেই জানেন যে তাঁর এই প্রচেষ্টা সফল হওয়ার নয়। কিন্তু এই প্রশ্ন উত্থাপন করায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন আঙ্কারার সঙ্গে কিছু চুক্তিতে যেতে পারে, যেটা তুরস্কের রপ্তানি বাড়াতে সাহায্য করবে। এরদোয়ানের আরেকটি চাওয়া হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র যেন আঙ্কারার কাছে এফ-১৬ জঙ্গি বিমান বিক্রি করে।

 এরদোয়ান এর মধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে গ্রীষ্মকালীন অধিবেশন শেষে আগামী অক্টোবর মাসে পার্লামেন্টে সুইডেনের যোগদানের বিষয়টি উত্থাপন করা হবে। এর অর্থ হলো জোটের কাছে আরও দাবি কিংবা অভিযোগ জানানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় পাচ্ছেন তিনি। ন্যাটোতে সুইডেনের যোগদান নিয়ে বিতর্কের অবসান হয়তো হবে, কিন্তু এরদোয়ানের বিপজ্জনক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

  • এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত

  • হেনরি জে বারকে কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের মধ্যপ্রাচ্য অধ্যয়ন বিষয়ে জ্যেষ্ঠ ফেলো