অফিস বাসার কাছেই। হেঁটে যেতে লাগে ১২ মিনিট। রিকশায় একটু ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে যেতে হয়, সময় লাগে ২০ থেকে ২৫ মিনিট। আর গাড়িতে গেলে ৩৫ থেকে ৪০ মিনিট। সময়ের হিসাব করলে হেঁটে অফিসে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু রাস্তাঘাট, ফুটপাত, রোদ-বৃষ্টি বা ধুলা-ধোঁয়া—এসব বিবেচনায় গাড়ির ওপরই ভরসা করতে হয়। এরপরও সপ্তাহে দুই-এক দিন হেঁটে বা রিকশায় অফিসে আসা-যাওয়া করতে হয়। তেমনই এক দিন ছিল গত মঙ্গলবার। তবে সেদিন যা ঘটল তেমন অভিজ্ঞতার মুখে ঢাকা শহরে জন্ম নেওয়া নাগরিক হিসেবে আগে কখনো পড়তে হয়নি, তাও একেবারে দিনদুপুরে।
গত মঙ্গলবার গাড়িচালকের ছুটি ছিল। বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা নিই, উদ্দেশ্য কারওয়ান বাজারের প্রথম আলো অফিস। বেলা সোয়া ১১টার দিকে মগবাজারের ইনসাফ বারাকা কিডনি ও জেনারেল হাসপাতাল ও সিএনজি ফিলিং স্টেশনের মাঝের রাস্তাটি দিয়ে মূল সড়কে উঠি। রাস্তাটি সোজা চলে গেছে তেজগাঁওয়ের দিকে। ডানে হাতিরঝিল সড়ক। আর বামে এফডিসি হয়ে কারওয়ান বাজার আমার গন্তব্য।
মঙ্গলবার এই দিকে যানজট কিছুটা কম থাকে। মগবাজার রেলক্রসিং পার হয়ে রিকশা এগিয়ে চলেছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে। পরিচিত এলাকা, সব সময় আসা-যাওয়া করি, তাই নির্ভার থাকি। পাশের রিকশায় ফোনে কথা বলছিলেন একজন। আমাকে দেখে ফোন নামিয়ে বললেন, ‘স্লামালেকুম ভাই, কেমন আছেন?’ বললাম, ভালো।
ভাবলাম হয়তো পুরোনো কোনো বন্ধু বা পরিচিত কেউ। হাত দিয়ে রিকশা থামানোর অনুরোধ করে যাচ্ছেন। আমার রিকশাচালক কিছুটা ইতস্তত করছেন। এরই মধ্যে তাঁর রিকশা আমার রিকশার সামনে চলে এসেছে।
তিনি লাফ দিয়ে নেমে আমার হাত ধরে আবার বললেন, ‘ভালো আছেন ভাই?’ আমি তখন তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।’ কোনো কথা না বলে তিনি প্রায় ১৫ সেকেন্ড আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি বিভ্রান্ত। সম্ভবত তখনই তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বাকি পর্বটি কীভাবে এগিয়ে নেবেন! তার চোখের ভাষা পাল্টে গেল।
সেই লোক বললেন, ‘ভাই, আমাকে দেখলে কী মনে হয়?’ নিজের কোমরের দিকে ইঙ্গিত করলেন। আশপাশ দিয়ে তখন রিকশা, গাড়ি, বাস সবই চলছে। মুহূর্তেই তিনি আপনি থেকে ‘তুই’-তে নেমে গেলেন। ততক্ষণে যা বোঝার বুঝে গেছি। মাথা ঠান্ডা করে বললাম, ভাই মানিব্যাগে কিছু টাকা আছে, দিয়ে দিচ্ছি। মানিব্যাগ বের করতেই তিনি ছোঁ মেরে সব টাকা বের করে নিয়ে গেলেন।
এরই মধ্যে আরেকজন এসে রিকশার সামনে দাঁড়ালেন, বললেন, ‘কোনো কথা না বলে সব দিয়ে দেন।’ বুঝলাম তাঁদের সঙ্গে আশপাশে আরও লোক আছে। কাঁধে ঝোলানো একটি ব্যাগ ছিল, আরও টাকার আশায় সেই ব্যাগও খুলতে বললেন। আমার ব্যাগ তল্লাশি হচ্ছে; আশপাশের অনেক রিকশা থেকে লোকজন মাথা ঘুরিয়ে তা দেখছেন। হয়তো তাঁরা বোঝার চেষ্টা করছেন, কী হচ্ছে! শেষে নজর পড়ল মুঠোফোনটার দিকে। টান দিতেই আমি বললাম, ‘ভাই, ফোনটি নিয়ে আপনার খুব লাভ হবে না, খুলতে পারবেন না, কিন্তু আমার অনেক ঝামেলা হবে।’ ফোনটি ছেড়ে দিয়ে তিনি দ্রুত চলে যেতে বললেন।
দেশে বা রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনা আগের চেয়ে বেড়েছে কি না, জানি না। এসব ছিনতাইয়ের সঙ্গে দেশের অর্থনীতির খারাপ পরিস্থিতির সম্পর্ক আছে কি না, বলা কঠিন। কিন্তু দিনদুপুরে যে কায়দায় সেদিন ঘটনাটি ঘটল, তা ছিনতাইকারীদের মরিয়া দশারই প্রকাশ। আমার সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, তা সম্ভবত বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, এমন ঘটনার স্বীকার হয়তো অনেকেই হচ্ছেন।
আমার একটি সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া ছিল যে, কখনো ছিনতাইকারী ধরলে ঝামেলা না করে যা আছে, তা দিয়ে দেব। মাথা ঠান্ডা রেখে তা করতে পারায় এবং ফোনটি রক্ষা করতে পারায় নিজেকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম। এখন দিনকাল যা পড়েছে, তাতে কোনো কিছুকেই আর খুব অস্বাভাবিক মনে হয় না। রিকশায় বাকি পথ আসতে আসতে এই ঘটনাকেও স্বাভাবিক হিসেবেই নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করলাম। কিন্তু এমন একটি ঘটনার পর স্বাভাবিক থাকতে চাইলেও মনে হয় তা পারা কঠিন। চেষ্টা করলেও তা খুব কাজে দেয় না। একটা অসহায়ত্ব আর অপমানের বোধ তৈরি হবেই।
আমার ক্ষেত্রে যা হয়েছে তা হলো, লোকটির উষ্কখুষ্ক মুখটি হঠাৎ হঠাৎ ইচ্ছার বিরুদ্ধেই চোখের সামনে চলে আসছে। নিজের মনে অর্থহীন প্রশ্ন জাগছে, আমি কি বোকামি করেছি? কেন আমি শুরুতেই বুঝতে পারলাম না, রিকশাচালককে কেন দ্রুত চলে যেতে বললাম না? রাতের বেলায় রিকশায় চড়লে তো আমি বেশ সতর্ক থাকি, তখন কেন এত বেখেয়াল ও নির্ভার ছিলাম? কেন সন্দেহ হলো না!
একদিকে না চাইলেও এসব মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করছে, অন্যদিকে বাসার সবার নির্দেশ, হেঁটে বা রিকশায় অফিসে যাওয়া-আসা বন্ধ। মানে গাড়ি ছাড়া চলা যাবে না। এটা কোনো কথা! দেশের কতজন মানুষের গাড়িতে চড়ার সুযোগ আছে? আমার অফিসের ৯০ ভাগ সহকর্মী তো গাড়ি ছাড়া অফিসে আসা-যাওয়া করেন। কিন্তু এসব যুক্তি এখন বাসায় লোকজনের কাছে অর্থহীন। আপাতত কয়েক দিন যে এই বাধ্যবাধকতা আমাকে মেনে চলতে হবে, তা পরিষ্কার। হেঁটে বা রিকশায় নিজের সময়মতো চলাফেরার যে স্বাধীনতা আমি ভোগ করে আসছিলাম, তা কিছুদিনের জন্য হলেও যে ক্ষুণ্ন হতে যাচ্ছে, সেটা বুঝতে পারছি।
দেশে বা রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনা আগের চেয়ে বেড়েছে কি না, জানি না। এসব ছিনতাইয়ের সঙ্গে দেশের অর্থনীতির খারাপ পরিস্থিতির সম্পর্ক আছে কি না, বলা কঠিন। কিন্তু দিনদুপুরে যে কায়দায় সেদিন ঘটনাটি ঘটল, তা ছিনতাইকারীদের মরিয়া দশারই প্রকাশ। আমার সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, তা সম্ভবত বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, এমন ঘটনার শিকার হয়তো অনেকেই হচ্ছেন।
সাংবাদিক এবং লেখার সুযোগ আছে বলেই নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এমন একটি ঘটনা নিয়ে কিছু লেখা ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে বেশ দ্বিধায় ছিলাম। কিন্তু ভাবলাম, পাঠকদের সতর্ক করার জন্য হলেও তো লেখা উচিত। কারণ, রাস্তা-ঘাটে যত সিসিটিভি ক্যামেরাই থাকুক না কেন (আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটিও সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ার কথা), আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যতই তৎপর থাকুক, শেষ পর্যন্ত নিজের নিরাপত্তার দায়িত্ব যতটা সম্ভব নিজে নেওয়াই ভালো। অপরিচিত কারও এ ধরনের সালাম বা কুশল বিনিময়ের ব্যাপারে পাঠকেরা সাবধান হবেন, সতর্ক থাকবেন—সেই আশা করি।
সচেতন নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব ছিল ঘটনাটি পুলিশকে জানানো। সহকর্মীদের অনেকেই তেমন পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু কেন জানি ‘সচেতনতা’ ও ‘দায়িত্বশীলতা’ প্রকাশের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। অসহায়ত্বের বোধটাই সম্ভবত বেশি ঘিরে ধরেছে।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক। ই-মেইল: [email protected]