গ্রুপ থিয়েটারে জড়িয়ে পড়া আমার ছেলে ওয়াসির সূত্র ধরে। ওর স্কুল অরণী বিদ্যালয়। সেখানে ওর ছোট-বড় মিলিয়ে বেশ কিছু বন্ধু নিয়ে গড়ে ওঠা ছোটদের নাটকের দল বিবর্তন যশোর (ঢাকা ইউনিট) শিশু পরিবার।
বেশ বড় নাম; কিন্তু কাজ ছোটদের নিয়ে। নাম এত বড় হয়ে ওঠার অবশ্য একটা ইতিহাস আছে।
আশির দশকের শেষ ভাগে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে বিবর্তন যশোর। গোড়াতে যশোরকেন্দ্রিক ছিল দলটির নাট্যচর্চা। শহরের রাস্তায় রাস্তায় হঠাৎ জড়ো হয়ে নাটক করা, তারপর পুলিশ আসার আগেই সরে পড়া।
দলের পুরোনো সদস্যদের কাছে এমন গল্পই শুনেছি সব সময়। স্বৈরাচার এরশাদ পতনের পর বিবর্তন তার কাজের ধারা অব্যাহত রাখে এবং তাদের পরিচিতি যশোর ছেড়ে দক্ষিণবঙ্গে বিস্তার লাভ করে।
পরবর্তী সময়ে ১৯৯৮ সালের পর থেকে দলের অনেক সদস্য তাঁদের পেশাগত কারণে ঢাকায় চলে আসেন। গড়ে ওঠে বিবর্তন যশোর (ঢাকা ইউনিট)। এই ঢাকা ইউনিটের সদস্যদের সন্তানেরা ঢাকাতে বড় হচ্ছিল।
যশোরে বিবর্তনের মূলধারা থেকে একটু দূরেই পড়ে গিয়েছিল ওরা। এই শিশুদের জন্য থিয়েটার চর্চার সুযোগ করে দিতেই ঢাকা ইউনিটের শিশু পরিবার গড়ে উঠল।
করোনার শেষ দিকে এ দলেরই সদস্য মৃন্ময় চক্রবর্ত্তী আর সৈয়দ শাহীনুর রহমানের দেওয়া নাট্যরূপে, শাহীনুর রহমানের নির্দেশনায় সুকুমার রায়ের ‘পাগলা দাশু’ মঞ্চে প্রথমবার আত্মপ্রকাশ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।
একই সময় দীর্ঘ বিরতির পর মঞ্চে ফিরতে প্রস্তুত হচ্ছিল কৈবর্ত গাথা। ছেলে ঢোল বাজায় ছোটদের দলে। হঠাৎ বড়দের দলে ঢোল–বাদকের প্রয়োজন দেখা দেওয়ায়, আমাকে ঢোল বাজানোর সুযোগ দিতে চাইলেন শাহীন ভাই।
আমি যেহেতু বরাবরই ফাঁকিবাজ, তাই বললাম, ছোট বড় দুই দলে ওয়াসিই বাজাতে পারবে, আমি দেখিয়ে দেব। তখন সম্ভবত সে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। অত বড়, কঠিন নাটক, দুর্দান্ত সব অভিনেতা, আর তাদের মাঝে ছোট্ট ওয়াসি ঢোল বাজাচ্ছে! বেশ দেখার মতো দৃশ্য।
সেই কৈবর্ত গাথা নাটকে ৩০ সেকেন্ড এর মতো বাঁশি বাজানোর দরকার হতো। শেষ পর্যন্ত সেই দায়িত্বটা পড়ল আমার কাঁধে। তাই মাঝে মাঝে রিহার্সালে থাকতে হতো। বিশেষত, যখন রান থ্রু হতো। তাই কৈবর্ত গাথা নাটকটা বারবার দেখার সুযোগ হয়েছে।
নাটকটি লিখেছেন আব্দুল্লাহেল মাহমুদ, নির্দেশনা ফয়েজ জহির। দুজনই দেশের নাট্য অঙ্গনের প্রিয় মুখ। সত্যি বলতে কি, দর্শক হিসেবেও খুব বেশি নাটক আমার দেখা হয়নি। নাটক নিয়ে পড়াশোনা তার চেয়েও কম; কিন্তু এই নাটক যতবার দেখেছি, মনের গভীরে কোথায় যেন নাড়া দিয়ে গেছে।
নাটকটির প্রেক্ষাপট ঐতিহাসিক—এই দেশের মাটিতে পরাক্রমশালী পাল রাজাদের বিরুদ্ধে একেবারে সাধারণ মানুষদের বিদ্রোহ, কৈবর্ত অর্থাৎ জেলেদের বিদ্রোহ নিয়ে। নাটকটি চারটি প্রধান চরিত্রকে ঘিরে আবর্তিত হয়।
একদিকে ঐতিহাসিক চরিত্র রামপালের রাজ-সভাকবি সন্ধ্যাকর নন্দী। তাঁর লেখা দ্ব্যর্থবোধক সংস্কৃত কাব্য ‘রামচরিত’ এখনো অনুবাদসহ বাজারে কিনতে পাওয়া যায়।
এখানে রাজা রামপালের গুণকীর্তন করা হলেও কৈবর্তদের শেষ রাজা ভীমের বীরত্বও কিছুটা তুলে ধরা হয়েছে। বাকি তিনটি চরিত্রই কাল্পনিক—কানাই, চণ্ডক ও কঙ্কাবতী। কানাই চারণ কবি, পথে পথে ফেরে, ভিক্ষার অন্ন খুঁটে খায়। চণ্ডক ভীমের পালিত পুত্র, বিশ্বাসঘাতক। কঙ্কাবতী ‘চণ্ডকের পতিতা’; কিন্তু গোপনে সে পাল রাজাদের রণকৌশল জানিয়ে দেয় বিদ্রোহীদের, কানাইয়ের মাধ্যমে।
যা নিজ চোখে দেখে, তা কানাইকে নাড়া দেয়। তাই নিয়ে আপন সুরে গান বাধে, আর পথে পথে গেয়ে বেড়ায়। পতিতাপল্লি থেকে রাজপ্রাসাদ—সবখানেই পৌঁছে যায় কানাইয়ের সুর।
সেই কানাইয়ের কণ্ঠের সুরে মুগ্ধ হন সন্ধ্যাকর। একদিন ডেকে নেন নিজ প্রাসাদে। পথের ভিখারি কানাই রীতিমতো অভিভূত। কানাইয়ের চোখে সন্ধ্যাকর এক মহাপুরুষ। আপ্যায়ন শেষে সন্ধ্যাকর কানাইকে নিজের সঙ্গী করে নেওয়ার প্রস্তাব দেন।
শর্ত একটাই—পাল রাজার বিজয়গাথায় সুর দিতে হবে। এখানেই বাধে বিপত্তি। কানাই সোজা বলে দেয়, ‘বিজয়গাথা? পারব না গাইতে।’
সন্ধ্যাকর কানাইকে অর্থ-খ্যাতি-যশ সবকিছুর প্রলোভন দেখায়। তাতে কাজ না হলে প্রাণনাশের হুমকিও দেয়। তবু রাজি হয় না কানাই।
সন্ধ্যাকরের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে, ‘বেঁচে থেকেই বা কী লাভ?’ বলে, তার যা করার, সে যত সামান্যই হোক, তা সে করে যাবে। সে প্রশ্ন করে, ‘আত্মবিক্রয় করে খ্যাতিমান হব? কী লাভ তাতে?’
সে স্বপ্ন দেখে সুন্দর এক পৃথিবীর, যেখানে মাঠে মাঠে ধান, ঘরে ঘরে সুঠাম শিশু, আর চারণ-কবিকণ্ঠে আনন্দের গান। মৃত্যুভয় যে তার নেই তা নয়; কিন্তু ঘাতক পিছু নিলেও সে আশা হারায় না।
তাই দুই কবির দ্বৈরথে কানাইয়ের জয় হয়। প্রলোভন বা হুমকি, কোনো কিছুতেই তাকে কিনে নিতে পারে না সন্ধ্যাকর।
নাটকের একপর্যায়ে কঙ্কাবতীর সঙ্গে দেখা হয় সন্ধ্যাকরের। কঙ্কা বলে, সে ক্ষুধার জ্বালায় বাধ্য হয়েছে পতিতাবৃত্তি বেছে নিতে; কিন্তু সন্ধ্যাকর কেন নিজেকে বিক্রি করল? জানতে চায়, ‘গৃহে অন্ন, মাথায় ছাদ— সব থাকতে, তুই কেন বেশ্যা হলি?’
নাটকের শেষ সংলাপে, ঠিক এই প্রশ্নটাই সবার উদ্দেশে ছুড়ে দেয় সন্ধ্যাকর, ‘গৃহে অন্ন, মাথায় ছাদ, সব থাকতে, তুই কেন বেশ্যা হলি?’
কানাই চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করতেন মৃন্ময় দা। একসময় হঠাৎ মৃন্ময় দা দেশান্তরী হলেন। কৈবর্ত গাথার অভিনয় তাই বন্ধ।
মনে হতো এই নাটক নিয়মিত মঞ্চায়ন না করতে পারাটা রীতিমতো অপরাধ। তখন নতুন একটা নাটকের স্ক্রিপ্ট পড়া শুরু হচ্ছে। আমি আর আমার স্ত্রী সাবন্তীর মাথায় কেবল ঘুরছে কৈবর্ত গাথা। দলের বড়রা তখন এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিলেন। আমাকে বললেন, তুমি কর কানাই!
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার জোগাড়। স্কুলে একবার একটা নাটকে হালকা অভিনয় ছাড়া আমার আর কোনো অভিজ্ঞতাই নেই, গলায় সুর নেই। তবু নাটকের সহকারী পরিচালক দেবাশীষ ভট্টাচার্য, দলের কনিষ্ঠ সদস্য সায়নের ভাষায়, ‘হেলপার ডিরেক্টর’ তথা পলাশ দা’র কেন যেন মনে হলো আমি পারব।
মাস দুয়েক ফ্লোর আর ফ্লোরের বাইরে বিস্তর মহড়া হলো। অভিনয় কতটুকু হলো, তা বলতে পারব না; কিন্তু পলাশ দা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন মাসখানেক পর নাটক মঞ্চে উঠবে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে সে নাটক আর মঞ্চায়ন হয়নি। তবে আমার জঘন্য মানের অভিনয় থেকে দল এবং দর্শক বেঁচে গেছে।
এত কথার অবতারণা অবশ্য খানিকটা ভিন্ন কারণে। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জুলাই অভ্যুত্থানের দিনগুলো। মঞ্চে কানাই হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই; কিন্তু জুলাইয়ের দিনগুলো, এবং তার পরে নতুন করে দেশে স্বাধীনতা ফিরে এলেও কানাইয়ের প্রশ্নগুলো বারবার ঘুরে ফিরে সামনে এসেছে।
আমি, আমার স্ত্রী, আমার পরিবার অতি সাধারণ। হয়তো কানাইয়ের মতো পথের ভিখারি নই; কিন্তু অসাধারণও নই। নিজের এবং নিজের পরিবার নিয়ে সুখে থাকতে চেয়েছি। অন্যের ক্ষতি না করার চেষ্টা করেছি। নিজের গণ্ডির মধ্যে যতটুকু পারি উপকার করার চেষ্টা করেছি, তা যত সামান্যই হোক; কিন্তু যখন কানাইয়ের মতোই সাধারণ একজন আবু সাঈদ, অতি দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা এ দেশের সন্তান নিজের বুক পেতে দিল দেশের স্বার্থে, তখন আমরা বুঝতে পারলাম, সাধারণ মানুষের অতি সাধারণ কাজটাও কতটা শক্তিশালী।
শহীদ সাঈদ, কানাইয়ের চেয়েও অনেক এগিয়ে। কারণ তার ওপর পুরো পরিবারের ভরণপোষণের ভার ছিল, উচ্চশিক্ষিত সন্তানের কাছে বৃদ্ধ পিতার প্রত্যাশা ছিল। সেসব বোঝা ঘাড়ে নিয়েই সাঈদ গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছেন।
একা কানাইয়ের শক্তি হয়তো সামান্য। কিন্তু যখন সব কানাই, সব কঙ্কা এক কাতারে এসে দাঁড়ায়, তখন তারা প্রলয় সৃষ্টির ক্ষমতা ধরে।
স্ত্রীর হাত ধরে যখন আমি রাস্তায় নেমেছি, আবু সাঈদের আত্মদানের পরের দিন, মনে হয়েছে, আমাদের চারপাশে আরও অসংখ্য কানাই।
এরা কেউ অসাধারণ নন। যে রিকশাওয়ালা আহত ব্যক্তিদের হাসপাতাল নিয়ে গেছেন বিনা মূল্যে, যে কুলফি বিক্রেতা বিলিয়েছেন তার শ্রমের ফসল, যে মা নিজ সন্তানের হাত ধরে রাস্তায় নেমে এসেছেন—তাঁরা সবাই একেকজন কানাই কিংবা কঙ্কা।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজের অজান্তেই যখন গেয়ে উঠেছি, ‘আজি রক্ত নিশি ভোরে’, তখন মনের কোণে কানাই এসে দাঁড়িয়েছে তার সহজ কিন্তু সুকঠিন সাহস নিয়ে। সে অসাধারণ নয়, সে নাটকের নায়ক নয়। অতি সাধারণ; কিন্তু সে বিক্রি হওয়ার নয়। সে যে আপাত অকিঞ্চিৎকর কাজটি করে, সেটি সে নিষ্ঠার সঙ্গে করে যেতে চায়। কোনো ভয় থেকে নয়, কাউকে তুষ্ট করার জন্য নয়। এখানেই সে আর সবার চাইতে বেশি শক্তিশালী।
গত কয়েক দিনে বুঝেছি, আমাদের এত পাওয়ার জীবনে কানাই হয়ে ওঠা সহজ নয়। আমাদের সঞ্চিত সম্পদ, সামাজিক যশ, প্রতিপত্তি—আমাদের প্রতিনিয়তই কর্তব্য থেকে দূরে ঠেলে দেয়।
যার হারানোর ভয় যত বেশি, সে বোধ করি বিক্রি হয় তত সহজে। হয় ভয়ে, নয়তো লোভে—আমরা সহজ সত্য কথাটা বলে উঠতে পারি না। ছোট কিন্তু ঠিক কাজটা করতে আমাদের বাধে। আমাদের তুলনায় আপাত সম্বলহীন আবু সাঈদরা অনেক সহজে একেকজন কানাই হয়ে ওঠেন।
ঘাতকের সুকঠিন আঘাত নেমে আসার ঠিক আগে, কানাইয়ের মতো করে বলতে পারেন, ‘বরেন্দীতে যত দিন একটি প্রাণীও বেঁচে থাকবে, তত দিন আমার গানে বেঁচে থাকবে ভীমের কণ্ঠ।’ আর ভীরু আমাদের মনের আয়নায় ঝুলে থাকে কেবল একটি প্রশ্ন, ‘গৃহে অন্ন, মাথায় ছাদ, সব থাকতে, তুই কেন বেশ্যা হলি?’
কিন্তু একসময় আমাদেরও বিবেক জাগে। এই এত বছর আমরা কেন চুপ করে ছিলাম, সে প্রশ্ন আবু সাঈদ আমাদের নিজেদের করতে বাধ্য করেছেন। যখন সে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর খুঁজে পাইনি, নিজের কাছে নিজে মুখ দেখাতে হলেও আমরা পথে বেরিয়েছি।
কারণ শহীদদের রক্তের প্রতিবিধান না করে ঘরে ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ আর অবশিষ্ট ছিল না। সে কারণে বোধকরি কারও সাতে-পাঁচে না থাকা মধ্যবিত্তরাও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন।
কিন্তু আমাদের ঘরের টান বড় প্রবল। স্বৈরাচারের পতনের পর আবারও নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার চেষ্টাও বোধকরি অস্বাভাবিক নয়; কিন্তু জুলাই বিপ্লব আমাদের সবার জন্য বড় একটা সুযোগ এনে দিয়েছে। মুক্তির পরের কয়েক দিন বিস্তর মতভেদ দেখা দিয়েছে আমাদের নিজেদের মধ্যে।
মতপ্রকাশ, তথা দ্বিমত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকলে ভিন্নমতও বেরিয়ে আসবে। সেটাই স্বাভাবিক। আপাতদৃষ্টে একে অনৈক্যও মনে হতে পারে; কিন্তু যখনই ভাদ্রের অঝোর ধারা দেশকে প্লাবিত করেছে, মানুষের জীবনকে করেছে বিপন্ন, তখন আবারও এক হয়েছি আমরা।
সেখানে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশি হিসেবে লড়াই করেছে বাংলাদেশের জন্য। এই ঐক্যই এ দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি।
আমরা যখন বিশ্বাস করি, আমরা দেশের জন্য কিছু একটা করতে পারব, কিছু একটা করা সম্ভব, তখন আমরা অপ্রতিরোধ্য। তখন আমরা সবাই কানাই, আমরা সবাই কঙ্কাবতী। তাই এ লড়াইয়ে আমাদের পরাজিত করা অসম্ভব।
মানজুর-আল-মতিন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী