‘শত্রুর মুখে ছাই’ দিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে রপ্তানি হয়েছে ৪৪৯ কোটি ডলারের পোশাক। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ বেশি। জানুয়ারিতে পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪৯৭ কোটি ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের হিসাবে, জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ২৮৬ কোটি ডলারের। এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেশি।
নানা বাধা ও প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি যে উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে, স্বীকার করতেই হবে, তার প্রধান চালিকা শক্তি শ্রমিক। পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে বা্ংলাদেশের শ্রমিকদের বেতনই সবচেয়ে কম। অর্থাৎ সস্তা শ্রমিক। মালিকেরা যতই বিনিয়োগ করুন না কেন, শ্রমিক না থাকলে কারখানা চলবে না। কোনো কোনো উন্নত দেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে পরীক্ষামূলক কারখানা চালালেও বাংলাদেশ সে অবস্থায় আসতে অনেক দেরি।
প্রশ্ন হলো, যে শ্রমিকেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বিদেশি ক্রেতাদের জন্য পোশাক তৈরি করেন, তাঁদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধে মালিকদের এত গড়িমসি কেন? গত বছর তৈরি পোশাকশিল্পের নতুন মজুরিকাঠামো হলো। শ্রমিকদের দাবি ছিল ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা করার। মালিকেরা বললেন, শিল্পের অবস্থা ভালো নয়। অতএব মজুরি বাড়ানো যাবে না। এরপর সরকার, মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের দফায় দফায় বৈঠকে ঠিক হলো শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি হবে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। অর্থাৎ শ্রমিকেরা যে দাবি করেছিলেন, তার অর্ধেক। তারপরও তাঁরা সেটি মেনে নিয়েছেন।
কিন্তু একশ্রেণির মালিক আছেন, যতই মুনাফা হোক, শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা দিতে চান না।
সামনে পবিত্র ঈদুল ফিতর। স্বাভাবিকভাবে শ্রমিকদের প্রত্যাশা ছিল ঈদের আগে সব কারখানায় শ্রমিকের বোনাস ও মার্চ মাসের বেতন বুঝিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু পত্রিকায় যে খবর এসেছে, তা বিচলিত হওয়ার মতো। ৯ এপ্রিল প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ৬০ শতাংশ কারখানার শ্রমিকেরা গত মার্চ মাসের বেতন গতকাল সোমবার বিকেল পর্যন্ত পাননি। ঈদের উৎসব ভাতা বা বোনাস পাননি ১৪ শতাংশ কারখানার শ্রমিক।
তখনই প্রথম আলো অনলাইনে জানা গেল, ৭৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ কারখানা শ্রমিকদের মার্চ মাসের বেতন এবং ৯৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ বোনাস পরিশোধ করেছে। তারপরও ২৪ দশমিক ২২ শতাংশ কারখানার শ্রমিককে মার্চ মাসের বেতন ছাড়াই ঈদ করতে হবে। দুর্মূল্যের বাজারে বেতন না পাওয়া শ্রমিকেরা কীভাবে ঈদের আনন্দ উপভোগ করবেন?
শিল্প পুলিশ বলছে, সাভার-আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, খুলনা, কুমিল্লা ও সিলেটের তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ২ হাজার ৫৩৪ কারখানার মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ১ হাজার ৯টি মার্চের বেতন দিয়েছে। উৎসব ভাতা পরিশোধ করেছে ২ হাজার ১৮৩টি কারখানা।
কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএর শীর্ষ নেতারা বরাবরের মতো মালিকদের পক্ষে সাফাই গেয়ে চলেছেন। তাঁদের দাবি, বেতন ও উৎসব ভাতা নিয়ে বড় কোনো সমস্যা নেই। মঙ্গলবারের মধ্যে সব কারখানা বেতন-ভাতা পরিশোধ করবে। সর্বশেষ যে খবর জানা গেল, মঙ্গলবারেও সব কারখানায় বেতন-ভাতা হয়নি।
কয়েক বছর আগেও পোশাক খাতের শ্রমিকদের বেতন ও উৎসব ভাতা পরিশোধের জন্য সময়সীমা বেঁধে দিত সরকার। তবে মালিকপক্ষের চাপে এখন আর সেটি করা হয় না। শুধু বলা হয়, ঈদের ছুটির আগে বেতন-ভাতা দিতে হবে। এতে শেষ মুহূর্তে বেতন-ভাতা নিয়ে কিছু কারখানায় জটিলতা হয়। অনেক সময় শেষ মুহূর্তে বেতন–বোনাস পেলেও শ্রমিকেরা বাড়ি যেতে পারেন না। মালিকেরা সেটাই চান।
শিল্প পুলিশ সাভার-আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, খুলনা, কুমিল্লা ও সিলেটের তৈরি পোশাক, বস্ত্রকল, পাটকলসহ বিভিন্ন খাতের ৯ হাজার ৪৬৯টি শিল্পকারখানা তদারক করে থাকে। তারা বলেছে, সোমবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত ৪৯ শতাংশ কারখানা মার্চের বেতন পরিশোধ করেছে। আর উৎসব ভাতা পরিশোধ করেছে ৮১ শতাংশ কারখানা। বেতন-ভাতা দিয়ে ২ হাজার ৯৮৪টি কারখানা ঈদের ছুটি দিয়েছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৩৮১টি কারখানায় ছুটি হয়েছে।
শিল্প পুলিশ জানায়, তাদের তদারকির মধ্যে থাকা বিজিএমইএর সদস্য ১ হাজার ৫৬১টি পোশাক কারখানার মধ্যে ৯২০টি বা ৫৯ শতাংশ গতকাল পর্যন্ত মার্চের বেতন পরিশোধ করেনি। আর উৎসব ভাতা দেয়নি ১৮১টি কারখানা।
রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি এস এম মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেসব কারখানায় বেতন-ভাতা পরিশোধ নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছিল, সেগুলোর সমস্যা আমরা সমাধান করেছি। মিরপুরের একটি কারখানার মেশিন (যন্ত্রপাতি) বিক্রি করে আমরা শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিয়েছি।’ নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সদস্য ৬২৬টি কারখানার মধ্যে ৬৯ শতাংশ বেতন পরিশোধ করেনি বলে জানায় শিল্প পুলিশ। তারা বলেছে, এই সংগঠনের ১৪৪টি কারখানা উৎসব ভাতা দেয়নি।
শ্রম প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম চৌধুরী সপ্তাহ দুই আগেই মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে ঈদের আগে বোনাস ও মার্চ মাসের বেতন দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। ঈদের আগে কোনো মালিক কারখানা বন্ধ করতে পারবেন না বলে হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তারপরও বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধ করে আছে। ঈদের আগে এটা শ্রমিকদের পেটে লাথি মারা ছাড়া কিছু নয়। একটি কারখানার মালিক ফেব্রুয়ারি মাসের অর্ধেক বেতন দিয়ে বসে আছেন। বোনাস ও মার্চ মাসের বেতনের কোনো খবর নেই। এ পরিস্থিতিতে যদি ওই কারখানার শ্রমিকেরা রাস্তায় নামেন, তাহলে কি তাঁদের দোষ দেওয়া যাবে?
শ্রমিকনেতা সিরাজুল ইসলামকে জিজ্ঞাসা করলাম, এ মুহূর্তে কতগুলো কারখানা বন্ধ আছে। তিনি জানালেন, করোনার পর থেকে এ পর্যন্ত অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে। আবার কিছু কিছু কারখানা সম্প্রসারিত হওয়ায় কিছু শ্রমিক কাজ পেয়েছেন। তা সত্ত্বেও বেকার শ্রমিকের সংখ্যা এক লাখের কম হবে না।
এই যে ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন–ভাতা নিয়ে যে সমস্যা হয়, তার সবটা আর্থিক কারণে নয়। অনেক মালিক ইচ্ছা করেই বেতন-বোনাস বকেয়া রাখেন। শ্রমিকদের মাসের বেতন পরের মাসের ৭ তারিখের মধ্যে দেওয়ার কথা থাকলেও মালিকেরা সেটা মানেন না। কোনো কোনো মালিক ১০ তারিখের মধ্যে শোধ করলেও বাকিরা ১৫ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত নিয়ে যান। বিলম্বে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হলে মালিকদের লাভ। টাকাটা অন্যত্র খাটাতে পারেন।
এ বিষয়ে তাঁদের মধ্যে আরেকটি মনস্তত্ত্ব কাজ করে। মালিকেরা ভাবেন, শ্রমিকেরা সবকিছু বেতন–বোনাস সময়মতো পেয়ে গেলে নতুন দাবি নিয়ে হাজির হবেন। সেটা বন্ধ করতেই তাঁরা আর্থিক অসামর্থ্যতা দেখান। বিদেশি ক্রেতাদের অনাগ্রহের দোহাই দেন। তাঁদের এসব দোহাই যে ভিত্তিহীন, রপ্তানির প্রবৃদ্ধিই তার প্রমাণ।
সরকার একটু দৃঢ় ভূমিকা নিলেই মালিকেরা শ্রমিকদের পাওনা সময়মতো দিতেন বলে মনে করেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আখতার। তিনি বলেন, ঈদের আগে বেতন-ভাতা পরিশোধের বিষয়ে শ্রম আইন কিংবা বিধিমালায় স্পষ্ট কিছু নেই। এই আইনি জটিলতা ও কিছুসংখ্যক মালিকের খামখেয়ালিপনার জন্যই শ্রমিকেরা সময়মতো বেতন-বোনাস পাচ্ছেন না।
আবার অনেক মালিক মনে করেন, ঈদের আগে পুরো মাসের বেতন দিয়ে দিলে শ্রমিকেরা বাড়িতে বেশি দিন ছুটি কাটাবেন। ঠিক সময়ে কাজে যোগ দেবেন না। এ অজুহাতে তাঁরা শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেন, যা কেবল অন্যায় নয়, শ্রম আইনের বরখেলাপ। অগ্রিম নয়; মার্চ মাসের কাজের মজুরি চাইছেন শ্রমিকেরা।
মালিকেরা কারখানাগুলোয় প্রয়োজনের তুলনায় কম শ্রমিক রাখেন এবং তাঁদের দিয়ে বাধ্যতামূলক ওভারটাইম করান। প্রয়োজনমাফিক শ্রমিক থাকলে একাংশ ছুটিতে থাকলেও সমস্যা হতো না।
শ্রমিকেরা বেতন-ভাতার দাবিতে রাস্তায় নামলে সরকার পুলিশ দিয়ে তাদের মোকাবিলা করে। অনেক সময় বলপ্রয়োগও করা হয়। কিন্তু মালিকেরা পূর্বঘোষণা ছাড়াই করখানা বন্ধ করে দিলে কিংবা শ্রমিকদের পাওনা না মেটালে মালিকদের কিছুই হয় না। কেননা সরকার, আইন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা —সবই তাঁদের।
মঙ্গলবার দুপুরে যখন লেখাটি শেষ করছি, তখনই প্রথম আলো অনলাইনে জানা গেল, ৭৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ কারখানা শ্রমিকদের মার্চ মাসের বেতন এবং ৯৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ বোনাস পরিশোধ করেছে। তারপরও ২৪ দশমিক ২২ শতাংশ কারখানার শ্রমিককে মার্চ মাসের বেতন ছাড়াই ঈদ করতে হবে। দুর্মূল্যের বাজারে বেতন না পাওয়া শ্রমিকেরা কীভাবে ঈদের আনন্দ উপভোগ করবেন?
বেতন–ভাতার সমস্যা কেবল পোশাকশিল্পেই নয়, সংবাদমাধ্যমসহ অনেক খাতেই সমস্যাটি আরও প্রকট। অনেক মালিক আছেন, মাসের পর মাস বেতন না দিয়েও প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন।
এর অবসান ঘটুক। মালিকদের লাভের অঙ্ক বাড়তে থাকবে, আর শ্রমিকেরা ন্যায্য পাওনা থেকে, ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবেন, এটা চলতে পারে না।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]