কেন আমাদের সবকিছু মেনে নিতে হবে

হত্যাকান্ডের বিচারের দাবিতে হাইকোর্টের মাজার গেটের সামনের সড়কে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

গত ৩০ জুলাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা ভিডিও আমাদের সামনে এল। রাস্তায় ছুটোছুটির মধ্য থেকে একজন লোক আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছেন। তাঁকে এসে আরও কয়েকজন ধরলেন। সামনের দিকটায় চোখ পড়তে বুঝলাম, ওনার বুকের বাঁ পাশে গুলি লেগেছে। স্রোতের মতো রক্তের ধারা নেমে আসছে বুক গড়িয়ে। ধীরে ধীরে উনি বসে পড়লেন।

ভিডিওটি এ পর্যন্তই। ভিডিওর কমেন্ট (মন্তব্য) সেকশন থেকে জানতে পারলাম, তিনি বেঁচে নেই। আমার দেশের সাম্প্রতিক চালচিত্র এটা। এ রকম আরও অজস্র ঘটনা ভেসে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও পত্রিকাজুড়ে। কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলন ঘিরে এ পরিস্থিতির উদ্ভব।

এ রকম অবস্থায় বাড়ির বাইরে না বেরিয়ে নিরাপদে থাকা সম্ভব? বাড়ির ছাদে ওঠার ফলে গুলিতে মারা গেছে শিশুরা। তাহলে ছাদেই যাওয়ার কী দরকার? ঘরের ভেতর থাকলেই হলো!

বাইরে গন্ডগোল চলছে, তাই ঘরের জানালা বন্ধ করতে যাওয়ায় বুলেট এসে মাথা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল ছোট্ট এক শিশুর।

এতসংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা ঘটার পর যখন বলা হয় যে এতে গভীর রাজনৈতিক কূটকৌশল অবলম্বন করা হয়েছে, তখন আমাদের মধ্যে অনেকই সেটা মেনে নিতে তৈরি থাকে। আমাদের মনন ও মস্তিষ্ককে এমনভাবে তৈরি করে নেওয়া হয়েছে যে আমরা সরকারের পরবর্তী ব্যাখ্যা শোনার জন্যই অপেক্ষা করি। কারণ, আমাদের অবচেতন মনে কাজ করে যে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে যায় না—এমন কোনো কথা বললেই বিশেষ কিছু ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হবে।

এরপর কোথায় থাকতে বলবেন? কোথায়, কীভাবে নিরাপদ থাকার আশা করতে পারেন? রাস্তা ছেড়ে ছাদে এলেন, ছাদ থেকে ঘরে, এরপর কি আর কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে?

এই মৃত্যুগুলো কীভাবে হয়েছে, তার ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা আছেন। তাঁরা এরই মধ্যে বলেছেন, যাঁরা রাস্তায় মারা গেছেন, তাঁদের বিশেষ রাজনৈতিক পরিচয় বা সামাজিকভাবে ‘অগ্রহণযোগ্য’ কোনো ইতিহাস আছে। তাই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে বিনা বিচারে, নিরস্ত্র অবস্থায় তাদের মৃত্যু ঘটতেই পারে! যারা ঘরে মারা গেছে, তাদের মৃত্যুকে কিছুটা দুর্ভাগ্যজনক বলা যেতে পারে! তবে এ পরিস্থিতিতে বিশেষ কিছু মৃত্যু দুঃখজনক! কারণ, তাঁরা সরকারি দলের সমর্থক।

এসব কথা শুনে আমরা কেউ হয়তো মাথা নেড়ে কিংবা ‘সম্মতি’ জানিয়ে যে যার কাজে চলে যাব। তখন বলা হবে, কারণ অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য এসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। বুঝতে পারছেন তো, আপনার অবস্থান কোথায়? আপনার নিজের দেশের পথে চলার অধিকার নেই। ঘরের ভেতরেও নিরাপত্তা নেই; বরং এ ধরনের মৃত্যুর বিপরীতে সরকারের বেশ কিছু ‘যুক্তি’ আছে।

আরও পড়ুন

এটা স্পষ্ট যে ন্যায্যতা, সততা, দায়বদ্ধতা, জবাবদিহি—এ বিষয়গুলোর উপস্থিতি রাষ্ট্র পরিচালনার নীতির ক্ষেত্রে এ দেশে আর প্রাসঙ্গিক নয়। এগুলোর অনুপস্থিতিই এখানকার অঘোষিত নিয়ম। আমরা চেতনাধারী—এটা প্রমাণ করতে হলে অঘোষিত এই নিয়মগুলো মেনে চলা এখন বাধ্যতামূলক। নয়তো আপনি ‘স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি’। আর সে ক্ষেত্রে আপনার অস্বাভাবিক মৃত্যু হওয়াটা তাই খুবই স্বাভাবিক!

এ-ই হলো আমাদের বাস্তবতা। আমরা এটা মেনে নিয়েছি। কিন্তু একটা স্বাধীন, গণতান্ত্রিক দেশে বহু মত ও পথ থাকা নিষিদ্ধ কিছু হওয়ার কথা ছিল কি? বিভিন্ন মতাদর্শের সহাবস্থান অসম্ভব হওয়ার কথা ছিল কি? ন্যায্য দাবি জানানোর অপরাধে নির্বিচার অগুনতি হত্যাকাণ্ড ঘটার কথা ছিল কি?এ দেশ আমার–আপনার সবার।

এখানকার রাস্তায় নিরাপদে চলার অধিকার আমাদের আছে। ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য পথে নামারও অধিকার আছে। ভিন্নমত ধারণ ও প্রকাশের অধিকার আছে। আমরা নিজেদের জায়গা ছেড়ে দিতে দিতে এক অদ্ভুত বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছি। আর সেই সুযোগে ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা তাদের জন্য ইচ্ছেমতো সবকিছু সাজিয়ে নিয়েছেন, যেখানে অনিয়মই নিয়ম।

এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, অহিংস আন্দোলনকে কল্পনাতীত বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দমন করার চেষ্টা করা হয়েছে।

এতসংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা ঘটার পর যখন বলা হয় যে এতে গভীর রাজনৈতিক কূটকৌশল অবলম্বন করা হয়েছে, তখন আমাদের মধ্যে অনেকই সেটা মেনে নিতে তৈরি থাকে। আমাদের মনন ও মস্তিষ্ককে এমনভাবে তৈরি করে নেওয়া হয়েছে যে আমরা সরকারের পরবর্তী ব্যাখ্যা শোনার জন্যই অপেক্ষা করি। কারণ, আমাদের অবচেতন মনে কাজ করে যে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে যায় না—এমন কোনো কথা বললেই বিশেষ কিছু ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হবে।

সেই ট্যাগের আওতায় চলে এলে নিরস্ত্র অবস্থায় দাঁড়ানো মানুষকেও গুলি করে মারা হতে পারে! আমরা হয়তো ভুলেই গেছি, চিহ্নিত অপরাধীকেও বিনা বিচারে সাজা দেওয়া যায় না; আর মৃত্যুদণ্ড তো অনেক বড় বিষয়।

এই যে সাজানো বাস্তবতা, এটা তৈরি করা হয়েছে ভয় দেখিয়ে। ভিন্নমত পোষণ করার পরিণামে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চলবে, এটা যে হতে পারে না। কিন্তু ভয়ের কারণে আমরা সেটা ভুলে যাই। আমরা শিখিয়ে দেওয়া ব্যাখ্যা মেনে দ্রুত সবকিছু স্বাভাবিক হোক, সেটা চাই। এর চেয়ে বেশি কিছু আমাদের বোঝার দরকার নেই।

আমরা বলতে ভুলে গেছি যে নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের নিজের মত ও পথ বেছে নিয়ে নিরাপদ জীবনযাপনের পূর্ণ অধিকার রয়েছে। আমাদের মগজ ধোলাই হয়ে গেছে; ‘হীরক রাজার দেশে’র ‘যন্তরমন্তর’ ঘরে ঢোকানো মানুষগুলোর মতো।

অনেকটা সময় অন্ধকারে থাকলে সূর্যালোকে চোখ জ্বালা করে ওঠে। কিন্তু সেই ভয়ে তো আঁধার ঘরে পড়ে থাকার কোনো কারণ নেই। চোখ সয়ে যায় অল্প সময়েই। আমাদের অবস্থা হয়েছে এ রকম যে আমরা আলোর মুখ না দেখতে দেখতে অন্ধকারকেই চিরস্থায়ী ধরে নিয়েছি। ‘স্থিতি-জড়তা’র কারণে আমরা অনেকই হয়তো এগিয়ে আসতে পারছি না।

তবে আশার কথা হলো, ক্রমে প্রগাঢ় হয়ে ওঠা আঁধার আলোর ইঙ্গিত আনে। সেটাই সময়ের ধর্ম। দিন–রাতের আবর্তে সময় যেভাবে বয়ে চলে, সেভাবেই আঁধার কেটে আলো আসবেই।

  • মানজুর আল মতিন সুপ্রিম কোটের আইনজীবী

  • সারা আহমেদ চিকিৎসক