সামনে কী হতে যাচ্ছে—দেশের রাজনীতিতে এই নিয়ে রহস্য ও বিভ্রান্তি বাড়ছে। কারণ, রাজনীতির দুই প্রধান পক্ষ তাদের কথাই বলে যাচ্ছে। সংবিধান মেনে যথাসময়ে নির্বাচন হবে—এটা আওয়ামী লীগের কথা। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন বলতে দলটি বোঝায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনই নির্বাচন। বিএনপির পাল্টা অবস্থান হচ্ছে, এই সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে তারা যাবে না।
এমন একটি অবস্থায় সামনে সংঘাত ও সহিংসতা হবে—এমন ভয় পাচ্ছে অধিকাংশ মানুষ। প্রশ্ন হচ্ছে, এরপর কী? সংঘাত-সহিংসতারও তো শেষ আছে। নির্বাচনটি দিন শেষে কীভাবে হবে? নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এখন পর্যন্ত যে অবস্থানে, তাতে শুধু সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কাই করা যায়, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। কিন্তু কৌতূহলী জনগণ তো এতে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। তারা নিজেরাই নিজেদের মতো করে সামনে কী হতে যাচ্ছে, তার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করাচ্ছে। এই জনগণের বড় অংশই আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে বিভক্ত।
নেতা-নেত্রীরা কোথায় কখন কী বলছেন, আগের বক্তব্যের সঙ্গে আজকের বক্তব্য মিল-অমিল কতটা, তাঁদের মুখের অভিব্যক্তি কেমন ছিল, আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে কি না—এসব নানা দিক বিবেচনায় নিয়ে জনগণ এখন হিসাব-নিকাশ করে। এই জনগণের অধিকাংশেরই যেহেতু পক্ষ-বিপক্ষ আছে, তাই এসব হিসাব-নিকাশ করতে গিয়ে তাদের এক পক্ষ আজ খুশি হয় তো কাল মন খারাপ করে। আরেক পক্ষের আজকের মন খারাপ হয়তো পরদিন কেটে যায়। পরিস্থিতি এখন এতটাই তরল।
শুধু দেশের নেতা-নেত্রীদের কথা নয়, বিদেশের পত্রপত্রিকায় কী লেখা হচ্ছে, কোন দেশ বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কী বলছে, সেগুলোও এখন জনগণের মনোযোগের কেন্দ্রে। কারণ, তারা ভালো করেই জানে, দেশের রাজনীতি আর দেশে আটকে নেই। এর গণ্ডি বেড়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতির পেছনে এখন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া তো আছেই, এমনকি ইরানও এখন বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন যে পর্যায়ে এসে পড়েছে, মানে একটি চূড়ান্ত পরিণতির জন্য যখন সব দলের কর্মী-সমর্থক ও সাধারণ জনগণ অপেক্ষা করছে, তখন এটা যেন অনেকটা দমের খেলায় পরিণত হয়েছে। এই মনে হচ্ছে কোনো দল এক গোলে পিছিয়ে পড়ছে, এর পরপরই হয়তো অপর পক্ষ গোল শোধ করে এগিয়েও যাচ্ছে। রাজনীতিটা এখন এভাবেই চলছে। দুই পক্ষকেই স্নায়ুশক্তির পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। এই দমের খেলায় শুধু কার দম কতটা আছে তা নয়, শেষ পর্যন্ত দম ধরে রাখতে পারাটাই সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
জনগণ এসব থেকে নিজেদের হিসাব-নিকাশ মেলায়। আগেই বলেছি, এই জনগণের মধ্যে পক্ষ-বিপক্ষ আছে, বড় দল দুটির কর্মীরা যেমন আছেন, সরব-নীরব সমর্থকেরাও আছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতায় এক পক্ষ যখন খুশি হয়, অন্য পক্ষ তখন হতাশ হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকাকে তারা বাংলাদেশের ওপর হস্তক্ষেপ বলে মনে করে। তারাই আবার বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত দীর্ঘদিন চুপ থাকায় বেশ অস্বস্তিতে পড়েছিল। এখন ভারত মুখ খুলেছে। তারা বাংলাদেশে ‘নির্ধারিত সময়ে ও শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচন দেখতে চায়। আর বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি প্রশ্নে ভারতের অবস্থান হচ্ছে, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার গড়া হবে কি না, সে বিষয়টি সে দেশের সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে।’
ভারতের এই অবস্থানকে সরকারি দলের লোকজন স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের পক্ষে বলে মনে করছেন। এরই মধ্যে ভারতের ‘আনন্দবাজার’ এবং জার্মান সংবাদমাধ্যম ‘ডয়চে ভেলে’ খবর দিয়েছে, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা দিয়েছে ভারত। ‘আনন্দবাজার’–এর শিরোনামটি ছিল এমন—‘হাসিনাকে দুর্বল করলে ক্ষতি সবার, বার্তা আমেরিকাকে।’
এক পক্ষের মনে ভারতের এই অবস্থান যতটাই আশার আলো জাগিয়েছে, অন্য পক্ষকে ততটাই বিমর্ষ করেছে। তারা তাই এই খবরের যথার্থতা ও সূত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে। মানে তারা এমন একটি খবর বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না। একই সঙ্গে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র সামনে আরও পদক্ষেপ নিক, সেই আশায় তারা দিন গুনছে। কারণ, ‘আনন্দবাজার’–এর এই খবরের কয়েক দিন আগেই পত্রপত্রিকায় তারা মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের টম ল্যানটস হিউম্যান রাইটস কমিশনের ব্রিফিংয়ের খবর পড়েছে। সেখানে মানবাধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া পর্যন্ত চলমান নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র আরও কঠোর কিছু পদক্ষেপ নিক—এমন প্রসঙ্গও সেখানে আলোচিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে একের পর এক লোকজন আসছেন। এগুলো এক পক্ষকে উৎসাহিত করে। দুই কংগ্রেসম্যানের সফর, এর আগে পররাষ্ট্র দপ্তরের বৈশ্বিক দুর্নীতি দমন বিভাগের সমন্বয়কারী রিচার্ড ন্যাপিউর সফর এবং তাঁর বক্তব্যও তাদের জন্য উদ্দীপনামূলক ছিল। তিনি বলে গেছেন, দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞাকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র। এই কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বা ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই তারা খুঁজে বের করেছে এবং খুশিও হয়েছে। ভারতের ‘আনন্দবাজার’–এর খবর তাদের সেই খুশির মেয়াদকে দীর্ঘ হতে দেয়নি।
দুই দলের কর্মী ও সমর্থকদের অবস্থা অনেকটা ‘এই হাসি, এই কান্না’র মতো। আশা বা হতাশা—কোনোটাই তাঁরা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারছেন না। আশার মধ্যেই হতাশার কিছু একটা চলে আসে, আবার হতাশার মধ্যেই তাঁরা আশার আলো খোঁজার চেষ্টা করছেন। দুটি রাজনৈতিক দলই সম্ভবত এখন সবচেয়ে বিপদে আছে নিজেদের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের চাঙা ও আত্মবিশ্বাসী রাখা নিয়ে। সরকারি দলকে অবশ্য একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারি প্রশাসনযন্ত্রকেও চাঙা রাখার বাড়তি চ্যালেঞ্জটি নিতে হচ্ছে।
সামনে যুক্তরাষ্ট্রের আরও লোকজন আসবেন। বাংলাদেশে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাঁদের তরফে নতুন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় কি না, তা নিয়ে এক পক্ষকে প্রতীক্ষায় ও অন্য পক্ষ উদ্বেগের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। ভারতের কাছ থেকেও হয়তো আরও কিছু শোনা যাবে। সেখানকার পত্রপত্রিকাগুলোয় লেখালেখিও শুরু হয়েছে। দেশটির ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকার ম্যাগাজিন ‘ফ্রন্টলাইন’–এ প্রনয় শর্মা লিখেছেন, জানুয়ারির নির্বাচনে যদি শেখ হাসিনা হারেন, তবে বাংলাদেশ দীর্ঘ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে।
অন্যদিকে ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ অনলাইনে দেবাদ্বীপ পুরোহিত ভারতের নিরাপত্তা সূত্রকে উল্লেখ করে লিখেছেন, বাংলাদেশের ২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে একমত হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ বৈঠকের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দুটি পরিষ্কার বার্তা দিতে পারেন। প্রথমত, আগামী নির্বাচন অবশ্যই অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, তাঁর দল আওয়ামী লীগ থেকে সব চীনপন্থী ও ইসলামপন্থী নেতাদের সরিয়ে দিতে ও নির্বাচনে অসাম্প্রদায়িক ও জনপ্রিয় প্রার্থীদের মনোনয়ন দিতে হবে। ‘টেলিগ্রাফ’–এর এই বক্তব্য অবশ্য ‘আনন্দবাজার’–এর বক্তব্যের চেয়ে পুরোই আলাদা।
আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদল ভারত সফর করে এসেছে। জাতীয় পার্টির জি এম কাদের এখন দিল্লিতে। সামনে বিএনপির কোনো প্রতিনিধিদল ভারতে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বোঝা যায়, সামনের দিনগুলোয় বাংলাদেশের রাজনীতি-সচেতন জনগণের নজর থাকবে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে দিকে। মনোযোগ থাকবে চীনের দিকেও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ মঙ্গলবার ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে জোহানেসবার্গ যাচ্ছেন। সেখানে সি চিন পিং ও মোদির সঙ্গে তাঁর কথা হবে। বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে এসব দেখা-সাক্ষাতের গুরুত্ব এখন কতটা, তা কারও অজানা নয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন যে পর্যায়ে এসে পড়েছে, মানে একটি চূড়ান্ত পরিণতির জন্য যখন সব দলের কর্মী-সমর্থক ও সাধারণ জনগণ অপেক্ষা করছে, তখন এটা যেন অনেকটা দমের খেলায় পরিণত হয়েছে। এই মনে হচ্ছে কোনো দল এক গোলে পিছিয়ে পড়ছে, এর পরপরই হয়তো অপর পক্ষ গোল শোধ করে এগিয়েও যাচ্ছে। রাজনীতিটা এখন এভাবেই চলছে। দুই পক্ষকেই স্নায়ুশক্তির পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। এই দমের খেলায় শুধু কার দম কতটা আছে তা নয়, শেষ পর্যন্ত দম ধরে রাখতে পারাটাই সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক।
ইমেইল: [email protected]