গাইবান্ধায় একটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন নিয়ে যে তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছে, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। অনেকে বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে বাহবাও দিয়েছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এমনকি গাইবান্ধায় আওয়ামী লীগ কমিশনের পদত্যাগ দাবি করে মিছিলও করেছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও মন্ত্রীদের মধ্যে কয়েকজন নির্বাচন বন্ধের যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তা অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অবাক করার মতো কিছু নয়। কিন্তু বর্তমান নির্বাচন কমিশন যে কিছুটা বিচলিত বোধ করেছে বা ঘাবড়ে গেছে, তা প্রকাশ পেয়ে গেছে। তা না হলে তড়িঘড়ি করে সাবেক কমিশনারদের ডেকে এনে তাঁদের সমর্থন নেওয়ার প্রয়োজন হবে কেন? মনে হয় বর্তমান কমিশন আত্মবিশ্বাস হারিয়ে মেরুদণ্ড খুঁজছে।
ভোট বন্ধের পরে মূল্যায়ন কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘মূল্যায়নের খুবই প্রয়োজন রয়েছে। যেকোনো বিষয়ে বিচারক হিসেবে আমরা সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করি, বিষয়টা ঠিক হয়েছে কি না। আমরা শুদ্ধ সিদ্ধান্ত নিয়েছি কি না। আমরা সঠিক মনে করছি। তারপরও এটি সঠিক না-ও হতে পারে। কোর্টে গিয়ে কেউ চ্যালেঞ্জ করেন; তাঁরা যদি বলতেন সঠিক সিদ্ধান্ত নেননি; তখন আমাদের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনার প্রয়োজন হতো।’
তিনি বলেন, সবাই একমত পোষণ করেছেন। ভোট বন্ধের সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে। সাবেক কমিশনারদের বক্তব্যে নিজেরা উৎসাহিত হয়েছেন বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন (বৈঠকে স্বস্তি খুঁজে পেল ইসি, সমকাল, ২০ অক্টোবর ২০২২)। তাঁরা সম্ভবত এতটাই ভয় পেয়েছেন যে সাবেকদের কাছ থেকে সাহস খোঁজা যে বিপজ্জনক, তা তাঁরা ভুলে গেছেন। ফলে এমন এক নজির তৈরি হলো, যা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
কোন পরিস্থিতিতে ভোট গ্রহণ বন্ধ করতে হবে, তা যেহেতু আইনে স্পষ্ট বলা আছে, সেহেতু আইন প্রয়োগের পর তার যথার্থতা যাচাইয়ের প্রশ্ন কেন উঠবে? আর সাবেক কমিশনাররা যখন থেকে সাংবিধানিক দায়িত্ব শেষ করেছেন, তারপর থেকে তাঁদের সঙ্গে আর দশজন নাগরিকের অবস্থানের কি কোনো ফারাক আইনে আছে? ধরা যাক, সাবেক কমিশনারদের মধ্যে যিনি গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন, তিনি ভবিষ্যতে মনোনয়ন পেলেন এবং তাঁর আসনে গাইবান্ধা পরিস্থিতির মতো অবস্থা তৈরি হবে, তখন কি কমিশন তাঁর মতামতকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে তা অনুসরণ করবে?
আউয়াল কমিশনের আমন্ত্রণ পেয়ে যাঁরা সেখানে হাজির হয়েছিলেন, তাঁদের তালিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কমিশনের সাবেক সচিব কিংবা কোনো জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা কোন বিবেচনায় আমন্ত্রিত হন, তা আমাদের বোধগম্য হয় না। বর্তমান কমিশনের সংখ্যাগরিষ্ঠ যেহেতু সাবেক আমলা, তাই আমলাপ্রীতি থেকে অতীত সতীর্থদের মতামত কিংবা সমর্থনের নিশ্চয়ই কোনো ভিন্ন মাহাত্ম্য আছে?
গাইবান্ধার উপনির্বাচন নিয়ে কমিশনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের একটি ন্যায্য সমালোচনা আছে, সেটা হলো কমিশনের কাজ নির্বাচন করা, বন্ধ করা নয়। নির্বাচন নিয়ে কাজ করা নাগরিক গোষ্ঠী সুজনও এ সমালোচনার প্রতিধ্বনি করেছে। কমিশন যে উপনির্বাচনটি করতে পারল না, তার সবচেয়ে বড় কারণ হলো তারা সম্ভাব্য বিপদগুলো আগাম অনুমান করতে পারেনি এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিতে পারেনি।
ভোট কেনাবেচার এবং মারধরের যেসব খণ্ডচিত্র (যেমন নড়াইল) গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, সেসব জায়গায় প্রশাসন ও পুলিশের কোনো জবাবদিহি ও শাস্তির কথা শোনা যায়নি। আগের দুটি কমিশনের মতো কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের কাজেও প্রমাণ মিলেছে যে প্রতিষ্ঠানটি ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের রাজনৈতিক চাপ মোকাবিলায় অনিচ্ছুক ও অক্ষম।
উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতিদের একজন, যাঁর সম্পর্কে কিছুদিন আগেও পত্রপত্রিকায় যথেষ্ট লেখালেখি হয়েছে। তাঁর পেশি ও অর্থশক্তি সম্পর্কে ধারণা থাকলে কমিশনের প্রস্তুতি অন্য রকম হওয়ার কথা। অবশ্য অবস্থা দেখে মনে হয়, বর্তমান কমিশনের ধারণা, প্রযুক্তি ব্যবহারেই সব সমস্যার সমাধান মিলবে।
গাইবান্ধার উপনির্বাচনে অবশ্য মন্দের ভালো (ইংরেজিতে যাকে সিলভার লাইনিং বলে) কিছু প্রাপ্তি আছে। প্রথমত, এতে প্রমাণিত হয়েছে, ভোটকেন্দ্রে ডাকাতদের প্রবেশ ও ডাকাতি বন্ধ করতে না পারলে ইভিএম কোনো সমাধান দেবে না। কাগজের ব্যালট ও ইভিএম—দুটোই দখলে নিয়ে অন্য কেউ ভোট দিতে সক্ষম। ব্যালটে ভোট আয়োজনের বদলে ইভিএমে অর্থ ব্যয় অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। সরকারের ইচ্ছাপূরণ ছাড়া ইভিএমের আর কোনো উপযোগিতা নেই।
দ্বিতীয়ত, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কমিশনের কথা শোনেনি, তারা কমিশনের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। বিষয়টির একটা ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছেন বহুল নিন্দিত মাগুরা উপনির্বাচন যাঁর আমলে হয়েছিল, সেই সাবেক সিইসি আব্দুর রউফ। তাঁর কথায়, ‘জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার রাজনীতিবিদদের সহযোগী।
রাজনৈতিক সরকারের অধীন নির্বাচনে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারদের হাতজোড় করলেও তাঁরা সরকারের কথাই শুনবেন, ইসির কথা নয়।’ তৃতীয়ত, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কমিশনের সংবিধানপ্রদত্ত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কার্যকর পথ খুঁজে পেতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় সেটি সম্ভব ছিল, যা আওয়ামী লীগ নিজেদের প্রয়োজনে বিলোপ করেছে। এর বিকল্প না পেলে কোনো কমিশনই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারবে না।
এগুলোর বাইরে সিসিটিভির ব্যবহারের অভিজ্ঞতা থেকেও কিছু শিক্ষণীয় আছে। সাবেক কমিশনারদের একজন, যিনি উপমহাদেশের নির্বাচনব্যবস্থার ওপর পিএইচডি করেছেন, সেই সাখাওয়াত হোসেন ইভিএমের বদলে ভোটকেন্দ্রে সিসিটিভি কীভাবে বাড়ানো যায়, সেদিকে নজর দিতে বর্তমান কমিশনকে পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর কথায় যুক্তি আছে। এবার সিসিটিভি না থাকলে কমিশনকে প্রশাসনের মনগড়া রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে সুষ্ঠু ভোটের সার্টিফিকেট দিতে হতো।
এই একটি জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা অপ্রস্তুত হয়ে তাঁদের কথিত ডিজিটাল বাংলাদেশ ও ফোর-জি মোবাইল সেবার কার্যকারিতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে বসেই যে সিসিটিভিতে নজরদারি সম্ভব, এই কথাটা রাজনৈতিক উত্তেজনায় তাঁরা ভুলে গেছেন, প্রশ্ন করেছেন, ঢাকায় বসে কমিশন কীভাবে অনিয়ম দেখতে পায়?
সিসিটিভির এই নজরদারি ক্ষমতা নির্বাচনে সহায়ক হলেও তা ততক্ষণে কাজে আসবে, যতক্ষণ তা পর্যবেক্ষণের সক্ষমতা কমিশনের থাকবে। ক্যামেরাগুলো বন্ধ করা কিংবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার মতো অপরাধ দমন কিংবা প্রশাসনের কোনো দলবাজ আমলা তা পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকলে ভোট ডাকাতদের হাত থেকে কাগজের ব্যালট কিংবা ইভিএম—কোনোটাই রক্ষা করা সম্ভব নয়। সেই সক্ষমতা কমিশন শিগগির অর্জন করবে, এটা বিশ্বাস করা কঠিন।
বিরোধীদলীয় রাজনীতিকেরা যথার্থই প্রশ্ন করেছেন যে একটিমাত্র আসনের উপনির্বাচন নিয়ে গলদঘর্ম হওয়া কমিশন কীভাবে ৩০০ আসন সামাল দেবে। তা-ও আবার সংসদ বহাল থাকবে এবং এমপিরা তাঁদের সুযোগ-সুবিধার সবই ভোগ করতে পারবেন। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য সতর্ক করার পরও তা উপেক্ষাকারী একজন এমপির কথিত অধিকার লঙ্ঘনের দাবি কি কমিশন নিষ্পত্তি করতে পেরেছিল?
কুমিল্লার অভিজ্ঞতা তা বলে না। প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন জেলা পরিষদ নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন দল যেসব জায়গায় অন্তঃকলহ মেটাতে পারেনি, সেসব জেলার চিত্রও দুঃখজনক।
ভোট কেনাবেচার এবং মারধরের যেসব খণ্ডচিত্র (যেমন নড়াইল) গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, সেসব জায়গায় প্রশাসন ও পুলিশের কোনো জবাবদিহি ও শাস্তির কথা শোনা যায়নি। আগের দুটি কমিশনের মতো কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের কাজেও প্রমাণ মিলেছে যে প্রতিষ্ঠানটি ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের রাজনৈতিক চাপ মোকাবিলায় অনিচ্ছুক ও অক্ষম।
কামাল আহমেদ সাংবাদিক