সাম্প্রতিক দুটি ঘটনা পাকিস্তান-ভারত সম্পর্কের বরফ গলার সম্ভাবনাকে আরও দুর্বল করেছে। প্রথমটি হলো, বেলুচিস্তানে জাফর এক্সপ্রেস ট্রেনে সন্ত্রাসী হামলা ও ছিনতাই। দ্বিতীয়টি হলো, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এক পডকাস্টে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ চালানোর অভিযোগ। এসব নতুন কিছু নয়। তবে এর পুনরাবৃত্তি দুই দেশের দীর্ঘস্থায়ী কূটনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠাকে আরও কঠিন করে দিল।
বেলুচিস্তানের সন্ত্রাসী ঘটনার পর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র এতে ভারতের জড়িত থাকার অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, ভারত দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানে সহিংসতা উসকে দিচ্ছে এবং বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সাহায্য করছে।
ইসলামাবাদ দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের হস্তক্ষেপের অভিযোগ করে আসছে। এর একটা প্রমাণ তো আছে—২০২৬ সালে গ্রেপ্তার হওয়া ‘র’ কর্মকর্তা কুলভূষণ যাদব। পাকিস্তানে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ও বিভিন্ন বালুচ গোষ্ঠীকে সহায়তার কথা স্বীকার করেছিলেন তিনি। ভারত অবশ্য এসব অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বরং পাকিস্তানকে নিজেদের সমস্যার দিকে মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ভারতীয় নেতৃত্ব মনে করছে যে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কহীনতা তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ভালো। বিজেপি সরকার পাকিস্তানকে নিরন্তর ‘শত্রু’ হিসেবে উপস্থাপন করে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চায়। তাহলে তাদের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা আরও শক্তিশালী হবে।
১৬ মার্চ এক পডকাস্টে মোদি পাকিস্তান সম্পর্কে দীর্ঘ মন্তব্য করেন। তিনি দুই দেশের উত্তেজনার জন্য পাকিস্তানের ‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাসবাদ’ ও মিথ্যা শান্তি প্রচেষ্টাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ভারত শান্তির চেষ্টা করলেও পাকিস্তান প্রতারণা করেছে। তিনি পাকিস্তানকে ‘সংকটের কেন্দ্র’ বলে অভিহিত করেন। এই বক্তব্য মোটেও অভিনব নয়। তবে এ ধরনের মন্তব্য দুই দেশের সম্পর্কে নতুন করে চাপ সৃষ্টি করেছে।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি ধারণা তৈরি করে রেখেছে ভারত। মোদি তা আরও জোরালো করলেন। বক্তব্যে দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার দায় সম্পূর্ণ পাকিস্তানের ওপর চাপানো হয়েছে। সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে দায়িত্বও পাকিস্তানের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকে মনে করেন, পাকিস্তান দুর্বল সময় পার করছে। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে ভারত। বেলুচিস্তানের সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতীয় গণমাধ্যমে অতিরঞ্জিত প্রচার-প্রচারণাও এটাই ইঙ্গিত করে।
এ পরিস্থিতি দুই দেশের সম্পর্ককে অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে দুই দেশের আনুষ্ঠানিক আলোচনা বন্ধ। সেই সঙ্গে বর্তমান উত্তেজনার কারণগুলো বিবেচনায় নিয়ে, উভয় পক্ষের মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝি এড়াতে সরাসরি না হলেও কিছু সংলাপ কার্যকর হতে পারে।
পাকিস্তান এ ধরনের একটি ব্যবস্থা চালুর পক্ষে আগ্রহী। অনানুষ্ঠানিকভাবে কিছু আলোচনাও চলেছে। সেগুলোয় দুই দেশের সাবেক কর্মকর্তারা এবং বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করেন। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে লন্ডনে এমন এক বৈঠকে পাকিস্তানের প্রস্তাবে ভারতীয় পক্ষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি। বরং তারা বলেছে, জুলাইয়ে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা বা সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠকের ফাঁকে দুই প্রধানমন্ত্রী আলোচনার জন্য কিছু সময় রেখে দিতে পারেন। তবে তা নির্ভর করছে, তারা আদৌ দেখা করবেন কি না, সে সিদ্ধান্তের ওপর।
ভারত মনে করে, বর্তমানে বিদ্যমান আলাপ–আলোচনার যেসব ধরন আছে, তা–ই সংকট মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট। এ রকম আলাদা করে আড়ালের আনুষ্ঠানিক আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। সম্ভবত তারা অতীতে রাওয়ালপিন্ডি ও ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার মধ্যে অস্থায়ী ভিত্তিতে হওয়া যোগাযোগের কথা উল্লেখ করছে। সর্বশেষ এমন ঘটনা ঘটে ২০২২ সালের মার্চে। সে সময় ভারতীয় বাহিনী ভুলবশত অম্বালা থেকে ব্রাহ্মোস ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ক্ষেপণাস্ত্রটি পাকিস্তানের মিয়ান চান্নুতে পড়ে। তবে দ্রুত পদক্ষেপের মাধ্যমে বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হয়।
পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনা আবার শুরুর পথে অনেক বাধা রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, কাশ্মীর ইস্যুতে দুই দেশের অবস্থানের চরম পার্থক্য। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারত বেআইনিভাবে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে এটিকে দুটি অংশে বিভক্ত করে ভারতীয় ইউনিয়নের অংশে পরিণত করে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবনা লঙ্ঘন করে নেওয়া এই পদক্ষেপের কারণে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করে পাকিস্তান। স্বাভাবিকভাবেই কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস পায়। মোদি সরকারের পরবর্তী কাশ্মীরবিষয়ক কঠোর পদক্ষেপ পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেয়।
ভারত চায়, পাকিস্তান ২০১৯ সালের ৫ আগস্টের সিদ্ধান্ত মেনে নিক এবং এটাই হোক দুই দেশের সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ভিত্তি। ভারত কোনো নমনীয়তা দেখাতে রাজি নয়। তারা বরং দাবি করছে যে কাশ্মীর সমস্যার এখন সমাধান হয়ে গেছে। তাই পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা করার কিছু নেই। ২০২৪ সালের আগস্টে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপের যুগ শেষ... কাশ্মীর প্রসঙ্গে ৩৭০ অনুচ্ছেদের বিলোপ হয়ে গেছে’।
এই দৃষ্টিভঙ্গি পাকিস্তানকে একটি কঠিন অবস্থানে ফেলেছে। পাকিস্তানের বর্তমান নেতৃত্ব যতই সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করুক না কেন, তারা তাদের নীতিগত অবস্থান ছাড়তে পারবে না। বাণিজ্যসহ অন্যান্য বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে কাশ্মীর সমস্যাকে পেছনে ফেলে দিলে, ভারত এটিকে তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া হিসেবেই ব্যাখ্যা করবে। এ সমস্যার সমাধান করা পাকিস্তানের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
তবে কিছু বাস্তবিক বিষয়ে উভয় দেশের মধ্যে তলার মহলের যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে ২০২৪ সালের অক্টোবরে কার্তারপুর করিডর চুক্তির নবায়ন করা হয়েছে। এতে ভারতীয় শিখ তীর্থযাত্রীরা পাকিস্তানে পবিত্র স্থান পরিদর্শন করতে পারেন। এটি ছিল দিল্লির অনুরোধে। দুই দেশের মধ্যে ধর্মীয় ভ্রমণের জন্য ভিসা প্রদান এবং জলসীমায় অনুপ্রবেশকারী জেলেদের মুক্তি দেওয়াও এই সহযোগিতার অংশ।
এই তলার দিকের কূটনৈতিক যোগাযোগ দুই দেশের মধ্যে বরফ গলাতে পারবে না। সম্পর্ক কেবল তখনই এগোতে পারবে, যখন দুই দেশের নেতৃত্ব বাস্তব ইচ্ছা জাহির করে সমঝোতার পথ বেছে নেবে। তবে আপাতত ভারতীয় নেতৃত্ব মনে করছে যে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কহীনতা তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ভালো। বিজেপি সরকার পাকিস্তানকে নিরন্তর ‘শত্রু’ হিসেবে উপস্থাপন করে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চায়। তাহলে তাদের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা আরও শক্তিশালী হবে।
মালিহা লোধি সাবেক পাকিস্তানি রাষ্টদূত
পাকিস্তানের পত্রিকা ডন থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ।