ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বশক্তির আগ্রাসন অনিবার্যভাবে সিরিয়া সংঘাতের দুর্বিষহ স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাম্প্রতিক মন্তব্যে সেটা উঠে এসেছে। সিরিয়াতে রাশিয়া যে যুদ্ধাপরাধ করেছে, সে জন্য তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হয়নি, এ কারণে একটা দায়মুক্তির বোধ তাদের মধ্যে জন্ম হয়েছে। ফলে তারা ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর সাহস পেয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, ইউক্রেনীয়দের কাছ থেকে রাশিয়ার আগ্রাসনের যে ভয়াবহতার কথা শোনা যাচ্ছে, অনেক সিরিয়ানের সেই একই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা রয়েছে। এর মধ্যে বেসামরিক নাগরিক ও বেসামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে উপর্যুপরি ও ইচ্ছাকৃত হামলার ঘটনা রয়েছে। এমনকি হাসপাতালগুলো লক্ষ্য করেও হামলা চালানো হয়েছে। এর ফলাফল হলো, গণবাস্তুচ্যুতি ও প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি। একের পর এক বোমাবর্ষণের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে ইউক্রেনের মারিওপোলসহ অন্যান্য শহর থেকে মানুষের পালানোর দৃশ্য সিরিয়ার হোমস, ঘৌতা ও পূর্ব আলেপ্পোর স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে।
সিরিয়াতে রাশিয়ার যুদ্ধাপরাধের অজস৶ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কোনো অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করা যায়নি। এই অপরাধীদের মধ্যে রাশিয়ার পক্ষে প্রক্সি যুদ্ধে অংশ নেওয়া ভাগনার গ্রুপও রয়েছে। ভাড়াটে সেনাদের এই গ্রুপ আফ্রিকাতেও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।
এরপরও সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ইউক্রেনের শিশুদের গণনির্বাসনে পাঠানোর অভিযোগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। এ ঘটনা ন্যায়বিচারের খানিকটা আশা জাগিয়েছে। যদি চলমান সহিংসতা এবং ভূরাজনৈতিক অচলাবস্থা বিচারপ্রক্রিয়া জটিল করে তুলেছে।
ইউক্রেন ও সিরিয়া সংঘাতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে, যুদ্ধের সময় কীভাবে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে। যদিও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, যুদ্ধের সময় আহত সেনা ও জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। হাসপাতালগুলোতে হামলা না চালোনোর বিষয়ে আইনগত বিধিনিষেধ আছে। অথচ সিরিয়া এবং অতীতে সংঘটিত অন্য সব যুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে রাখায় আজ ইউক্রেন অপ্রয়োজনীয় ও অকল্পনীয় ভোগান্তিতে পড়েছে।
এ ছাড়া রাশিয়া নিরলসভাবে যুদ্ধের বয়ানকে নিজেদের পক্ষে ব্যাখ্যা করার যে অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেটা যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি থেকে কোনো অংশে কম নয়। সিরিয়া সংঘাতে ভুল তথ্য ও প্রচারণার কৌশল রাশিয়ানরা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে। এখন তারা ইউক্রেন আগ্রাসনকে ন্যায্যতা দিতে এবং যুদ্ধ অপরাধকে অস্বীকার করতে সেই একই কৌশল ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের সর্বশেষ মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যে মূল্যায়ন করেছে তাতে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, ইউক্রেনে যা ঘটছে, তার স্পষ্ট কারণ হলো আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা এটি ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলাতেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
এসব প্রেক্ষাপটে, এখন সিরিয়া ও ইউক্রেনের সব ভুক্তভোগী জনসাধারণ, মানবাধিকার সংগঠন ও নাগরিক সমাজের মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে সহযোগিতা ও সংহতি গড়ে তোলা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ইমপুনিটি ওয়াচের নতুন একটি প্রতিবেদন আমি দেখেছি। এটি অপরাধীদের শুধু বিচারের আওতায় আনার সুযোগ তৈরি করবে না, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে দেশে দেশে যে পার্থক্য রয়েছে, সেটা ঘোচানোর সুযোগও তৈরি করবে।
গত বছর সিরিয়ার কয়েকটি সংস্থার দিক থেকে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা আশাব্যঞ্জক। সিরিয়া জাস্টিস অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিবিলিটি সেন্টার (এসজেএসি), সিরিয়াস হোয়াইট হেলমেটস এবং ইউনিয়ন অব মেডিকেল কেয়ার অ্যান্ড রিলিফ অর্গানাইজেশনস (ইউওএসএসএম) ইউক্রেনের সংস্থাগুলোর কাছে তাদের অভিজ্ঞতা ভাগ করেছে।
এর মধ্যে সিরিয়া আর্কাইভ সহযোগিতার ক্ষেত্রে বেশ উৎসাহব্যঞ্জক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সিরিয়ার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণের সবচেয়ে বড় মঞ্চ সিরিয়া আর্কাইভ। ইউক্রেনীয় আন্দোলনকর্মীদের সঙ্গে যৌথভাবে তারা ইউক্রেন আর্কাইভ তৈরিতে সহযোগিতা করেছে। ইউক্রেন আর্কাইভ রাশিয়ার আগ্রাসনে দেশটির মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণ করছে।
এসব প্রচেষ্টা তৃণমূল থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত উন্নীত করা প্রয়োজন।
সিরিয়ান ও ইউক্রেনীয় মানবাধিকারকর্মী ও সংগঠকেরা যাতে নিয়মিতভাবে একত্র হতে পারে, অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারে এবং কৌশল ঠিক করতে পারে, তার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
ন্যায়বিচার ও জবাবদিহির প্রচেষ্টা তখনই সফল হয়, যখন তাতে ভুক্তভোগীরা সক্রিয় ও অর্থপূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করেন। সে ক্ষেত্রে ইউক্রেনীয় ও সিরিয়ান ভুক্তভোগীদের একটি ফোরামে নিয়ে আসা প্রয়োজন, যাতে তারা একত্রে ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করতে পারে। যুদ্ধে আক্রান্ত জনসাধারণের পর্যাপ্ত ও মর্যাদাপূর্ণ সুরক্ষা যাতে নিশ্চিত করা যায়, সে জন্য নাগরিক সমাজের সংস্থাগুলো একত্রে কাজ করতে পারে।
ইউক্রেন ও সিরিয়া সংঘাতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে, যুদ্ধের সময় কীভাবে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে। যদিও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, যুদ্ধের সময় আহত সেনা ও জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। হাসপাতালগুলোতে হামলা না চালোনোর বিষয়ে আইনগত বিধিনিষেধ আছে। অথচ সিরিয়া এবং অতীতে সংঘটিত অন্য সব যুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে রাখায় আজ ইউক্রেন অপ্রয়োজনীয় ও অকল্পনীয় ভোগান্তিতে পড়েছে।
এসব নৃশংসতার তথ্যপ্রমাণ খুব ভালোভাবেই নথিভুক্ত করা আছে। বল এখন জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক কমিটি অব দ্য রেডক্রসের মাঠে। জেনেভা সনদ অনুযায়ী, তারাই এ জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্যসেবার ওপর যে হামলা হচ্ছে, তা নথিভুক্ত করার যে প্রচেষ্টা শুরু করেছে, সেটাকে মোটেই খাটো করে দেখার উপায় নেই। যাহোক, এই প্রচেষ্টা তত দিন পর্যন্ত যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে না, যত দিন পর্যন্ত না এ ধরনের হামলার সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের নাম প্রকাশ করা না হচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা সিরিয়া ও ইউক্রেনের নাগরিকদের আকাঙ্ক্ষা হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। সংঘাত-কবলিত এলাকায় ভুক্তভোগী, আক্রান্ত জনগোষ্ঠী, মানবাধিকারকর্মী এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য এটি একটি সর্বজনীন স্বপ্ন।
সিরিয়া এবং এখন ইউক্রেনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর চর্চা এখন থেকেই শুরু করা প্রয়োজন।
তায়স্যার আলকারিম সিরিয়ার চিকিৎসক ও মানবাধিকারকর্মী
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত