‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কী বার্তা দিল

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ সমাবেশে ছাত্র–জনতার ভীড়। ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ছবি: সাজিদ হোসেন

বেলা সাড়ে তিনটার পর যখন মেট্রোরেলে করে শাহবাগে নামলাম, সেখানে দাঁড়িয়েই বোঝা যাচ্ছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আজকের সমাবেশের দৃশ্য কেমন হতে পারে। আজকের সমাবেশ বলতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির ঘোষিত মার্চ ফর ইউনিটি কর্মসূচি।

জাতীয় জাদুঘরের সামনে থেকে ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে হেঁটে সামনের দিকে এগোতে গিয়ে একেকটা মিছিল দেখছিলাম। ছোট ছোট মিছিল, নানা স্লোগানে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পাসে ‘বহিরাগত’ নিয়ন্ত্রণের বালাই নেই দেখলাম আজকে, যেটি নিয়ে গত কিছুদিন ধরে সমালোচনা চলমান।

টিএসএসি ও রাজু ভাস্কর্যের সামনে এসে চারদিক থেকে অনেকগুলো মিছিলের দেখা পেলাম। বেশির ভাগই তরুণ–তরুণী। আছে স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়–মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। পতাকা বিক্রেতাদেরও বেশ বিকিকিনি দেখা গেল। তাঁদের কাছ থেকে জাতীয় পতাকা, ফিলিস্তিনের পতাকা, কালেমাখচিত পতাকা কিনছেন অনেকে, সেগুলোই উড়ছে মিছিলের মাথার ওপরে। মিছিলের পাশ ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে। এর আগে ৩ আগস্ট একইভাবে শহীদ মিনারে গিয়েছিলাম। সেদিনের দৃশ্যই চোখে ভাসছিল।  

গত শনিবার সন্ধ্যার পর থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, সমন্বয়ক ও মুখপাত্ররা ফেসবুকে একযোগে ঘোষণা দিতে থাকেন ৩১ ডিসেম্বরের কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। সেখানে ‘প্রোক্লেমেশন অব সেকেন্ড রিপাবলিক’ ঘোষণার বিষয়টি অনেকটা নজর কাড়ে। বলা হয়, মুজিববাদের কবর রচনা হবে সেদিন।

বিষয়টার মানে কী? আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে সেদিন? নাগরিক সমাজও কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। এদিন কি সংবিধান বাতিলের ঘোষণা দেওয়া হবে? নাকি নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা আসবে? তাহলে কি সরকারের মধ্যে ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে থাকা উপদেষ্টারা পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন?

সব মিলিয়ে নানা ধোঁয়াশা তৈরি হয়। তবে এক দিনের মধ্যে সেটি কিছুটা হলেও স্পষ্ট হয় যে এদিন ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ পাঠ করা হবে। সেটিকেই মূলত ‘প্রোক্লেমেশন অব সেকেন্ড রিপাবলিক’ ঘোষণা হিসেবে ধারণা করতে পারি। বিষয়টা কী? মূলত জুলাইয়ের অভ্যুত্থানকে একটা লিখিত ঘোষণার মাধ্যমে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। জুলাই অভ্যুত্থানের ইশতেহার হবে এই ঘোষণাপত্র।

মার্চ ফর ইউনিটির জমায়েতের একাংশ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪
ছবি: সাজিদ হোসেন

ছাত্রনেতাদের দাবি ছিল, এমন ঘোষণা সরকার থেকেই আসতে হবে। এখন সরকার যখন সেটি করছে না, দেরিতে হলেও সেই দায়িত্ব তাঁরা তুলে নিয়েছেন। বিশাল জমায়েতের মাধ্যমে সেই ঘোষণাপত্র দিয়ে সরকারকে একপ্রকার বাধ্য করা যে রাষ্ট্রীয়ভাবে সেটি যেন স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আজকের কর্মসূচিতে দেখা হওয়া চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের সক্রিয় কর্মী এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির একজন সদস্যের সঙ্গে আলাপে এসব বিষয় জানা গেল।  

এখন ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ পাঠ বা ঘোষণা বা উপস্থাপনের কর্মসূচি নিয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা জল্পনাকল্পনা বা আলোচনার জন্ম দেয়। সরকার একবার বলে এ কর্মসূচির সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই; আরেকবার বলে, সরকার থেকেই জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র দেওয়া হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে তৈরি হয় নানা হাস্যরসও।

তখন গণ–অভ্যুত্থানের শক্তি হিসেবে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে এ ঘোষণাপত্র দেওয়া হবে কি হবে না, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আজকের জমায়েত হবে কি হবে না, দেশের নানা প্রান্ত থেকে যাঁরা ইতিমধ্যে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন, তাঁরা কি মাঝপথে ফেরত যাবেন কি না—এসব নিয়ে একধরনের দোলাচল বা সংশয় বা দ্বিধা তৈরি হয়।

সন্ধ্যায় মার্চ ফর ইউনিটি শেষে ফিরছিলাম একই পথ ধরে। মিছিল ও স্লোগানেই ফিরছিলেন আগত মানুষেরা। টিএসসিতে এসে দেখলাম, মেট্রোরেলের পিলারে আঁকা শেখ হাসিনার বিশাল ছবি তথা ‘ঘৃণাস্তম্ভে’ জুতা নিক্ষেপ করছিলেন অনেকে। ৩ আগস্টই সেই ঘৃণাস্তম্ভ রচিত করেছিল ছাত্র–জনতা। যদিও কয়দিন আগে সেটি মুছে ফেলার ঘটনাকে ঘিরে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির পর নতুন করে আঁকা হয়েছে।

গভীর রাত পর্যন্ত নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে ঘোষণাপত্র পাঠের কর্মসূচি থেকে পিছটান দিয়ে আজকের মার্চ ফর ইউনিটি কর্মসূচি ঘোষণা দেন ছাত্রনেতারা। সেখানে তাঁরা এ–ও বলেন, সরকার অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সবাইকে সম্পৃক্ত করে ঘোষণাপত্রটি দেওয়া উচিত বলে অনুভব করেছে। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্বটি নিয়েছে, সেটিকে সাধুবাদ জানান তাঁরা। এতে স্পষ্ট হয়ে যায়, শুরুর কর্মসূচি থেকে একপ্রকার তাঁরা সরে এসেছেন।

এখন মধ্যরাতে ঘোষিত মার্চ ফর ইউনিটি কর্মসূচি সফল হবে কি না, সেখানে জমায়েত হবে কি না, এমন প্রশ্নও তৈরি হয়। এমনও আলোচনা দেখা যায় যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সকালে অনুষ্ঠিত হওয়া জামায়েতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে আগত ব্যক্তিরাও মার্চ ফর ইউনিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যাবে। তবে শাহবাগ থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মনে হলো, ঢাকার বাইরে থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ এসেছে। বেশির ভাগই তরুণ ও শিক্ষার্থী, সেটি আগেই বললাম। যদিও কম–বেশি সব বয়সের মানুষেরই উপস্থিতি ছিল।

অনেকে ৩ আগস্টের এক দফা ঘোষণার জমায়েতের সঙ্গে এই জমায়েতের তুলনা করতে চাইবেন নিঃসন্দেহে। সেই বিবেচনায় জমায়েত কমই হবে। কয়েক গুণ কমই বলতে হবে। ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজ ও অভিভাবকেরা সেদিন যেভাবে নেমে এসেছিলেন, আজ তাঁদের তেমন একটা দেখা গেল না।

মার্চ ফর ইউনিটিতে অংশগ্রহণকারীদের স্নোগান। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪
ছবি: সাজিদ হোসেন

এ ছাড়া ডান–বাম, ছোট–বড় সব ধরনের রাজনৈতিক দলের মানুষের উপস্থিতিও সেদিন ছিল। আজ সেটি ছিল না। আজকে প্রতিটি মিছিলের সামনে কয়েকজন করে নারী দেখা গেলেও ৩ আগস্টের তুলনায় নারীর সংখ্যা অনেক কমই ছিল। পরিস্থিতি ও বাস্তবতা বিবেচনায় সেদিনের মতো জমায়েত আজকে হবে না, সেটি মানতেই হবে। এর পরেও বড় সমাবেশই বলা যায় আজকের কর্মসূচিকে।  

ছাত্র–জনতার পাশাপাশি বিভিন্ন কমিউনিটি আকারেও মানুষ এসেছে দেখলাম মিছিল নিয়ে। দলিত–হরিজন–তফসিলি সম্প্রদায়ের মানুষেরা এসেছেন তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে। রিকশাচালকেরা এসেছেন ছোট একটি মিছিল নিয়ে।

এক পাশে এক দল মানুষের হাতে দেখলাম ‘আওয়ামী দুঃশাসনের প্রতিবাদ করায় নানা সময়ে চাকরিচ্যুত ২২০০ পুলিশ পরিবার’–এর ব্যানার। তাঁদের একজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা মার্চ ফর ইউনিটির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে এসেছেন। তাঁর দাবি, বঞ্চিত ও পদচ্যুত বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তারা এখন নানাভাবে সুবিধা পাচ্ছেন এবং অধিকার ফিরে পাচ্ছেন; কিন্তু তাঁরা এখনো বঞ্চিত। একইভাবে বিচারের দাবি নিয়ে এসেছেন পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিপীড়িত বিডিআর সদস্যদের পরিবারের মানুষজন।

ভিড়ের মধ্যে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে, কিছুক্ষণ হেঁটে বক্তব্য শোনা হলো। অভ্যুত্থানে শহীদদের বাবারা, আহত ব্যক্তিরা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও জেলার সমন্বয়ক, কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক, জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা একের পর এক বক্তব্য দিয়ে গেলেন। বক্তব্য দিলেন ফ্যাসিবাদী সরকারের কালাকানুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নির্মম শিকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরাও। এসেছিলেন ছাত্রলীগের নির্যাতনে হত্যাকাণ্ডের শিকার বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের বাবাও। তবে ছিলেন না সরকারে থাকা গণ–অভ্যুত্থানের তিন ছাত্রনেতা।

সবার বক্তব্য প্রায় অভিন্ন ছিল— খুনি  হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে, তাঁকেসহ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের খুনি নেতাদের বিচার করতে হবে, তাদের ফাঁসি দিতে হবে। নিহত ও আহত ব্যক্তিদের যে পরিবারগুলো নানাভাবে এখনো অবহেলিত, তাদের দায়িত্ব নিতে হবে। ‘মুজিববাদী’ বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল করতে হবে। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা বিলোপ করতে হবে। হাসিনার আমলাতন্ত্রের অবসান ঘটাতে হবে। আওয়ামী লীগ আমলের সব গুম–খুনের বিচার করতে হবে। এতগুলো মানুষ শহীদ হয়েছে শুধু নির্বাচনের জন্য নয়। নির্বাচনের আগে বিচার ও সংস্কারের দাবি নিয়েই বেশ জোরালো বক্তব্য দেখা গেল বেশ কয়েকজনের কণ্ঠে। সরকারের প্রতি এ আলটিমেটামও দেওয়া হয়, ১৫ জানুয়ারির মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে হবে। নয়তো তারা আবারও মাঠে নামতে বাধ্য হবেন।

কর্মসূচির এ–মাথা ও–মাথা ঘুরতে–ফিরতে–হাঁটতে গিয়ে এটিকে একটি ‘শোডাউনই’ মনে হলো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি যে রাজনৈতিক শক্তি আকারে হাজির হতে যাচ্ছে, তারই একটি প্রতিধ্বনি পাওয়া গেল এ কর্মসূচিতে। এরই মধ্যে দেশের অনেক জেলা–উপজেলায় দুটি প্ল্যাটফর্মেরই কমিটি হয়েছে। জেলা–উপজেলা থেকে বাস ভাড়া করে সেসব কমিটির মানুষ এসেছেন আজকের কর্মসূচিতে। বলতে গেলে এ সমাবেশে ঢাকার বাইরের জেলা–উপজেলা ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–জনতাই বেশি ছিলেন।

সন্ধ্যায় মার্চ ফর ইউনিটি শেষে ফিরছিলাম একই পথ ধরে। মিছিল ও স্লোগানেই ফিরছিলেন আগত মানুষেরা। টিএসসিতে এসে দেখলাম, মেট্রোরেলের পিলারে আঁকা শেখ হাসিনার বিশাল ছবি তথা ‘ঘৃণাস্তম্ভে’ জুতা নিক্ষেপ করছিলেন অনেকে। ৩ আগস্টই সেই ঘৃণাস্তম্ভ রচিত করেছিল ছাত্র–জনতা। যদিও কয়দিন আগে সেটি মুছে ফেলার ঘটনাকে ঘিরে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির পর নতুন করে আঁকা হয়েছে।

শাহবাগে এসে মেট্রোরেলে চড়তে লাইনে দাঁড়িয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। তাঁরা এসেছেন রংপুরের পীরগাছা থেকে। রাতেই ফিরে যাবেন। তার আগে আগারগাঁও থেকে ঘুরে আসবেন। কোনো কাজে যাচ্ছেন।

তাঁদের মধ্যে পারভেজ উদ্দীন নামের স্কুলছাত্রের সঙ্গে কথা হলো। সে ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী। পারভেজ জানাল, সে আজকের কর্মসূচিতে আসতে পেরে খুব খুশি। নতুন রাজনীতি করতে চায় তারা। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো দিয়ে আর কিছু হবে না। এবার ছাত্ররাই নতুন কিছু করবে।

দেশের একেবারে প্রান্তিক এলাকার নতুন প্রজন্মের মানুষ পারভেজকে বেশ আশাবাদী ও উজ্জীবিত মনে হলো দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে। নতুন বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে নুতন রাজনীতির ঘোষণাই দিল যেন সে। দেখা যাক, ২০২৫ সালের বাংলাদেশে কী অপেক্ষা করছে।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: [email protected]