আফগানিস্তান নিয়ে নীতি বদলাবে পাকিস্তান

সন্ত্রাসী হামলা পাকিস্তানে নিরাপত্তার উদ্বেগ তৈরি করেছেছবি: রয়টার্স

পাকিস্তানে সব সময়ই ঘটনার ঘনঘটা। সেই হিসেবেও গত সপ্তাহটি ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। ইমরানের পিটিআই (পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ) এবং পিএমএল-এন (পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ) পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ভদ্রলোকের মতো ছবি তুলেছে। ইমরান খান ও তাঁর স্ত্রী একটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। পিটিআইয়ের ব্যারিস্টার গওহার সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এই সাক্ষাৎ হলো সেনাবাহিনী আর পিটিআইয়ের মধ্যে সংযোগের প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। আর সর্বশেষ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ, খাইবার পাখতুনখাওয়ার সংঘাতপূর্ণ জেলাগুলোয় কুররাম শান্তি চুক্তি শুরু হওয়ার আগেই ভেঙে পড়েছে।

তবে এত সব শিরোনামের ভিড়ে পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকের গুরুত্ব হারিয়ে গেলে ঠিক হবে না। বৈঠকটি ছিল সেনাপ্রধানের সঙ্গে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের প্রায় সব প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতাদের।

সম্ভবত এই প্রথমবার সেনাপ্রধান জনসমক্ষে প্রদেশের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠক করে খাইবার পাখতুনখাওয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে তাঁদের মতামত চেয়েছেন। এই বৈঠক মেনে নিল যে প্রদেশে সব সমস্যার সমাধান শুধু শক্তি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে সম্ভব নয়। দেশের নিরাপত্তা সমস্যা সমাধানে জনগণের সম্পৃক্ততা দরকার। দরকার রাজনীতিবিদদের জনগণ ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সেতুবন্ধন হিসেবে ভূমিকা পালন করা। এই দুই বিষয় গুরুত্ব পাওয়া অব্যাহত থাকলে তা প্রশংসার দাবিদার হবে।

ডন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সবাই অন্তর্বর্তী আফগান সরকারের সঙ্গে সংলাপ করার পরামর্শ দিয়েছেন; তা আনুষ্ঠানিক হোক বা অনানুষ্ঠানিক।’ বৈঠকে সব অংশগ্রহণকারী মনে করেন, পারস্পরিক সহযোগিতা প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে। পত্রিকার প্রতিবেদনের ব্যাপারটা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এ সময় সংবাদ প্রতিবেদনগুলো সাধারণত সরকারি বিবৃতি বা প্রেস রিলিজেই সীমাবদ্ধ। আলোচনা বা মতবিনিময়ের খুব কমই ইঙ্গিত পাওয়া যায় সেখানে। এর কারণ শুধু ইসলামাবাদের সাংবাদিকদের অলসতা নয়। কারণ এ–ও যে রাজনীতিবিদেরা এখন যেন কোনো টিভি অনুষ্ঠানের রেকর্ডিংয়ের দর্শকের ভূমিকায় সন্তুষ্ট। তাঁরা সব কথা বলেন অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী।

পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়া ও আইএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ফয়েজ তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পাকিস্তানের রাজনীতিবিদেরা তখন এ সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। অথচ এখন সেই একই মুখগুলো টিটিপিকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে আনার পিটিআইয়ের ‘খারাপ সিদ্ধান্ত’ নিয়ে হইচই করছে।

ফয়েজ ও বাজওয়া সরে যাওয়ার পর রাষ্ট্রের অবস্থান হলো কঠোর। ক্ষমতায় থাকা সবাই হঠাৎ করে আলোচনাবিরোধী শিবিরে যোগ দিয়ে আফগান প্রশাসনের কড়া সমালোচক হয়ে ওঠেন। বহাল নীতিগুলোকে কেবল সমর্থন করার প্রবণতা যেন রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কারণেই গত সপ্তাহের বৈঠক দ্বিগুণ গুরুত্বপূর্ণ। মনে হচ্ছে রাজনীতিবিদেরা প্রচলিত নীতির বাইরে শুধু ভিন্ন মতামতই প্রকাশ করেননি, বরং তা খোলামেলাভাবে জানিয়েছেনও।

এসব একটা বাস্তব পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। আশা করা যায় যে এই ধারা বজায় থাকবে। প্রথমত, পারভেজ মোশাররফ-পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে যে সামরিক অভিযান কোনো শূন্যতার মধ্যে সফল হতে পারে না। এর জন্য রাজনৈতিক ও জনসমর্থন প্রয়োজন। আর তাঁর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নীরব অংশীদার হওয়ার বাইরে বের হয়ে আসতে হবে। দ্বিতীয়ত, নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ এবং তার সমাধান নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনা অপরিহার্য। দীর্ঘদিন ধরে এই আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গোপন ঘরেই সারা হতো। এর ফলে সবচেয়ে বড় ক্ষতিও হয়েছে। কেউ প্রশ্ন তুলতে সাহস করেনি।

জিজ্ঞাসা করা দরকার যে পাকিস্তানের পশ্চিম ও পূর্ব সীমান্তে শত্রুভাবাপন্ন সরকার থাকা কতটা কার্যকর? আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, পাকিস্তান কি সত্যিই মনে করে দিল্লির প্রতি তার যে কেবল সামরিক নিরাপত্তাভিত্তিক নীতি, তা আফগানিস্তানের ক্ষেত্রেও পুনরাবৃত্তি করা ঠিক হবে?

গত এক দশকে পাকিস্তান প্রায়ই আফগানিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়া এবং জনগণের চলাচলে বাধা দেওয়ার পথ বেছে নিয়েছে। যেন পাকিস্তান মনে করে কূটনীতি বা সংলাপের মাধ্যমে তেমন কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়। তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি এ–ও জিজ্ঞাসা করা জরুরি যে টিটিপির সহিংসতার কারণে জনগণকে অর্থনৈতিকভাবে শাস্তি দিলে জনগণ কি রাষ্ট্রকে সমর্থন করবে? নীতি যা–ই হোক, তা অন্তত খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে যেন নেওয়া হয়।

আরিফা নুর সাংবাদিক

ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত