বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রচলিত ধারার লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পক্ষে তাঁদের জোরালো অবস্থান আবার তুলে ধরেছেন। সম্প্রতি বুয়েটের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীসহ ৩৪ জন টাঙ্গুয়ার হাওরে গেলে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা এবং রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র ও গোপন বৈঠকের অভিযোগে তাঁদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত, পাল্টা মত, সমালোচনা, আলোচনা তৈরি হয়। এর মাঝেই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের একটি অংশ কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ার সামনে শপথ পাঠ করে ছাত্ররাজনীতি ও মৌলবাদ রুখে দেওয়ার কথা বলে।
বুয়েটে জোরালোভাবে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি ওঠে ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতপ্রকাশে সক্রিয় আবরারকে শেরেবাংলা হলের একটি কক্ষে ডেকে নিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেন। সহপাঠী হত্যার প্রতিবাদে টানা আন্দোলন শুরু করেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের একপর্যায়ে বুয়েট কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সব ধরনের ক্রিয়াশীল ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে।
যদিও ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলো বুয়েট কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন, তা অবশ্য বলা যাবে না। ভেতরে-ভেতরে তারা নানা তৎপরতা জারি রেখেছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের ব্যানারে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের তৎপরতায় বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে বাগ্বিতণ্ডার মতো ঘটনাও ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভেতরে-ভেতরে ছাত্রশিবির ও অন্যান্য ধর্মভিত্তিক ছাত্রসংগঠনও সক্রিয় বলে অভিযোগ আছে। এর জেরে ছাত্রলীগ ও তাদের মতের বুদ্ধিজীবীরা বুয়েট শিক্ষার্থীদের যেকোনো প্রতিবাদকে শিবির-সংশ্লিষ্টতার তকমা দেওয়ারও চেষ্টা করেন।
বুয়েটের শিক্ষার্থীরা প্রথাগত ছাত্র রাজনীতির যে নিপীড়ন ও নিষ্ঠুরতা তার প্রতিক্রিয়াতে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা বলছেন। নব্বই পরবর্তী ছাত্র রাজনীতির প্রধান ধারাটিই হলো, নিপীড়নের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন। ছাত্র রাজনীতি বন্ধে বুয়েট শিক্ষার্থীদের দাবিকে যারা হেট পলিটিকস বলে সমালোচনায় বিদ্ধ করছেন তারা এই বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। প্রথাগত ও লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধের জোরালো অবস্থানটাই বরং এই সময়ের রাজনৈতিক দাবি।
এর বিপরীতে বুয়েটে প্রচলিত ধারার ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পক্ষের মত প্রবলভাবে সক্রিয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীর সমর্থন এই মতের পক্ষে। এঁদের মধ্যে কেউ হয়তো রাজনৈতিকভাবে কোনো একটা পথ বা মতের সমর্থক আবার কেউ হয়তো রাজনীতি পছন্দ করেন না—এ রকম চিন্তার অনুসারী। কিন্তু এঁদের সবার মাঝে এ ব্যাপারে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে যে তাঁরা প্রচলিত ধারার লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধ চান।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় রাজনীতিতে যে মেরুকরণ ও উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তা সমাজের সবখানেই ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন মেরুকরণ নিকট অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে স্পষ্ট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরও বেশি খোলাখুলি এই বিভাজন। ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের পক্ষে ও সরকারের বিরুদ্ধে দুই ধারার ভাবধারা প্রচারক গোষ্ঠী নানা ইস্যুতে পরস্পরের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে লড়ছে। ভারতীয় লেখক ও আন্দোলনকর্মী অরুন্ধতী রায়ের কাছে ধার করে এদের ইন্টারনেট যোদ্ধা বলা যায়। এই দুই বিপরীত মেরুর ইন্টারনেট যোদ্ধাদের মধ্যে বুয়েট শিক্ষার্থীদের ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবির বিরুদ্ধে আবার বিরল ঐকমত্য রয়েছে। দুই পক্ষই তাদের সমালোচনায় বিদ্ধ করেছেন।
ইন্টারনেট যোদ্ধাদের কেউ কেউ মনে করছেন, আমাদের সমাজে ধারাবাহিকভাবে ‘হেট পলিটিকস’ যে প্রচারণা চলেছে, তারই প্রতিফলন বুয়েট শিক্ষার্থীদের এই অবস্থান। আবার কেউ মনে করেছেন, পেছন থেকে মৌলবাদী গোষ্ঠী ইন্ধন দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিপথে নিয়ে যাচ্ছে।
কোনো পক্ষই কিন্তু বুয়েটের শিক্ষার্থীদের কী বলছে, তা শুনছে না; কিংবা প্রয়োজন বোধ করছে না। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ক্যাফেটেরিয়ার সামনে বুকে হাত রেখে যে শপথ পড়েছেন, তার একটি অংশ পাঠ করে নেওয়া যাক। ‘আমরা আরও প্রতিজ্ঞা করছি যে বুয়েট ক্যাম্পাসে সব ধরনের সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উত্থানকে আমরা সম্মিলিতভাবে রুখে দেব। নৈতিকতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বৈষম্যমূলক অপসংস্কৃতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারকে আমরা সমূলে উৎপাটিত করব। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় যেন আর কোনো নিষ্পাপ প্রাণ ঝরে না যায়, কোনো নিরপরাধ যেন অত্যাচারের শিকার না হয়, তা আমরা সবাই মিলে নিশ্চিত করব।’
বুয়েট শিক্ষার্থীরা খুব সুস্পষ্টভাবে তাঁদের অবস্থান তুলে ধরে বলেছেন, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির চরমতম রূপ বারবার আঘাত হেনেছে আমাদের বুয়েট ক্যাম্পাসে। ২০০২ সাল থেকে শুরু করে ২০১৯ সাল—ছাত্ররাজনীতির অন্ধকার অধ্যায় তার ভয়ংকর দাগ রেখে গেছে আমাদের এ ক্যাম্পাসে। তাঁরা সুনির্দিষ্টভাবে ২০০২ ও ২০১৯ দুটি সালের কথা বলেছেন। এ দুটি সালই বুয়েট ও বাংলাদেশের ছাত্র ইতিহাসের কলঙ্কময় দুটি অধ্যায়। সাবিকুন নাহার সনি ও আবরার ফাহাদ—ছাত্ররাজনীতির দুই নিষ্ঠুরতম বলি। প্রথমজন ছাত্রদলের, পরেরজন ছাত্রলীগের বলি।
২০০২ সালের ৮ জুন বুয়েটে দরপত্র নিয়ে ছাত্রদলের দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান কেমিকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী সনি। বুয়েট ছাত্রদল সভাপতি মোকাম্মেল হায়াত খান মুকি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের টগর গ্রুপের সংঘর্ষের মধ্যে পড়েছিলেন তিনি। দীর্ঘ আন্দোলনের পর আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। বিচারে নিম্ন আদালতে মুকি, টগর ও নুরুল ইসলাম সাগরের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়। পরে হাইকোর্ট তাঁদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এ ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এস এম মাসুম বিল্লাহ ও মাসুমকে খালাস দেন হাইকোর্ট। মুকি পরে পালিয়ে যান অস্ট্রেলিয়ায়। সাগরও পলাতক রয়েছেন। কারাগারে রয়েছেন টগর।
অন্যদিকে ছাত্রশিবিরের কর্মী সন্দেহে মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে আবরারকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার মামলায় ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সাজাপ্রাপ্ত সব আসামিই বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা-কর্মী।
সনি ও আবরার দুজনেই ছাত্রসমাজের ওপর চেপে বসা আধিপত্যবাদী ছাত্ররাজনীতির বলি। নব্বইয়ের পরে যে দল যখন ক্ষমতায় এসেছে, তখনই তারা ছাত্ররাজনীতিকে তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। সীমাহীন ক্ষমতার চর্চার মধ্য দিয়ে ছাত্রনেতারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছেন। হলে থাকতে গেলে, ক্যাম্পাসে ক্লাস করতে গেলে সামন্ত প্রভুদের মতো তাঁদের কুর্নিশ করতে করতে শিক্ষার্থীদের মেরুদণ্ডটাই বাঁকা হয় যায়। শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন এবং ভয়ংকর ভয়ের পরিবেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কীভাবে স্বাভাবিক শিক্ষাজীবন সম্ভব?
বুয়েটের শিক্ষার্থীরা প্রথাগত ছাত্র রাজনীতির যে নিপীড়ন ও নিষ্ঠুরতা তার প্রতিক্রিয়াতে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা বলছেন। নব্বই পরবর্তী ছাত্র রাজনীতির প্রধান ধারাটিই হলো, নিপীড়নের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন। ছাত্র রাজনীতি বন্ধে বুয়েট শিক্ষার্থীদের দাবিকে যারা হেট পলিটিকস বলে সমালোচনায় বিদ্ধ করছেন তারা এই বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। প্রথাগত ও লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধের জোরালো অবস্থানটাই বরং এই সময়ের রাজনৈতিক দাবি।
মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী